বস্তি উচ্ছেদ ও বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন
ড. মো. নূরুল আমিন : বস্তি উচ্ছেদকে নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহর নগরগুলোতে প্রায়শই ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে নাগরিক জীবনে বিড়ম্বনা যেমন বাড়ছে তেমনি সরকারের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। দেখা যাচ্ছে যে, কিছু লোক রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সরকারি জমিতে বস্তি তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছে। আবার কয়েক বছর পর পুরাতন ভাড়াটিয়া তুলে দিয়ে নতুন ভাড়াটিয়া পাবার আশায় অথবা সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জমি খালি করার উদ্দেশ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে। এই অভিযান কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার জন্য রাজনৈতিক আশির্বাদপুষ্ট এক শ্রেণির সমাজ বিরোধী লোক বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। এতে আগুনে পুড়ে বহু নিরীহ লোক মারা যাচ্ছে এবং তাদের সহায়সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এই ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আর পুনর্বাসন হচ্ছে না।
বস্তি হচ্ছে আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলভাবে গড়ে উঠা পাঁচ বা ততোধিক পরিবারের একটি আবাসনস্থল যাকে ঝুপড়ি, টং, টিনশেড, ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় আধাপাকা ঘর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এসব বস্তিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। সরকারি ও আধা-সরকারি সংস্থার মালিকানাধীন অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি, পরিত্যক্ত ভবন, পাহাড় বা টিলার ঢাল, রাস্তার ধার অথবা রেল লাইনের পাশে এগুলো গড়ে উঠে। এসব স্থানে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং রাস্তাঘাটের সুযোগ সুবিধা অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। এসব বস্তিবাসীদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং তারা অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিক কর্মচারী হিসেবে কর্মরত অথবা স্বনিয়োজিত।
বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালনায় আরবান প্রাইমারী হেলথ্ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারী প্রজেক্ট শীর্ষক একটি প্রকল্পের অধীনে ২০১৫-১৬ সালে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার বস্তিসমূহের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার উপর একটি শুমারীর কাজ সম্পাদন করা হয়। এতে প্রায় ২২ লাখ বস্তিবাসী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই শুমারী অনুযায়ী বস্তিগুলোর পরিবার পিছু সদস্য সংখ্যা ছিল ৩.৮ জন। এর বাসিন্দাদের ৩১.৮% এর বয়স ১৫ বছরের নিচে এবং ২.৬% এর বয়স ৬৫ বছরের উপরে। ৮২.৩% পরিবারের প্রধান পুরুষ এবং ৯১% বস্তি সরকারি জমির উপর গড়ে উঠেছে এবং ভাড়াটিয়ার সংখ্যা হচ্ছে ৬৭.৯%। বাকিরা বিভিন্ন দলের (বেশির ভাগ শাসক দলের) নেতাকর্মী বা আশির্বাদ পুষ্ট। বস্তিবাসী পরিবারগুলোর ৮১.৬% একটি শয়নকক্ষ বিশিষ্ট ঘরে থাকে। এই ঘরগুলোর ছাদ টিনের এবং মেঝে পাকা। এদের মধ্যে প্রায় ৯৫% পাইপ বাহিত খাবার পানি ব্যবহার করে। ৯০% পরিবার ভাগাভাগি করে লেট্রিন ব্যবহার করেন। বস্তি ঘরগুলোর ৯৯.৬% ঘরের বিদ্যুৎ সংযোগ আছে এবং ৫০ শতাংশেরও বেশি পরিবার রান্না-বান্নার কাজে পাইপবাহিত গ্যাস ব্যবহার করে।
