মৌমিতার সাথে ইফতার

কবির কাঞ্চন : মুনির সাহেব বারবার মোবাইলের বাটন চাপছেন। আর মোবাইলটা কানের কাছে আনছেন। এরপর হাত দু'টো পিছনে রেখে বিষন্ন মনে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। আবার মোবাইলে কল করলেন। ড্রাইভারের প্রতি তাঁর ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।
আজ ব্যবসায়ীদের বার্ষিক সভায় বিকাল ৩টায় তাঁর উপস্থিত থাকবার কথা। গতরাতে এত করে বলে দেবার পরও ড্রাইভার আসতে দেরি করছে। কলও ধরছে না। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি।
আর মাত্র ৩০ মিনিট বাকী। এসময় তো পথেই কেটে যাবে।
এরিমধ্যে পিছন থেকে ড্রাইভারের সালাম শুনতে পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চাপছেন।
জামাল গত দশ বছর ধরে মুনির সাহেবকে দেখে আসছে। অনেক ধন সম্পত্তির মালিক। কিন্তু মনে কোন অহংকার নেই। কর্মচারীদের সাথে আন্তরিক ভাষায় কথা বলেন। কারোর কোন সমস্যা দেখা দিলে সবকিছু ভুলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
আবার কর্তব্যের ক্ষেত্রেও কোন ছাড় দেন না। সময়মতো কাজ করতে পছন্দ করেন। জামাল নিজেও মালিকের এমন সময় সচেতনতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে।
কিন্তু আজ সকালে বের হবার সময় তার একমাত্র কন্যাসন্তান, রেবিন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে জগতের সবকিছু ভুলে যায় সে। কন্যার অসুস্থতা বাবার পৃথিবীকে ওলটপালট করে দেয়। মালিকের জরুরি সভায় উপস্থিত হবার কথাও তার মনে থাকে না।
এরিমধ্যে গাড়িতে ওঠে বসেন মুনির সাহেব। গাড়ি দুরন্ত গতিতে ছুটে চলছে।
মুনির সাহেব কোমল কন্ঠে বললেন,
- জামাল, আজ কি তোমার কোন সমস্যা হয়েছিল?
- জ্বি স্যার, যখন বাসা থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম তখনই আমার মেয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকবার টয়লেটে যেতে থাকে। মাত্র অল্প সময়ের ব্যবধানে আমার মেয়ে কেমন যেন হয়ে গেল। ওকে এমন অবস্থায় দেখে আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। আপনাকে নিয়ে বিকাল ৩টায় বেরুবার কথা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম। স্যার, আপনি রাগ করবেন না। আমি ইচ্ছা করে দেরী করিনি।
মুনির সাহেব মনে মনে ভাবতে লাগলেন,
আহা! জামালের ওপর আমি শুধু শুধু রাগ করেছি। সন্তানের অসুখে পৃথিবীর সব বাবাই তো পাগল হয়ে যায়। ওর কাছে ওর সন্তান তো সবচেয়ে দামী। তবু দায়িত্ববোধ মাথায় নিয়ে ছুটে এসেছে। যাই হোক আজ মিটিং শেষে আমি ওর বাসায় যাব। ওর মেয়েকে দেখে আসব।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মুনির সাহেব বললেন,
- আচ্ছা! তোমার এতো বিপথ। আমাকে তো একবার কল করে জানাতে পারতে। তাহলে আমি অন্যভাবে মিটিং-এ চলে যেতাম। তোমাকে আবার কষ্ট করে আসতে হতো না। আচ্ছা এখন ওর শরীরের কী অবস্থা?
- স্যার, ওকে আমাদের বাসার পাশের হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আমি বাসায় রেখে এসেছি।
- ঠিক আছে। আমার মিটিং শেষ হলে সোজা তোমার বাসায় যাব। তোমার মেয়েকে দেখে আসবো।
- স্যার, ততক্ষণে তো ইফতারির সময় হয়ে যাবে।
- হোক না। প্রয়োজনে আজকের ইফতার তোমার মেয়েকে নিয়ে একসাথে করবো।
জামাল খুশি হয়ে বলল,
- এ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। কিন্তু ----
- আবার কিন্তু কেন?
- আপনার কোন অসুবিধে হলে-----।
- কিসের অসুবিধা!
