দ্য প্রফেট- জিবরান কাহলিল জিবরান

দ্য প্রফেট বইয়ের লেখক জিবরান কাহলিল জিবরান। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো, জিবরান খলিল জিবরান বিন মিখাইল সাদ। দ্য প্রোফেটের লেখক জিবরান খলিল জিবরান হচ্ছে লেবাননী-আমেরিকান কবি, চিত্রশিল্পী, লেখক, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ, সমাজচিন্তাবিদ, চাক্ষুষ শিল্পী। ১৮০৩ সালে লেবাননের ম্যারোনাইট খ্রিস্টান পরিবারে তিনি জন্ম নেন। মূলত তিনি কবি হিসেবেই পরিচিত লাভ করেন। তাকে বলা হয় লেবাননের জাতীয় কবি। তিনি একজন প্রথাবিরোধী লেখক ছিলেন।
‘দি প্রফেট’ কবিতাটির নায়ক আল-মোস্তফা ঈশ্বরের অতি প্রিয় ও পছন্দের (ঞযব ঈযড়ংবহ ধহফ ঃযব নবষড়াবফ)। তাঁরই প্রেরিত পুরুষ। প্রফেট, আল মুস্তফা; ১২ বছর কাটিয়েছেন ওরফালেজ শহরে। ১২ বছরে কত আবেগ, ঘোর মিশে আছে আল-মুস্তফার মানসপটে। বিদায়বেলায় একের পর এক স্মৃতি ভেসে আসছে, কে ঠেকায় আবেগের এই স্রোতকে? চিৎকার করে ওঠলেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে-হে আমার আদি মায়ের সন্তানেরা-তোমরা সাগর পাড়ি দিয়েছ-আমার স্বপ্নে তোমরা কতবার পাড়ি জমিয়েছ-আজ এসেছ আমার জাগরণে, আমার গভীরতম স্বপ্নে।
সবাই আটকাতে চাইলো আল মুস্তফাকে। ক্ষুদ্র এই বন্ধনে আটকাবার মত কিইবা আছে তাদের। তবে ভালেবাবাসার কমতি যে ছিলনা সেই মানুষগুলোর সেটা বোঝা যায়। কাঁদছেন প্রফেট, কাঁদছেন সবাই। এমন সময় জনসমক্ষে বেড়িয়ে এলেন আলমিত্রা। বললেন, মুস্তফাকে যেতে দিতে হবে, তবে যাওয়ার আগে যেন সেই সত্যের কথাগুলো বলে যান, যেগুলো মশাল হিসেবে কাজ করবে ওরফালেজ শহরে। তারপর একজন ধনী আসে দান সম্পর্কে জানতে; বৃদ্ধ এক হোটেল মালিক আসেন খাওয়া ও পান করার প্রশ্ন নিয়ে; কৃষক আসেন তার কাজ সম্পর্কে জানতে; কাপড় সম্পর্কে জানতে আসেন একজন তাঁতি; কেনাবেচার কথা জানতে প্রশ্ন করেন একজন ব্যবসায়ী; অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে জানতে চান একজন বিচারক; আইন সম্পর্কে জানতে আসেন একজন আইনজীবী; স্বাধীনতা সম্পর্কে জানতে চান একজন বক্তা (ঙৎধঃড়ৎ); যুক্তি ও আবেগ সম্পর্কে জানতে আসেন একজন মহিলা ধর্মযাজক; কষ্ট (চধরহ) সম্পর্কে জানতে চান জনৈকা নারী; আত্মজ্ঞান (ঝবষভ-শহড়ষিবফমব) সম্পর্কে জানতে চান একজন পুরুষ; শিক্ষা সম্পর্কে জানতে চান একজন শিক্ষক; বন্ধুত্ব সম্পর্কে জানতে চান জনৈক যুবক; কথা বলা (ঞধষশরহম) সম্পর্কে জানতে চান একজন প-িত; সময় সম্পর্কে জানতে চান একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী; শহরের একজন বৃদ্ধ জানতে চান ভালো ও মন্দ সম্পর্কে; প্রার্থনা সম্পর্কে জানতে চান একজন মহিলা পুরোহিত; একজন তপস্বী (যবৎসরঃ) আনন্দ সম্পর্কে জানতে চান; সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে চান একজন কবি; ধর্ম সম্পর্কে জানতে চান একজন বৃদ্ধ পুরোহিত; শেষে আল-মিত্রা পুনরায় মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চান। আল-মোস্তফা সবার প্রশ্নের জবাব দেন, উপদেশ দেন এবং সবার উদ্দেশে কিছু বলেন।
