মুসলিম সাহিত্য-সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মির্জা মোহাম্মদ ইউসফ আলী

সরদার আবদুর রহমান:
একটি সমাজ পরিশীলিত হয় পরিশীলিত মানুষদের গুনে। সময়ে সময়ে এমন মানুষদের আগমন না ঘটলে মানুষেরই সমাজ নানা ব্যাধি ও বিপন্নতার শিকার হয়। রাজশাহী জনপদেও এধরণের কৃতী পুরুষদের উপস্থিতি এখানকার সমাজ-সংস্কৃতিকে সুস্থ রাখতে সহায়ক হয়েছে। এমন একজন কৃতী মানুষের নাম মির্জা মোহাম্মদ ইউসফ আলী। যিনি রাজশাহীর মাটি ও মানুষের জন্য অকৃত্রিম দরদ নিয়ে শুধু কলমেই নয়, নানা সংগঠন-সংস্থার মাধ্যমেও দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছিলেন। বিখ্যাত দার্শনিক হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহ:)-র সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিমিয়ায়ে সা’দাত’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করে মির্জা মোহাম্মদ ইউসফ আলী নিজেও খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়াও পত্রিকা প্রকাশ, শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি জনসাধারণের প্রতি তাঁর দরদ ও দায়িত্ববোধের প্রকাশ ঘটান। রাজশাহীর নুর অল ইমান সমাজ এবং নুর অল ইমান পত্রিকা তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম সাহিত্য-সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে মির্জা মোহাম্মদ ইউসফ আলী বাংলাদেশে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিা লাভ করেন।
জন্ম ও পূর্বপুরুষ
রাজশাহীর প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক শিক্ষানুরাগী লেখক এবং ইসলামী পুনর্জাগরণের অগ্রদূত মির্জা মোহাম্মদ ইউসফ আলীর জন্ম বৃত্তান্ত বিষয়ে খুব বিষদে জানা যায় না। তবে যতদূর জানা যায়, তিনি ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর থানার আলীয়াবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মির্জা মশিয়তুল্লাহ ছিলেন রেশম ব্যবসায়ী। মাতা খোজেস্তা বানু গৃহিনী। তিনি পিতা-মাতার প্রথম সন্তান। তাঁর পিতা সেকালের রেওয়াজ মতো আরবি-ফার্সি শিখেছিলেন এবং বাংলাও জানতেন। পরে তিনি রেশম ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু সকল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মতই তাঁর শেষ জীবনে অর্থ কষ্ট ছিল এবং তিনি তৎকালীন পুঠিয়ার জমিদার সেরেস্তায় ঋণীও হয়ে পড়েন। পারিবারিক এই অর্থকষ্টের মধ্যেও ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও মনোবলের কারণে পিতার গুনী পুত্র মির্জা ইউসফ আলী নিজের চেষ্টায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন এবং একজন সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব হিসেবে রাজশাহী তথা বঙ্গের সমাজ-জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। মির্জা মোহাম্মদ ইউসফ পরবর্তীকালে রাজশাহী শহরের হাতেম খান মহল্লার বাসিন্দা হন। মির্জা ইউসফের পূর্ব পুরুষ মির্জা মোহাম্মদ আযম ছিলেন ইরানের ইসপাহান নগরের অধিবাসী। মোহাম্মদ আযম ভাগ্যান্বেষণে ভারতের দিল্লীতে আসেন এবং স্বীয় কর্মগুনে রাজ দরবারে স্থান লাভ করেন। আযমের পৌত্র বরখোরদার এবং পুত্র মির্জা আলী কুলি বেগ সুবাদারী লাভ করে বাংলায় আসেন। আলী কুলি তৎকালীন ঘোড়াঘাট অঞ্চলের কাজী পদে নিযুক্ত হন। মির্জা ইউসফ আলী কুলী বেগের (পারস্য সম্রাট সেনাপতি আলী কুলী বেগ নন) পরবর্তী বংশধর।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
মির্জা ইউসফ প্রাথমিক শিক্ষা নিজ এলাকায় শেষ করে রাজশাহী শহরের তৎকালীন নরম্যাল স্কুলে ভর্তি হন এবং স্কুলের ত্রিবার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এসময় তিনি রাজশাহী ত্যাগ করে কুচবিহারে চলে যান। সেখানে একটি বাংলা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অপূর্ণতা তাঁকে সবসময় পীড়া দিতো। ফলে শিক্ষকতার অবসরে স্বীয় চেষ্টায় ইংরেজি শিক্ষার জন্য সচেষ্ট হন। পরে রাজশাহী শহরে ফিরে এসে রাজশাহী লোকনাথ মধ্য ইংরেজি বাংলা স্কুলে (সে সময়ে স্কুলটি এই নামে পরিচিত ছিল, বর্তমানে লোকনাথ উচ্চবিদ্যালয়) শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরে যান এবং ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি পর্যন্ত রংপুরের নর্ম্যাল স্কুলের শিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তিনি নিজ প্রচেষ্টায় ইংরেজি, উর্দূ, আরবি ও ফারসি ভাষায় বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হন। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজশাহী সরদহ নিবাসী খাতেমন নেছাকে বিবাহ করেন। এক বছরের মধ্য এই স্ত্রী পরলোকগমন করলে তিনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন বাগমারার সৈয়দুন নেসাকে। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাব রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পান। এই পদে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পঁচিশ বছর দায়িত্ব পালন শেষে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকুরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন। তিনি এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে পরিচিত হন।