- আমরা সবাই মিলে একরুমে থাকি।
- ও এই কথা! শোন তুমি একরুমে সবাইকে নিয়ে সুখে আছো। এটা নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কোন মানে হয় না। সামর্থ্যানুযায়ী জীবন চলায় কোন লজ্জা নেই। বরং যারা আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করে ভালো থাকবার অভিনয় করে তারাই লজ্জার পাত্র হয়।
বিকাল পাঁচটার দিকে মুনির সাহেব মিটিং থেকে বের হন। জামাল গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। মুনির সাহেব গাড়িতে ওঠে বসলে জামাল মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
- স্যার, গাড়ি কোনদিকে ঘুরাবো?
- কেন? তোমার বাসার দিকে।
- জ্বি, স্যার।
গাড়ি দুরন্ত গতিতে ছুটছে। আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে এসে গাড়ি থেকে নামলেন মুনির সাহেব। জামালকে গাড়ির পাশে দাঁড় করিয়ে নিজের পছন্দ মতো বাজার করলেন। মৌমিতার জন্য সুন্দর চিত্তাকর্ষক গিফট নিয়ে গাড়ির দিকে ফিরে এলেন। গাড়ি আবার ছুটে চলল।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেল।
বাসায় ঢুকতেই তাদের নাকে আসে ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ। ঘরের ভিতরে এসে তার দারুণ অনুভূতি জাগে। একটিমাত্র ছোট কক্ষ। অথচ খুব পরিপাটী। যেন সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক সজ্জিত। মুনির সাহেব মৌমিতার পাশে বসে ওর সাথে দরদমাখা গলায় কথা বলেন। এরপর মৌমিতার জন্য আনা গিফট ওর হাতে তুলে দেন। এতো সুন্দর সুন্দর গিফট পেয়ে মৌমিতা খুব খুশি হয়।
এরিমধ্যে ইফতারের সময় হয়ে গেল। সবাই মিশে একসাথে ইফতার করলো। মুনির সাহেব মৌমিতার মায়ের হাতের তৈরি পিঠা খুব মজা করে খাচ্ছেন। তাঁর কাছে বাজার থেকে আনা দামী দামী ইফতারির সামগ্রীর চেয়ে ঘরের তৈরি খাবার খুব ভালো লাগছে।
ঝটপট ইফতারি শেষ করে সবাই মাগরিবের নামাজ আদায় করলো। নামাজ শেষে মুনির সাহেব আবার মৌমিতার সাথে খোশগল্প মেতে ওঠেন।
এদিকে মৌমিতার মা তার নিজের গাছের পাকা পেঁপে ছিঁড়ে মুনির সাহেবকে খেতে দেন। খাওয়ার আগেই পেঁপের ঘ্রাণে পুরো ঘর ছেয়ে যায়। মুনির সাহেব কয়েক টুকরো পেঁপে খাওয়ার পর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জামালকে জিজ্ঞেস করলেন,
- আচ্ছা, এই পেঁপে কোথায় পেলে?
- স্যার, এগুলো আমাদের নিজেদের গাছের পেঁপে। মৌমিতার মা নিজের হাতে পেঁপে গাছের চারা লাগিয়েছে।
- কিন্তু জায়গা কোথায় পেলো?
জামাল হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলল,
- ঐ যে বারান্দা দেখছেন, সেখানেই।
- আর কি কি চাষ করা হয়েছে?
- বিভিন্ন ধরণের ফুল, পেঁপে আর লেবুগাছের চারা।
মুনির সাহেব জামালের মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আনমনে ভাবতে লাগলেন, জামাল আমার অধীনে চাকরি করে। মাস শেষে খুব সামান্য বেতন পায়। এ বেতনে বৌ, বাচ্চা নিয়ে ছোট্ট পরিসরে বেশ সুখেই আছে। আসলে সুখ তো এমনই। একেকজনের কাছে একেক রকম হয়ে ধরা দেয়। কেউ অঢেল ধন সম্পত্তির মাঝে থেকেও সুখের সন্ধান পায় না। আবার কেউ কেউ ছোট্ট কুটিরে থেকেও অনাবিল সুখের পরশ জীবনে মাখে।
হঠাৎ জামালের দিকে চোখ পড়তেই বললেন,
- জামাল, গাড়িটা বের করো। বাসায় যেতে হবে। তারাবীর নামাজের সময়ও প্রায় ঘনিয়ে এসেছে।