কাহলিল জিবরানের লিখা ২৬টি গদ্য কবিতার একটি বই যা ইংরেজিতে লিখা হয়েছে। এটি ১৯২৩ সালে মূলত আলফ্রেড এ. নফ প্রকাশ করে। এটি জিবরানের পরিচিত সেরা কাজ। দ্য প্রোফেট বইটি প্রায় ১০০ টির বেশি ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে এবং এখনো ছাপানো হচ্ছে। বাংলাদেশেই পাওয়া যায় পৃথক পৃথক ভাবে করা ৮ জনের ৮ টি অনুবাদ গ্রন্থ। সহজেই বোঝা যায় দ্য প্রফেট নিয়ে বাংলাদেশী মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। দ্য প্রোফেট বইটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র আল-মুস্তফাযে, বিদেশী আরফালিস শহরে ১২ বছর ধরে বসবাস করেছে এবং একটি জাহাজ সম্পর্কে যা তাকে তার দেশে নিয়ে যাবে। বিদায় লগ্নে তিনি এক দল মানুষের উদ্দেশ্যে জীবন এবং মানুষের অবস্থার বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে। বইটি প্রেম, বিয়ে, সন্তান, দান, খাওয়া-দাওয়া, কাজ, আনন্দ ও দুঃখ, ঘর, কাপড়-চোপড়, ক্রয় এবং বিক্রয়, অপরাধ ও শাস্তি, আইন, স্বাধীনতা, কারণ এবং আবেগ, ব্যথা, আত্মদর্শন, শিক্ষাদান, বন্ধুত্ব, কথা, সময়, ভালো এবং মন্দ, প্রার্থনা, আনন্দ, সৌন্দর্য, ধর্ম, এবং মৃত্যু অনুচ্ছেদে বিভক্ত। তার কবিতা যেনো উঠে এসছে পর্বতের উচ্চতা, সমুদ্রের নাভীমূল, কখনও দেবকণ্ঠ থেকে। কিংবা বলা যায়, অনেকগুলো কবিতা-ফুল দিয়ে গাঁথা মালার মতো। তবে এই বইটি মূলত উপদেশমূলক একটি গ্রন্থ। যেখানে একজন প্রফেট বা প্রেরিত পুরুষ অর্ফালিজ নগরীতে দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন শেষে তার জন্মের দ্বীপে ফিরে যাওয়ার আগে নগরীর মানুষদের বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছিলেন। এই উপদেশগুলোই স্থান পেয়েছে দ্য প্রফেটে। এতে তিনি জীবন ও মৃত্যুর মধ্যস্থিত বিষয় সম্পর্কে সমবেত জ্ঞানার্থীদের উপদেশ দেন এবং এই প্রতিশ্রতি নেন যে, তারা যেনো তা অন্তরে ধারণ ও এর বিনাশ না করে।
প্রত্যেক অনুচ্ছেদে আছে কাব্যিক ঢঙে জীবনের নানা দিকের দার্শনিক উপস্থাপন। আলামিত্রা নামক জনৈক নারীর ভালোবাসা বিষয়ক প্রশ্নের মাধ্যমেই মূলত পুস্তকের শুরু। বইতে জীবরানের নিজের আঁকা ১২ টি চিত্রকর্ম আছে। এজন্যই শেক্সপিয়ার আর লাউজির পরে জিবরানের বই-ই এখন পর্যন্ত সব থেকে বেশি বিক্রিত বই।
দ্য প্রফেট বইটি এতো জনপ্রিয় কেন তা নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। তবে জিবরান আধুনিক মানুষের চিত্তের অসুখের নিরাময় করতে চেয়েছেন এই কাব্য গ্রন্থের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক চিন্তায় সমৃদ্ধ তার জগৎ ভাবনায় মানুষের নানা বিষয়ের সংকটের সমাধান রয়েছে। এসব সমাধান আসলে মানুষ নিজেই খুঁজে নিতে পারে। দ্য প্রফেট পড়ে একজন মানুষ নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে পারবে। এই সাহায্য শুধু আত্মা ও হৃদয় জাগরণে ভূমিকা রাখে। তার চেয়ে বড় কথা এর মধ্যে রয়েছে জীবনের ঘোর বাস্তবতার উপদেশ। যেগুলো একজন মানুষকে জীবনের চলার পথে প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। এরপর শুরু হলো সেই সত্য সন্ধানী প্রশ্নোত্তর পর্ব। মোট ২৭ টি ভাগে এই প্রশ্নোত্তর চলে। প্রথমেই আলমিত্রা জিজ্ঞেস করলেন ভালোবাসা নিয়ে। ডযবহ ষড়াব নবপশড়হং ুড়ঁ, ভড়ষষড়ি যরস, ঃযড়ঁময যরং ধিুং ধৎব যধৎফ ধহফ ংঃববঢ়. অর্থ: ভালোবাসা যখন হাতছানি দেয়-তাকে অনুসরণ করো; জেনে রেখো ভালোবাসার পথ- রুক্ষ কঠিন।।
স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘’অহফ রভ রঃ রং ধ ফবংঢ়ড়ঃ ুড়ঁ ড়িঁষফ ফবঃযৎড়হব, ংবব ভরৎংঃ ঃযধঃ যরং ঃযৎড়হব বৎবপঃবফ রিঃযরহ ুড়ঁ রং ফবংঃৎড়ুবফ.” অর্থ: “তুমি যদি কোনো স্বৈরশাসককে সিংহাসনচ্যুত করতে চাও, তাহলে প্রথমেই দেখ যে তোমার মধ্যে তার সেই সিংহাসনটি ধ্বংস হয়েছে কিনা?” “তোমার স্বাধীনতা যখন তার সকল প্রতিবন্ধকতামুক্ত হয়, তখন তা বৃহত্তর স্বাধীনতার জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।” (অহফ ঃযঁং ুড়ঁৎ ভৎববফড়স যিবহ রঃ ষড়ংবং রঃং ভবঃঃবৎং নবপড়সবং রঃংবষভ ঃযব ভবঃঃবৎ ড়ভ ধ মৎবধঃবৎ ভৎববফড়স.)
একসময় মানুষ গালি দিত ‘সামরিক স্বৈরতন্ত্র’ বলে। জনগণ সে ‘সামরিক স্বৈরতন্ত্র’ উৎখাত করে এলিট শ্রেণির ‘গণতান্ত্রিক’ শাসন চালু করেছে। বড় আশায় বুক বেঁধেছিল এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু তারা আজ বুঝতে পারেন যে ‘সামরিক স্বৈরতন্ত্রের’ সিংহাসন ধ্বংস করে তারা যে ‘গণতান্ত্রিক শাসন’ কায়েম করেছেন, তাদের মনের মধ্যে ‘সামরিক স্বৈরতন্ত্রের’ সেই ‘সিংহাসনটি’ ঘাপটি মেরে বসেছিল। তাই তারা লক্ষ্য করেন যে ‘সামরিক স্বৈরশাসনের’ বদলে দেশে আজ ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরশাসন’ আসন গেড়ে বসেছে। ইতিহাসে বারবার জনগণের বিপ্লব জয়ী হয়েছে। কিন্তু এভাবেই ক্ষমতা নতুন নামে পুরনো স্বৈরশাসকের দখলে চলে গেছে। মোটা দাগে পৃথিবী দুইভাগে বিভক্ত একদল শাসন করে, অন্যদল শাসিত হয়। শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে শাসিত শ্রেণির ক্ষোভ ক্রমশ পুঞ্জিভূত হয়। এক সময় বিপ্লবের মধ্যদিয়ে শাসকশ্রেণির পতন হয় এবং শাসিত শ্রেণির পক্ষে কিছু মানুষ ক্ষমতায় বসে। দেখা যায় তারাও এক সময় পূর্বের শাসক শ্রেণির মতো শোষক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে এবং শোষিত শ্রেণি তাদের বিরুদ্ধে আবার আন্দোলন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে তারাও এক সময় ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং শোষিত শ্রেণির মধ্য থেকে আবার কিছু মানুষ শাসকের মসনদে বসে। এভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। (চলবে)