একজন পলান সরকার যিনি আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন
আখতার হামিদ খান : শুক্রবার দুপুরে ৯৮ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর পলান সরকারের স্ত্রী রাহেলা বেগম (৮৫) মারা যান। তাঁর ছয় ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। ছেলে হায়দার আলী জানান, বার্ধক্যজনিত কারণে কয়েক দিন ধরে তাঁর বাবা শয্যাশায়ী ছিলেন। কাল শনিবার হারুনুর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে পলান সরকারের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তিনি।
নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার একটি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পলান সরকার ২০১১ সালে একুশে পদক পান। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয় ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’ শিরোনামে। এটিই তাঁকে নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদন। ২০০৭ সালে সরকারিভাবে তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেয়া হয়েছে। তাঁকে নিয়ে ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’ নামে শিমুল সরকার একটি নাটক নির্মাণ করেছেন। চ্যানেল আই তা প্রচার করেছে।
বই নিয়ে গ্রামের পথে পলান সরকার। ছবি: প্রথম আলো বই নিয়ে গ্রামের পথে পলান সরকার। ছবি: প্রথম আলো
২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বিশ্বের ভিন্ন ভাষার প্রধান প্রধান দৈনিকে একযোগে পলান সরকারের বই পড়ার এই আন্দোলনের গল্প ছাপা হয়। সারা পৃথিবীর ৪০টি প্রধান দৈনিকে লেখাটি ছাপা হয়। ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম দিবস’ উপলক্ষে প্রথম আলোর প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি দারুণ প্রশংসিত হয়। এই দিবসে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার ক্রোড়পত্র হাতে নিয়ে তোলা সেলফি আসে সারা বিশ্ব থেকে। তবে প্রথম আলোর ক্রোড়পত্রটি হাতে নিয়ে তোলা সেলফির সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। সারা দেশে পলান সরকারকে বহুবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।
পলান সরকারের জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর আসল নাম হারেজ উদ্দিন। তবে পলান সরকার নামেই তাঁকে চেনে দশ গ্রামের মানুষ। জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তাঁর বাবা মারা যান। টাকাপয়সার টানাটানির কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই পড়াশোনায় ইতি টানতে হয় তাঁকে। তবে নিজের চেষ্টাতেই চালিয়ে যান পড়ালেখা। স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন পলান সরকার। তিনি ছিলেন বইপাগল মানুষ। প্রতিবছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে মেধাতালিকায় স্থান পাবে, তাদের তিনি একটি করে বই উপহার দিতেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর বই বিলির অভিযান। এরপরে তিনি সবাইকে বই দিতেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর নিজেই হেঁটে হেঁটে বই বিলি করতেন। একটানা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে করেছেন এই কাজ। রাজশাহী অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামে তিনি গড়ে তুলেছেন বই পড়ার এক অভিনব আন্দোলন। প্রথম আলো তাই তাঁর নাম দেয় ‘আলোর ফেরিওয়ালা’।
শেষের দিকে পলান সরকার বই পড়ার আন্দোলনটাকে শুধু তাঁর পাঠাগারকেন্দ্রিক না রেখে একটু অন্যভাবে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। আগে তিনি শুধু বাড়ি বাড়ি গিয়েই বই দিয়ে আসতেন। পড়া শেষ হলে পুরোনো বইটা নিয়ে নতুনটা দিয়ে আসতেন। কয়েক বছর থেকে তিনি বই বিতরণের জন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি বিকল্প বই বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করেন। এ জন্য কোনো বাজারের বইপ্রেমী কোনো দোকানিকে তিনি বেছে নেন। দোকানমালিক তাঁর দোকানে মালামালের পাশাপাশি পলান সরকারের বইও রাখেন। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন বই নিয়ে যান। পড়া বই তাঁরা নিজেরাই আবার ফেরত দিয়ে নতুন বই নিয়ে যান। মাসে এক-দুবার করে পলান সরকার দূরবর্তী এই কেন্দ্রগুলোতে ছেলের সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে গিয়ে নতুন বই দিয়ে পুরোনো বই নিয়ে আসতেন। একইভাবে অন্য কেন্দ্রে গিয়ে বইগুলো বদলে নিয়ে আসতেন। তবে এই কাজগুলো ছেলে হায়দার আলীকে দিয়েই বেশি করাতেন। এ ছাড়া পাঠাগারে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতেও পলান সরকার বই তুলে দিতেন।
মেয়ে রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার। ছবি: প্রথম আলো মেয়ে রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার। ছবি: প্রথম আলোএ রকম কেন্দ্র রয়েছে, বাঘা উপজেলার খাগড়বাড়িয়া বাজারের শরিফুল ইসলামের ওষুধের দোকান, আড়ানি রেলস্টেশনে আবদুল মজিদের হোমিও চিকিৎসালয়, আড়ানি বাজারের রিয়া কফি হাউস, দিঘা বাজারের আবদুর রহিমের মুদিদোকান ও অমরপুর বাজারের শফিকুল ইসলামের ওষুধের দোকান।
পলান সরকার খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন। কথা বলে মানুষকে হাসাতে পারতেন। কাঁদাতেও পারতেন। তাঁর বই পড়ার আন্দোলন সম্পর্কে ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পলান সরকার বলেছিলেন, ‘আমি হাঁটতে হাঁটতে এই সমাজটাকে বদলানোর আন্দোলনে নেমেছি। যত দিন আমি হাঁটতে পারি, তত দিন আমার আন্দোলন চলবেই। আমি হাঁটতে হাঁটতে মানুষের বাড়িতে বই পৌঁছে দেবই। যাঁরা পাঠাগারে আসবেন, তাঁরা ইচ্ছেমতো বই পড়বেন। তবে আমার বয়স হয়েছে। জানি না আর কত দিন হাঁটতে পারব। যেদিন আমার পথচলা থেমে যাবে, সেদিন এই পাঠাগার আমার পক্ষে আন্দোলন করে যাবে।’