রবিবার ০৫ মে ২০২৪
Online Edition

রংপুর অঞ্চলে সিগারেটের রাজস্ব লোপাটের অভিযোগ

মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, রংপুর অফিস : কর্তৃপক্ষের অবহেলায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উন্নয়নের অক্সিজেন খ্যত রাজস্ব এনবিআর এর প্রজ্ঞাপণের আদেশ লংঘন করে গত ৩ মাসে রংপুরে সিগারেটের পরিবেশকরা সরকারী রাজস্বের প্রায় ৫০ কোটি টাকা লোপাট করার চাঞ্চ্যল্যকর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত অভিযোগ এবং রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ টি ওয়ার্ড সহ রংপুরের ৮ উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি বিটিসির রংপুরের পরিবেশক ”শাইরিন এন্টারপ্রাইজ” এবং আবুল খায়ের টোবাকোর পরিবেশক ”মের্সাস নুরুল ইসলাম এ- সন্স” রংপুর অঞ্চলের ১২ হাজার ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ীদের জিম্মি করে এই বিপুল পরিমান সরকারী রাজস্বের অর্থ লোপাট করেছে ।
উল্যেখ, সরকার চলতি অর্থ বছরে ধুমপান নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্রা-ের সিগারেট সহ ”ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি বিটিসির” উৎপাদিত ’বেনসন’, 'গোল্ডলিফ’, ’ডারবি’ ও ’ষ্টার’ সিগারেট এবং ”আবুল খায়ের টোবাকোর” উৎপাদিত ’মেরিজ’ সিগারেট সহ সকল ব্রা-ের সিগারেটের খুচরা মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সকল ক্ষেত্রে উৎপাদন এবং পরিবেশন করীগনকে সংশোধিত মূল্য অনুযায়ী সকল প্রকার সিগারেটের উপর সরকারের ভ্যাট আদায়ে ৭ ই জুন’১৮ থেকে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শূল্ক নির্ধারন করে সিগারেটের প্যাকেটে সীল দ্বারা নতুন খুচরা মূল্য মূদ্রণ করে বিক্রির আদেশ প্রদান করা হয়। এর প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর গত ৭ ই জুন ২০১৮ তারিখ জারিকৃত এক প্রঞ্জাপনের মাধ্যমে সাধারন আদেশ নম্বর -০৭/মূসক/২০১৮ এর ২ নম্বর ধারায় ”খ” নম্বর উপ আদেশের মাধ্যমে বলা হয় ” ৭ই জুন’২০১৮ তারিখ বা তার পরে সরবরাহ করা সকল প্রকার তামাক যুক্ত সিগারেটের ক্ষেত্রে (পূর্বে উৎপাদিত ও মজুদ সহ) নতুন মুল্যস্তর অনুযায়ী শুল্ক কর আদায় নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ৭ ই জুন’২০১৮ তারিখের পূর্বে উৎপাদিত সকল সিগারেটের প্যাকেটে সীল দ্বারা নতুন খুচরা মূল্য মূদ্রন করে তা বাজারজাত করতে হবে। এছাড়া একই ধারায় ”চ” নম্বর উপ আদেশের মাধ্যমে ”সিগারেটের নতুন মূল্যস্তর ও সম্পূরক শূল্ক হার কার্যকর হওয়ায় তা যথাযথ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে প্রত্যেক মূসক কমিশনারেটের কমিশনারগণকে এ ব্যাপারে বর্ণিত পদ্ধতির বাস্তবায়ন বিষয়ে নিশ্চিতকরনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি ও তত্বাবধান করতে বলা হয়েছে। একই সাথে ৬ ই জুন পর্যন্ত সকল সিগারেটেরে মজুদ ও সংরক্ষন করতে বলা হয়েছে”। অর্থাৎ এ বছর ৭ ই জুন থেকে বাজারজাতকৃত সকল সিগারেটের পণ্যে বর্ধিত সরকারী রাজস্বের মূল্য বাধ্যতা মূলক ভাবে সংযোজন করতে বলা হয়েছে।
 প্রাপ্ত অভিযোগ এবং রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান নিয়ে জানা গেছে, বিটিসির রংপুরের পরিবেশক ”শাইরিন এন্টারপ্রাইজ” এবং আবুল খায়ের টোবাকোর রংপুরের পরিবেশক ”মের্সাস নুরুল ইসলাম এ- সন্স” জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর এই আদেশকে গত ৩ মাস ধরে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রর্দশন করে পূর্বের মজুদকৃত সিগারেটের প্যকেটের গায়ে লেখা পূর্বে মূদ্রিত মূল্যের চেয়ে অধিক হারে ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ীদের নিকট বিক্রয় করে সরকারী রাজস্বের অর্থ^ বেপরোয়া ভাবে ফাঁকি দিয়ে তা লোপাট করে আসছেন।
 তাঁরা রংপুর অঞ্চলের কাষ্টমস, এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট এর মূসক কমিশনারেটের কমিশনার এর নাকের ডগায় রহস্যজনক ভাবে সিগারেটের প্যাকেটে সীল দ্বারা নতুন খুচরা মূল্য মূদ্রন না করেই এবং সরকারের নিকট নতুন কর পরিশোধ না করেই পূর্বের রেটে রংপুর অঞ্চলের ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ীদের জিম্মি বানিয়ে তাঁদের নিকট থেকে সকল ব্রা-ের সিগারেটে প্রতি প্যাকেটে গত ৯ই সেপ্টেম্বর এ রির্পোট লেখা পর্যন্ত ৩ থেকে ৮ টাকা করে অতিরিক্ত আদায়ের মাধ্যমে সরকারী রাজস্ব পরিশোধ না করেই প্রায় ৫০ কোটি টাকা লোপাট করেছেন। এ ভাবে ”শাইরিন এন্টারপ্রাইজ ও মের্সাস নুরুল ইসলাম এ- সন্স” গত ৩ মাস ধরে তাঁদের পরিবেশিত সকল ব্রা-ের সিগারেটের উপর অতিরিক্ত টাকা আদায় করে অনৈতিক ভাবে সে সব নির্বিঘ্নে মহা আনন্দে বাজারজাত করছেন।

যে ভাবে সিগারেটে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে-
অনুসন্ধান নিয়ে জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন হাট-বাজারসহ বিপনী কেন্দ্র গুলোতে সিগারেটের পরিবেশকদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ১২ হাজার ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ী রয়েছে। এসব ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ীদের প্রত্যেকের নিকট গড়ে প্রতিদিন নূন্যতম ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার বিভিন্ন ব্রা-ের সিগারেট বিক্রি করা হয় । তবে অধিকাংশ খিলিপান ব্যাবসায়ীর নিকট প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার সিগারেট বিক্রি করা হয় বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে এসব সিগারেটর মধ্যে ”ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি বিএটিসির” উৎপাদিত এবং ”শাইরিন এন্টারপ্রাইজ এর পূর্বে মজুদ করা ২০ শলাকার 'গোল্ডলিফ’, প্রতি প্যাকেটে ১৪০ টাকার স্থলে ১৪৮ টাকা, ২০ শলাকার ’বেনসন’ প্রতি প্যাকেটে ২০২ টাকার স্থলে ২১০ টাকা, ১০ শলাকার ’ডারবি’ প্রতি প্যাকেটে ২৭ টাকার স্থলে ৩৫ টাকা ও প্রতি প্যাকেটে ’ষ্টার’ সিগারেট ৪৫ টাকার স্থলে ৪৮ টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হয়। এছাড়া ”আবুল খায়ের টোবাকোর” উৎপাদিত এবং ”মের্সাস নুরুল ইসলাম এ- সন্স” এর পূর্বে মজুদ করা ’মেরিজ’ সিগারেট প্রতি প্যাকেটে ২৭ টাকার স্থলে ৩৫ টাকা অতিরিক্ত মূল্য অবৈধ ভাবে তাঁরা আদায় করে আসছেন।
বিক্রিত প্রতি প্যাকেট সিগারেটের বিপরীতে অতিরিক্ত ৩ থেকে ৮ টাকা হারে অতিরিক্ত আদায় করায় প্রত্যেক ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ীর নিকট থেকে সিগারেটের পরিবেশকরা গড়ে প্রতিদিন নূন্যতম ৫০০ টাকা করে অতিরিক্ত আদায় করছেন। এতে তাঁদের প্রতিদিন গড়ে নূন্যতম ৬০ লাখের বেশী টাকা অতিরিক্ত আদায় হয় বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এভাবে গত ৩ মাসে সিগারেটের ঐ দুই পরিবেশক ৫০ কোটির বেশী সরকারী রাজস্বের টাকা লোপাট করেছেন বলে জানা গেছে। রংপুরের কাষ্টমস, এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট এর মূসক কমিশনারেটের কমিশনার কার্যালয়ের রহস্য জনক নিরবতার সুযোগে তাঁরা এই পরিমান টাকা সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বাঁধাহনি ভাবে আতœসাৎ করছেন। এ ভাবে গত ৩ মাসে সিগারেটের পরিবেশকগন রংপুর অঞ্চলে ৫০ কোটিরও বেশী টাকা সরকারী রাজস্বের অর্থ ফাঁকি দিয়ে সে অর্থ তাঁরা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে, সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ীদের উপর জুলুম করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে তা আতœসাৎ করার প্রতিবাদে রংপুর জেলা ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ী সমিতি এবং ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ীদের পক্ষ থেকে পৃথক ভাবে পরিবেশক গনের বিরুদ্ধে রংপুরের জেলা প্রশাসক এবং ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের উপ পরিচালকের নিকট লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে । এর প্রেক্ষিতে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের রংপুর জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন এর দপ্তরে গত ৬ ই আগষ্ট এক শুনানীর মাধ্যমে অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় ”শাইরিন এন্টারপ্রাইজ এর বিরুদ্ধে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
রংপুরে সিগারেটের দুই পরিবেশক কর্তৃক সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারে কাষ্টমস, এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট এর মূসক কমিশনারেটের কমিশনার আহসানুল হক এর মুঠোফোেনে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান, তিনি বিষয়টি দেখছেন এবং শিগগিরই ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান। তিনি রংপুরের বাইরে থাকায় বিষয়টি বিস্তারিত জানার জন্য অতিরিক্ত কমিশনারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। এ ব্যপারে রংপুরের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল মান্নান সর্দার এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমাদের নিকট কোন তথ্য বা অভিযোগ না থাকায় বিষয়টি আমাদের জানা নেই। এ সময় এই প্রতিবেদক তাঁকে স্বরণ করিয়েদেন যে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ৭ ই জুন ২০১৮ তারিখ জারিকৃত এক প্রঞ্জাপনের আদেশের মাধ্যমে পূর্বে উৎপাদিত সকল ”সিগারেটের নতুন মূল্যস্তর ও সম্পূরক শূল্ক হার কার্যকর হওয়ায় তা কমিশনারেটের কমিশনারগণকে এ ব্যাপারে বর্ণিত পদ্ধতির বাস্তবায়ন বিষয়ে নিশ্চিতকরনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি ও তত্বাবধান করতে বলা হয়েছে। সেই সূত্র ধরে এ বিষয়ে কোন মনিটরিং করা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি জানান, জনবল কম থাকায় তা সম্ভব হয়নি । তবে শিগগির এ ব্যপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে ইতোপূর্বে দৈনিক সংগ্রাম সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত তথ্য বহুল সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন এর কোন সদুত্তোর তিনি দিতে পারেননি।
এ ব্যাপারে শাইরিন এন্টারপ্রাইজ রংপুর অঞ্চলের পরিবেশক নাদিম এর অনুপস্থিতিতে ঐ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার শোয়েব মুঠোফোনে জানান, ”সরকারী আদেশ সর্ম্পকে তাঁদের কিছু জানা নেই। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় তবে ৭ই জুন থেকে ক্ষুদ্র খিলিপান ব্যাবসায়ীদের নিকট থেকে প্রতি প্যাকেট সিগারেটে অতিরিক্ত ৮ টাকা করে কেন আদায় করছেন এর কোন
সন্তোষ জনক জবাব তিনি দিতে পারেননি। এ ব্যাপারে ”মের্সাস নুরুল ইসলাম এ- সন্স” এর পরিবেশকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, বিভিন্ন সংবাদ পত্রে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা নতুন রেটের পাকেটে সিগারেট বিক্রি করছি।
 এ ব্যপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের^ উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করছেন

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