সাংবাদিকতা
শিক্ষকতায় থাকাকালীন প্রতিষ্ঠা করেন নুর-আল-ইমরান সমাজ (১৮৮৪) এবং আঞ্জুমানে হেমায়েত ইসলাম (১৮৯১)। তিনি ছিলেন এ দুটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। নিছক ব্যবসামাত্র নয়- কেবল সমাজের উন্নতি ও ভাল কাজের প্রচারের স্বার্থে মির্জা ইউসফ প্রেস ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এই সঙ্গে ‘মুসলিম শিক্ষা সমবায়’ নামে একটি চতুর্মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তবে এটি বেশিদিন টেকেনি। এই পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে একজন জীবনীকার লেখেন, ‘শিক্ষা সমবায়ের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ ও বিভিন্নমুখি। শুধু শিক্ষা বিস্তারই নয়, সকলকে সমাজসচেতন করে তোলা, ধনী সুদি মহাজনদের কবল থেকে গরীবদের রক্ষা করা, গ্রাম্য তহবিল থেকে গরীব কৃষককে সাহায্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা ইত্যাদি কাজগুলো ‘শিক্ষা সমবায়’ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতো।’ ‘নুর অল ইমান’ পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল বহুমুখি। তবে প্রধানত ছিল এর মাধ্যমে সমাজকে সচেতন করা। সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, দেওয়ান নাসিরউদ্দীন প্রমুখ লেখক এতে লিখতেন। তাঁর মৃত্যূর পর এই প্রকাশনাকেন্দ্রিক পত্রিকা ‘পল্লীবান্ধব’ ১৯২৯ সাল থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকার আদর্শ ছিল মূলত সমাজ উন্নয়ন।
সমাজসেবায় আত্মনিবেদন
মির্জা ইউসফ ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে পূর্ণাঙ্গভাবে জ্ঞান অর্জন, সাহিত্য চর্চা ও সমাজসেবায় মনোনিবেশ করেন। মির্জা ইউসফ ১৯১৮ সালে রাজশাহী জেলা মুসলিম শিক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি, ফার্সি প্রভৃতি ভাষা রপ্ত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলাম শুধু ধর্মমাত্র নয়, কাজের মাধ্যমে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ ফুটিয়ে তুলতে হবে। সে অনুযায়ী তিনি কর্মের মাধ্যমে ইসলামের মূল্যবোধ সমাজে বিস্তৃত করতে এবং অনগ্রসর মুসলমানদেরকে তাদের অতীত গৌরবে ফিরিয়ে নিতে তাঁর যোগ্যতা কাজে লাগান। তিনি কুসংস্কার দূর করা, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মুসলমানদের উৎসাহিত করা, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করা প্রভৃতি বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী কলেজে ফুলার হোস্টেল নির্মাণ, নওগাঁর মুসলিম হোস্টেল নির্মাণ প্রভৃতি কাজে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এভাবে আমৃত্যূ তিনি জনসেবার কাজ করে গেছেন। তিনি বাংলার গ্রামে-গঞ্জে সমবায় সমিতি স্থাপন করে শিক্ষা ও উন্নয়ন কাজের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এভাবে তিনি বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে শতাধিক সমিতি গঠন করেন।
গ্রন্থ রচনা
মির্জা ইউসফের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ইমাম গাজ্জালির বিখ্যাত কিমিয়ায়ে সা’দত গ্রন্থের অনুবাদ। ‘সৌভাগ্যের স্পর্শমনি’ নামে পাঁচ খণ্ডে তা ছাপা হয়। ১৮৯৫ থেকে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এগুলো প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি আরবি ও ফার্সি উভয় ভাষাতেই লেখা হয়েছিল। মির্জা ইউসফের বাংলা অনুবাদ বাংলার মুসলমান সমাজের নিকট বিপুলভাবে সমাদৃত হয়।
খণ্ড গুলোর নাম ছিল পৃথক পৃথক। এগুলো হলো : প্রথম খণ্ড- দর্শন পুস্তক, দ্বিতীয় খণ্ড- এবাদত পুস্তক, তৃতীয় খণ্ড- ব্যবহার পুস্তক, চতুর্থ খণ্ড - বিনাশন পুস্তক এবং পঞ্চম খণ্ড - পরিত্রাণ পুস্তক। মির্জা ইউসফ আলি যে একজন উঁচু মানের দর্শন বিশেষজ্ঞ ছিলেন- এই অনুবাদগ্রন্থ তার উদাহরণ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে ছিল ‘দুগ্ধ সরোবর’ ও ‘ইসলামতত্ত্ব’।
ইন্তিকাল
মানুষ হিসেবে মির্জা ইউসফ আলি ছিলেন অত্যন্ত সহজ, সরল, ন্যায়নিষ্ঠ, উদারচিত্ত, ধর্ম ও কর্মপরায়ণ ব্যক্তি। তিনি বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতা পছন্দ করতেন না। অক্লান্ত কর্মী ও সাহিত্যসেবী এই মানুষটি ১৯২০ সালের ৩০ মে রোববার পরলোকগমন করেন।
তাঁর ইন্তিকালে বঙ্গনূর পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় : ‘কিমিয়ায়ে সা’দতের অনুবাদক, বঙ্গভাষার একনিষ্ঠ সাধক, রাজশাহী শিক্ষা সমিতি ও নুরল ইমান সমিতির সুযোগ্য কর্ণধার মির্জা মোহাম্মদ ইউসফ আলি সাহেব আর ইহজগতে নাই। গত ১৬ই জ্যৈষ্ঠ রবিবার অপরাহ্ন ৩টা ১৫ মিনিটের সময় তাহার মির্জাবাগ ভিলায় নশ্বর দেহত্যাগ করিয়া অনন্তধামে প্রস্থান করিয়াছেন।’