জাতিসংঘের এক প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি ৫০ লক্ষ হবে। এই সংখ্যা ২০১৪ সালে ছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ। এর পাশাপাশি শহরের জনসংখ্যাও ৫ কোটি থেকে ৮ কোটি ৩০ লাখে উন্নীত হবে। মোট বস্তির সংখ্যা দাঁড়াবে ১৩,৯৩৮টিতে এর বিভাজন হবে, ঢাকা বিভাগ ৩৩.৬২%, এর মধ্যে ১১.৮০% হবে ঢাকা দক্ষিণে, ১২.৫৯% উত্তরে এবং ৯.২৩% গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে। শুমারী অনুযায়ী উপরোক্ত তিনটি সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ২২,২৭,৭৫৪ জন লোক বস্তিতে বসবাস করেন। এর মধ্যে ১১,৮৫,৮৭৫ জন বড় বড় বস্তিতে (যেখানে ১০০ বা ততোধিক পরিবার) বসবাস করেন।
বস্তিবাসীদের মধ্যে ৩৬.২% পুরুস ও ৬২.৩% মহিলা বাসিন্দা কোনও স্কুলে লেখাপড়া করেনি। এদের মধ্যে ৮ বা ততোধিক বয়সী ছেলেদের ৭৩.৫% কোন না কোন আয় উপার্জনের সাথে জড়িত; একইভাবে ৩৯.৬% মেয়েও বিভিন্ন স্থানে কাজ করে। এদের ৯৬% পরিবারের বৈদ্যুতিক পাখা আছে, ৬০% পরিবারের খাট ও টেলিভিশন আছে, ৮৫% লোকের মোবাইল ফোন আছে। এদের ৮৫% লোক কাজের সন্ধানে পল্লী এলাকা থেকে শহরে এসেছেন।
শুমারীতে প্রাপ্ত তথ্যগুলি আমি উল্লেখ করলাম এ জন্য যে বস্তিসমূহের উদ্ভব ও বিকাশ আমাদের দেশে গোপন কোনও বিষয় নয়। যারা সরকারি বা আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা কিংবা বেসরকারি জমিতে বস্তি গড়ে তুলেছেন তারা তা গোপনে গড়ে তোলেননি, সংস্থাগুলোর সম্মতিতেই তা করেছেন বলে মনে হয়। এই জায়গাতে, ঘর তৈরি, ভিটি পাকা করণ, বৈদ্যুতিক সংযোগ প্রদান, গ্যাস পাইপ লাইন আনা, পানি ও পয়ঃসংযোগ প্রদান এর কোনটিই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়। ঢাকা শহর অথবা অন্যান্য শহরের বাসা বাড়িতে কাজের লোকের সরবরাহ এসব বস্তি থেকেই আসে, হকার, দোকানদার বা দোকান কর্মচারি, গার্মেন্ট শ্রমিক, রিকসাওয়ালা, ভ্যান চালকÑ এর বেশির ভাগই বস্তিতে বসবাস করেন। কেননা এখানে ভাড়া কম। এখন তো মিটিং প্রসেশন কম, যখন ছিল তখন এই বস্তিগুলোই রাজনৈতিক দলগুলোকে লোক সরবরাহ করেছে। মোদ্দা কথা আধুনিক নগর জীবনে বস্তির ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। সরকার বস্তিবাসীদের জন্য ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির একটি কর্মসূচি বা প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন কিন্তু তার লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। বস্তিগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বলা কঠিন। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বস্তিবাসীদের অবদান অসামান্য। বস্তি উচ্ছেদের নামে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তাদের পথের কাঙ্গালে পরিণত করা মানুষের কাজ হতে পারে না।
বস্তিবাসীরা বিত্তহীন ও নিম্নবিত্তের লোক। তাদের প্রতি সরকারের একটা দায় আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। বিত্তহীন অসহায় লোকদের জন্য সরকার অনেক কিছু করতে পারেন। এখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও বহু শিশু কিশোর রয়েছে। গত কয়েক মাসে আগুনে বেশ কিছু বস্তি পুড়ে যেমন ছাই হয়েছে তেমনি বস্তিবাসীরাও স্বজনহারা হয়েছেন এবং সহায় সম্পদ হারিয়েছেন। এগুলো প্রতি বছরই ঘটছে। এর প্রতিকার দরকার। সরকারের একটি ঝধভবঃু ঘবঃ চৎড়মৎধসসব একটি আছে। এই প্রোগ্রামের আওতায় বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য কিছু উৎপাদনশীল প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে। রাস্তায় থাকা লোকের সংখ্যা বাড়ছে এবং আরো বাড়বে। আমাদের দেশে বর্তমানে বহু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে যেগুলো শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই টহঢ়ৎড়ফঁপঃরাব অর্থনীতির উপর অনুৎপাদনশীল প্রকল্পের প্রভাব ভাল হয় না। এ সব খাতে নতুন প্রকল্প বন্ধ করে অথবা কমিয়ে দিয়ে বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের জন্য নতুন প্রকল্প গ্রহণ অপরিহার্য বলে আমি মনে করি। অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে।