শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ঢাকার ভাষা

আখতার হামিদ খান : ঢাকার ভাষা-বিচারে কালক্রমের দিকটি বিবেচনায় রাখলে দেখা যাবে, পাল-সেন শাসনামলে আজকের ঢাকার চেয়ে বিক্রমপুরের (মুন্সিগঞ্জ) গুরুত্ব বেশি ছিল। প্রান্তবাসী বা কেন্দ্র থেকে দূরবাসী হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষেরা বসবাস করেছে। কৃষিনির্ভর শ্লথ জীবনযাত্রায় প্রাত্যহিক ব্যবহারে তাদের অবলম্বন ছিল বাংলা ভাষার পুরাতন কথ্যরূপ। বাংলা ভাষার প্রতি শাসকদের আগ্রহ বা সুদৃষ্টি না থাকায় অবহেলিত জনপদের ভাষা হিসেবে চর্চিত হয়েছে বাংলা। এভাষা মূলত অর্ধতৎসম, তদ্ভব আর দেশি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ইউরোপীয় বা আরবি-ফারসি শব্দ এ ভাষায় ছিল না বললেই চলে। উচ্চারণে নাসিক্য ধ্বনি, বিশেষ করে চন্দ্রবিন্দু বর্জিত সরল ভাষার ব্যবহারই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল। শিক্ষায়তনিক বা এ জাতীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এ সময় না থাকায় বাংলা মূলত মৌখিক ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং সে সূত্রেই এর সামান্য পরিবর্তন আবর্তন হয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীতে নদীয়া তুর্কিদের অধিকারে যাবার পর তাদের মৌখিক ভাষা তুর্কির বিস্তার ঢাকা পর্যন্ত আসেই নি। রাজভাষা পারসির প্রভাবও ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছতে বেশ সময় নিয়েছে। রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে ঢাকায় মোগলদের আগমন এবং ঢাকা রাজধানী হওয়ার পর শাসন-কেন্দ্রিক নানা কাজে এ অঞ্চলে বাংলার সঙ্গে পারসি ভাষার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। আরবি আসে রাজধানী হওয়ার পর শাসন-কেন্দ্রিক নানা কাজে এ অঞ্চলে বাংলার সঙ্গে পারসি ভাষার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। আরবি আসে মূলত পারসি ভাষার মধ্য দিয়ে। আর ধর্মের ভাষা হিসেবে মুসলিম জনসাধারণ প্রাত্যহিক প্রয়োজনে আরবি-পারসি শব্দের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। বাঙালি হিন্দুরা তখন বিভক্ত মূলত নানা গোত্র ও পেশার ভিত্তিতে। হিন্দুদের একটি অংশ প্রশাসন-সংশ্লিষ্ট নানা কাজে জড়িয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে পারসি শব্দে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।

মোগল শাসনামলে ঢাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উর্দুভাষী বাঙালির আগমন ঘটে। ভারত থেকে এদের আনা হয় মূলত মোঘল-প্রতিষ্ঠাসমূহের শাসন ও শাসকদের ব্যক্তিগত কাজকর্মে সহায়তা করার জন্য। ‘আতরাফ’ বাঙালি মুসলমানদের উপর ‘আশরাফ’ শাসকশ্রেণীর ভরসা ছিল না। এই বিশাল সংখ্য অবাঙালি জনগোষ্ঠীর ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি ঘটতে থাকে ঢাকায়। প্রশাসনের কাছাকাছি থাকার কারণে অথবা প্রশাসকগণ তাদের মতোই বহির্বঙ্গীয়- এই সব কারণে তারাও নিজেদের আশরাফ মনে করতেন এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রভাবও ছিল ব্যাপক। এই প্রভাব বাঙালির ভাষাতেও পড়ে। তাদের ভাষার আরবি-পারসি শব্দ এ অঞ্চলের ব্যাপক সংখ্যক বাঙালি মুসলমানের কাছে ‘নিজেদের’ শব্দ হিসেবে সমাদর লাভ করে। কালক্রমে মোগল শাসনের সমাপ্তি ঘটেছে; এ অঞ্চল থেকে অবাঙালি মুসলিম শাসক ও নবাবরাও ফিরে গেছেন নিজেদের গেশে। কিন্তু যে ব্যাপক সংখ্যক উর্দুভাষী সহযোগী তারা নিয়ে এসেছিলেন, পরবর্তীকালে তাদের বংশবৃদ্ধি ও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটায়, তারা থেকে গেছেন এই ঢাকাতেই। এখনো পারতপক্ষে বাঙালিদের সঙ্গে এরা বৈবাহিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলেন। আজো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উর্দুতে কথা বলেন এরা, বাইরে বলেন বাংলাতে। এদের কথাতেও ধীরে ধীরে বাংলা প্রবিষ্ট হচ্ছে। যেমন: 

‘বগল মে লড়কা/ শহের মে ঢনডেরা।’

‘সাপসে খেলতি/ বেঙসেস ডরাতি।’

‘শাওয়ান কা ঝড়ি/ আওয়ান আওর যাওয়ান/

আষাঢ় কা ঝড়ি/ পসারকে আওয়ান।’

এই ভাষাতে সাপ, ব্যাঙ অথবা বঙ্গীয় সনের আষাঢ়, শ্রাবণ মাসের নাম সুন্দরভাবে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। মোগল-পরবর্তী ইংরেজ শাসনামলেও ঢাকায় নবাবদের অবস্থান ছিল। সে-সূত্রে নবাববাড়ি এবং তাদের নানা পর্যায়ের কর্মচারীদের কেন্দ্র করে উর্দু-বাংলা মিশ্রিত ভাষারীতি দীর্ঘদিন টিকে ছিল। ঊনিশ শত সাতচল্লিশ উত্তরকালে ঢাকার মিরপুর ও মোহম্মদপুর অঞ্চলে ভারত থেকে আগত উল্লেখযোগ্যা সংখ্যক অবাঙালি উর্দুভাষী বসতি স্থাপন করেন। তাদের বসতি স্থাপনের অর্ধশতাব্দী অতিক্রম হয়েছে মাত্র। এরই মধ্যে তাদের নবপ্রজন্মের মুখে বাংলা বুলি উঠে গেছে, সামান্যই অবশিষ্ট আছে উর্দুর ভগ্নাংশ।

ঢাকায় কুট্টি ও সুব্বাসি বলে দুটো সম্প্রদায় আছে। এরা এ অঞ্চলের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর উত্তর-প্রজন্ম। তবে কালক্রমে এদের ভাষায় পৃথক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়েছে। ‘কুট্টি’ কথাটি এসেছে ‘কুঠি’ থেকে। মূল শহরের সামান্য বাইরে শহরতলির কুঠিতে বসবাসকারী; কিছুটা কৃষি ও শ্রমনির্ভর এরা। ঘোড়ার গাড়ির গারোয়ানগিরি, বিভিন্ন কাজের মিস্ত্রি, ঠেলা বা রিক্সাচালনা করে এরা অর্থ উপার্জন করেন। ঢাকায় জনসংখ্যার বৃদ্ধির আগে এরা এ অঞ্চলে কৃষি কাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর সুব্বাসিদের সম্পর্কে অনেকে বলেছেন: ‘সুখবাসী’ শব্দ থেকে সংক্ষিপ্ত ‘সুব্বাসী’। এরা নাকি খুব সুখে ছিলেন। (নীলিমা ইব্রাহিম: ঢাকাই রসিকতা: সাহিত্য পত্রিকা: ১ম সংখ্যা ১৩৮০: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি, ‘সুখবাসী’ থেকে ‘সুব্বাসী’ নয়, ‘সুবাবাসী’ থেকে ‘সুব্বাসী > সুব্বাসি’ হয়েছে। সুবা অর্থ রাজ্য বা কেন্দ্র-শহর। সুবা ও কুঠি দুটো শব্দই হিন্দি ও উর্দু ভাষায় ব্যবহার হয়। কুট্টিয়া যেমন শহরতলিতে বাস করতেন, তেমনি সুব্বাসিরা শহর-কেন্দ্রে বাস করতেন এবং নানা ধরনের ব্যবসা ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। ব্যবসায় নগদ লাভের কারণে স্বাভাবিকভাবে স্বচ্ছলতা তাদের ছিল। ধোলাইখালের উভয় তীর; নারিন্দা, সুরিটোলা, রায়সাহেব বাজার, গোয়ালঘাট, কলতা বাজার, আগামসিহ লেন ইত্যাদি স্থানে ব্যাপক বাস ছিল কুট্টিদের। আর সুব্বাসিদের বাস ছিল মূলত ইসলামপুর, বেগমবাজার, চকবাজার, বাবুবাজার, উর্দু রোড ইত্যাদি বাণিজ্যিক এলাকায়। কুট্টি ও সুব্বাসিরা একে অন্য পক্ষকে ঈর্ষা ও হেয়জ্ঞান করতেন। তবে দুটি ক্ষেত্রে এদের বেশ মিল ছিল: প্রথমটি, এরা উভয়ে পক্ষ মনে করতেন, নিজেরা বাদশা-আমির-ওমরাহ-নবাবদের বংশধর বা অধস্তনপুরুষ। দ্বিতীয় মিল হল: এই উভয় পক্ষ এখন মূলত বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তবে, এদের বাংলা ভাষা শব্দব্যবহার ও উচ্চারণ-স্বাতন্ত্রের জন্য আজও বিশিষ্ট। এর কতিপয় বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যেতে পারে:

ক) ‘চ’ বর্গীয় ধ্বনি এবং আরো কিছু ধ্বনির (যেমন: য) ঘৃষ্ট উচ্চারণ: মান বাংলায় যদি বলা হয়: ‘চাচা, চা খেয়ে আমার সঙ্গে যাবেন নাকি?’ এই বাক্যটি তারা বলবে ‘চ’ ও ‘য’-এর ঘৃষ্ট উচ্চারণ দিয়ে এবং কিছু শব্দের ধ্বনি পরিবর্তনের মাধ্যমে এভাবে: ‘চাচা চা খাইয়া আমার লগে জাইবেন নিকি?’

খ) দ্বিত্ব ধ্বনি ব্যবহার: তাদের ভাষারীতিতে শব্দ কোনো কোনো ধ্বনির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়: যেমন, ‘বাজার থন কী কিন্ছস্? কল্লা আর কদ্দু?’ (এখানে ‘ল’ ‘দ’ এর দ্বিতীয় উচ্চারণ হয়েছে।)

গ) উর্দু-হিন্দি অব্যয়ের প্রভাব: উর্দু ও হিন্দি ভাষার প্রভাবে এই ভাষায় ‘মগর’ ‘ভি > বি’ ইত্যাদি অব্যয়ের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া অনন্বয়ী অব্যয় হিসেবে ‘আবে’ এর ব্যবহার এই ভাষায় যত্রতত্র দেখা যায়। যেমন: ‘আবে জলিল্লা, হইল কী? আমি বি হুনলাম ছব (সব) ঠিক আছে, মগর জাইয়া দেহি কিচছু নাই।’ এই বাক্যে উর্দু-হিন্দি ভাষার অব্যয় স্বত:স্ফূর্তভাবে ব্যবহার হয়েছে।

ঘ) ‘শালা’ শব্দের নির্দোষ প্রয়োগ: বাংলা ভাষার সাধারণ প্রয়োগে ‘শালা’ প্রায়শ গালি হিসেবে ব্যবহার হলেও কুট্টি ও সুব্বাসিদের ভাষায় শালা > হালা শব্দটির নির্দোষ প্রয়োগ দেখা যায়। তাই, বাবা, মা, শিক্ষক, গাছ, গরু, ছাগল সর্বত্র তারা নির্দোষভাবে শালা > হালা, শালায় > হালায় শব্দ ব্যবহার করেন। যেমন: ’আইজকা ছার (স্যার) হালায় আমারে খুব আদর করছে।’ ‘গারি (গাড়ি) থুইয়া গরু বি হালায় দৌর (দৌড়) মারছে।’

ঙ) ই বা উ-ধ্বনির আগমন: ঢাকাইয়াদের উচ্চারণে ই বা উ-ধ্বনির আগমন অর্থাৎ অপিনিহিতির প্রভাব অধিকমাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ‘রাজত্বি পাইছ?’ ‘আইজ আর থাউক্কা, গুমা। আবার কাইলা ছুরু করিছ।’ 

অবশ্য বৃহৎ বঙ্গের পূর্ব অংশের মানুষের উচ্চারণে অপিনিহিতির প্রভাব এমনিতেই বেশি।

চ) তাড়ন ও মহাপ্রাণ-ঘোষ ধ্বনিহীনতা: এই ভাষায় মহাপ্রাণ-ঘোষ ধ্বনিগুলো যেমন: ঘ, ঝ, ঢ, ধ, ভ উচ্চারণ যথাযথভাবে হয় না। এর বদলে ধ্বনিগুলো অল্পপ্রাণ- ঘোষ হয়ে যায়। যেমন: আঘাত > আগাত; ঝড় > জর; ঢাক >ডাক; ধান > দান; ভাত > বাত।

কুট্টি-সুব্বাসিরা মূলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ঢাকার পুরোনো বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বেশ কিছু মানুষ একত্রে বাস করেন। এরা পুরোনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও (এখনো তাদের খ্যাত অনেকের নামে পুরোনো ঢাকার বেশ কিছু রাস্তার নামকরণ করা আছে।) লক্ষ্মীবাজার ও শাঁখারিবাজারে অদ্যাবধি তারা পূর্বের ন্যায় বসবাস করছে। এরা পেশায় মূলত ব্যবসায়ী। ভাষা-ব্যবহারের ক্ষেত্রে কুট্টি বা সুব্বাসিদের চেয়ে তাদের পৃথকতা স্পষ্ট বোঝা যায়। যেমন: তাদের কথায় ‘মগর’ ‘আবে’ ‘বি’ ইত্যাদি উর্দু-হিন্দি অব্যয় নেই। কথায় কথায় নির্দোষ ‘শালা’ শব্দের ব্যবহারও তাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। তবে অপিনিহিতির আগমন এবং তাড়ন ও মহাপ্রাণ-ঘোষ ধ্বনির বর্জনের ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কুট্টি-সুব্বাসিদের মিল আছে। ধর্মীয় কারণে তাদের প্রাত্যহিক ব্যবহারে আরবি-পারসি শব্দের চেয়ে সংস্কৃতঘেঁষা শব্দের ব্যবহার বেশি দেখা যায়।

ইংরেজ শাসনামলে ঢাকার ভাষায় যে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে, তা হল বিভিন্ন ধর্ম ও পেশার মানুষের মধ্যে যোগাযোগ সংস্থাপনের ফলে বাংলা ভাষার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সাধন। ভারত থেকে ইংরেজদের শাসন উঠে যাবার আগ পর্যন্ত ঢাকায় নবাব ও তাদের পরিবারবর্গের অল্প-বিস্তর প্রভাব ছিল। কিন্তু তারপরও, যেহেতু পাশ্চাত্যধারার স্কুল-কলেজ আগেই ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রশাসনে ইংরেজির কদর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আলিগড় আন্দোলনের প্রভাবে মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশের চিন্তারও পরিবর্তন ঘটেছে, সেহেতু এর সমন্বিত অভিঘাতে ঢাকার বাংলা ভাষায় একটা পরিবর্তন দেখা দেয়। এসময় ঢাকার ভাষায় বহু সংখ্যক পাশ্চাত্য, বিশেষত ইংরেজি শব্দের প্রবেশ ঘটে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির কারণে ঢাকার সঙ্গে দেশের জন্য অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হয় এবং এ-সূত্রে ঢাকার জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে কুট্টি বা সুব্বাসিরা কেন্দ্র-ঢাকার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে থাকে। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ-পরবর্তীকাল থেকে এধারা ব্যাপকতা লাভ করে। যে কারণে ঢাকা শহরে দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সমন্বয়ে একটি বিশেষ মৌখিক ভাষারীতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। ঢাকার অফিস-আদালতে ভাষার আঞ্চলিক রূপটিই খানিকটা পরিমার্জিত হয়ে ব্যবহার হয়। এই ভাষারূপটি বিশেষভাবে কর্ণগোচর হয় এর ক্রিয়ারূপের দিক থেকে। যেমন: ‘যাচ্ছি’র বদলে এই ভাষারীতিতে ব্যবহার হয় ‘যাইতেছি’; ‘খাচ্ছি’; ‘খাচ্ছি’র বদলে ‘খাইতেছি’; ‘করবো’র বদলে ‘করমু’ ইত্যাদি। লেখার ক্ষেত্রে সংস্কৃতঘেঁষা সাধুরীতি এ সময় ঢাকার বাংলা ভাষাতে আদরণীয় হয়। এর একটি কারণ বোধ হয় এই যে, ‘পাঠান রাজত্বের শেষে একটি সাহিত্যিক বাংলা সাধুভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়।’ (মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্: বাংলাদেশী বাংলার আদর্শ বানান অভিধান: ভূমিকা) এবং এই ভাষারীতিতে বাংলায় গ্রন্থসমূহ রচিত হতে থাকে। ঢাকার লিখিত গদ্যেও এই ধারা অনুসৃত হতে দেখা যায়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং শহিদদের রক্তদান ঢাকার বাংলা ভাষায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এসময় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তো বটেই, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাংলা ভাষা বলার ও লেখার ক্ষেত্রে ‘বিশুদ্ধতার’ প্রশ্নটি মাথায় রাখা হয়। ওই নিরিখেই ঢাকায় প্রচলিত আঞ্চলিকতামিশ্রিত বিশেষ ভাষারূপটি বক্তার সচেতন প্রয়োগে পরিশীলন লাভ করে। প্রচার-মাধ্যম ও অনুষ্ঠানাদিতে বাংলা ব্যবহারে খুবই যত্নবান দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে তারা আজকের কুষ্টিয়া এবং শান্তিপুর-নদীয়ার ভাষাকে মূলত অনুসরণ করেন। ওই সময় ঢাকায় যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়, তাদের ঘরে প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহারের একটি চেষ্টা পরিদৃষ্ট হতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোর কোনো কোনো অধ্যাপক, যারা চেষ্টা করেও নিজের ভাষা থেকে আঞ্চলিকতা পরিহার করতে পারেন নি, তাঁদের অনেকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন নির্দ্বিধায়। তবু মিশেল ভাষার পক্ষে ‘ওকালতি’ করেন নি। এ সময় বাংলা ভাষার প্রমিতকরণের জন্য ইংরেজি শব্দাবলি পরিহারের চেষ্টা চলে সচেতনভাবে। বাংলা ভাষাকে স্বাবলম্বী, শ্রুতিমধুর  সর্বজনগ্রাহ্য করার সচেতন প্রয়াস প্রদর্শনে নতুন ঢাকাবাসী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে কিছুদিন এধারা অব্যাহত থাকে। এসময় ‘রোড’ এর বদলে ‘সড়ক’, ‘ট্রাফিক আইল্যান্ড’ এর বদলে ‘সড়কদ্বীপ’, ‘লাইব্রেরি’র বদলে ‘গ্রন্থাগার’, রেডিওর বদলে ‘বেতার’ ইত্যাদির ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের সিদ্ধান্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ‘বিশুদ্ধ’ বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জোগায়। কিন্তু সরকারের শ্লথনীতি, আমলা, ইংরেজিতে অভ্যস্ত সরকারি কর্মচারি এবং উচ্চবিত্ত মানুষের আগ্রহের ফলে এধারা অল্পদিনের মধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের কাছেও নবজাতকের নামকরণে ইংরেজি শব্দ বিউটি, জন, টিটু, ফ্লোরা, জলি, মিল্টন, লিটন ইত্যাদি খুবই আদরণীয় হয়। বিশ শতকের নয়ের দশক পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার প্রভাব ধীরে আসা তরলের মতো ঢাকার বাংলা ভাষার নরম শয্যাকে সিক্ত করে তোলে। তারপরও ঢাকার বাংলায় প্রমিত ভাষারূপটি বিশেষভাবে সমাদর পেয়েছে এবং অনুসৃত হয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর বাইরে প্রতিদিনই মানুষ বাড়ছে যে শহরে এবং যারা আসছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, তাদের আঞ্চলিক ভাষারীতিকে সাঙ্গীকরণের মাধ্যমেই মূলত ঢাকার ভাষার প্রধান ধারাটি আজ প্রবাহিত। তাই ‘দুপুরে খাই নাই, ক্ষুধা লাগছে।’- এ জাতীয় বাক্য ঢাকার সাধারণ ভাষায় আজ পরিণত হয়েছে। অথচ, এ বাক্যে ঘটেছে সাধু রীতির ‘নাই’, ‘ক্ষুধা’ শব্দের সঙ্গে ‘লাগছে’ আঞ্চলিক ক্রিয়াপদের সমন্বয়।

একবিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স জগতে বিপ্লব সূচিত হয়। মোবাইল ফোনের দ্রুত বিস্তৃতির সঙ্গে এসময় ডজন খানেক স্যাটেলাইট চ্যানেল ও নগরভিত্তিক রেডিও-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পায়। এই টেলিভিশন-রেডিওগুলো প্রথমেই পড়ে অনুষ্ঠান-সংকটে। সময়-ভরাট ও প্রচারের প্রয়োজনে প্রয়োজনে পাণ্ডুলিপিহীন তাৎক্ষণিক প্রচুর অনুষ্ঠান-নাটক-ধারাবাহিক তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে যান তারা। এসব ক্ষেত্রে ভাষা ব্যবহারেও তারা হয়ে পড়েন স্বেচ্ছাচারী। পাশ্চাত্য ঢঙের অনুকরণ ও বিকৃত উপস্থাপনা এই অনুষ্ঠানগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষায় শ্রুতিমধুর শব্দগুলোকে পরিহার করে তার বদলে পাশ্চাত্য শব্দাবলি গ্রহণ করে সেগুলো উদ্ভটভাবে উচ্চারণ করেন। যেমন: ‘দর্শকমণ্ডলী’ শব্দটি পরিত্যাগ করে ‘ভিউয়ার্স’; ‘শ্রোতৃম-লী’র বদলে ‘লিস্নার্স’; ‘কি’ এর ব্যবহার পাল্টে দিয়ে ‘হোয়াট’; ‘অতএব/তাই’ এর বদলে ‘সো ইত্যাদি তাদের কাছে আজ প্রাত্যহিক ব্যবহারের অতি পরিচিত শব্দ হয়ে উঠেছে। ইদানীং ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে বেশি। আগে ঢাকার যেসব স্থানে মান বাংলা ভাষার চর্চা হতো, সেসব জায়গায় প্রাদুর্ভাব ঘটছে এই ‘বিকট ভাষা’র। গত প্রায় এক দশক ধরে চলতে থাকা এই প্রাদুর্ভাব এখন প্রায় মহামারির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাই ‘ফোন দেওয়া’ বা ‘ফোন মারা’ অথবা ‘নাস্তা সাটানো’ কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ অর্থে ‘রিমান্ডে’ আনা আজ এই উঠতি শিক্ষিত প্রজন্মের কাছে স্বাভাবিক কথ্যবুলিতে পরিণত। হাতে গোনা কয়েকজন লেখক-নাট্যকার-নির্মাতা কর্পোরেট পুঁজির লাভ পকেটস্থ করার জন্য কথিত দেশপ্রেমের নামে এই অদ্ভুত ও বিকট ভাষার চর্চা করে আসছেন; এর শিকার হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম।

সূচনা যেভাবেই হোক অথবা ব্যবহারকারীর সংখ্যার অনুপাত যাই হোক, বলতে হবে, ঢাকার ভাষায় আজ চারটি রীতি স্পষ্ট; প্রথমটি পুরোনো ঢাকার কুট্টি-সুব্বাসিদের রীতি; দ্বিতীয়টি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আগত অধিকাংশ ঢাকাবাসির ব্যবহৃত রীতি; তৃতীয়টি প্রমিত বা মান বাংলা রীতি; চতুর্থটি সেটেলাইট চ্যানেল ও নগর-রেডিও অনুসৃত বিকৃত ভাষা রীতি। আজকের ঢাকার ভাষা মূলত এই চাররীতির সমন্বিত যোগফল। এই ভাষা-নদী বেগবান, ক্রমাগ্রসর।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