মামুন সারওয়ারের টোকাই রাজা

তাজ ইসলাম : বিখ্যাত কার্টুনিস্ট রফিকুন নবীর সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্র টোকাই। একটা সময় জনপ্রিয়তায় আকাশ স্পর্শী অবস্হান ছিল এই চরিত্রটির। শিল্পীর চিন্তা কলমের আঁচড়ে জীবনঘনিষ্ট সত্য কথনে সাড়া জাগিয়েছিল তার কল্পিত টোকাই। স্কেচের নিচে আঁকিয়ের সংক্ষিপ্ত নাম র 'নবী। পত্রিকায় অংকিত র 'নবীর টোকাই কার্টুন রসাত্মক অথচ বাস্তব নির্ভর নির্মমতায় ছিল জীবন্ত। তার সেই টোকাই চরিত্রকে উপজীব্য করে বইমেলা ২০১৮ তে টোকাই রাজা নামে শিশুতোষ ছড়ার বই প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠান ইনভেলাপ পাবলিকেশন্স। লেখক ছড়াকার মামুন সারওয়ার। মামুন সারওয়ার জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক,মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিচরণ করেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। ছড়াতেও সিদ্ধহস্ত। টোকাই রাজা তার ছড়া কৃতিত্ব। র 'নবীর টোকাইকে এবার মামুন সারওয়ার ছড়া ভাবনায় চিত্রিত করেছেন নিজস্ব শৈল্পিকতায়।
ছড়ার ভাষায় ছড়াকার তাদের পরিচিতি তুলে ধরেছেন "এই ছেলেটি /নিত্য ভোরে/
শুধুই ঘোরে/ কুড়ায় কাগজ ছেঁড়া/ একলা মনে/ যায় যে হেঁটে/ যায় যে খেটে/ মাথাটা তার নেড়া। "(ছেলেটির জন্য)।
কাজের লোক, কাজের বুয়া,কাজের ছেলে - মেয়ে এ সব শব্দবন্ধনীর সাথে শহুরে সভ্যতার সম্পর্ক নিবিড়। নিপীড়ন,নির্যাতন,নিষ্ঠুরতার কাহিনীও ব্যাপক। গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র পীড়িত এসব জনগোষ্ঠীর প্রতি সভ্যতার মোড়কে আচ্ছাদিত নির্মম, হৃদয়হীন মানুষগুলো পান থেকে চুন খসলেই গর্জে ওঠে,চালায় অত্যাচার। কাজ করলে ভুল- ভ্রান্তি হতেই পারে। ভাঙতে পারে চায়ের কাপ,পানির গ্লাস, এতে ক্ষীপ্ত হয়ে অধীনস্থ এই সব মানুষের উপর অত্যাচারের ভয়াবহতার কথা বলতে গিয়ে মামুন সারওয়ার বলেন, "এমন করে কাজের মেয়ে/ নিজের ঘরে একা পেয়ে/ মিয়া বিবি মারে এবং শাঁসায়/ কেমন করে লিখব এসব/ পাই না কথা ভাষায়।"( কাজের মেয়ে)।
অন্তমিল ছড়া সৈনিকের হাঁটুর জোরের প্রামাণ্য উপকরণ। যার যত শক্ত তার ছড়ায় লেফট রাইট তত স্বচ্ছন্দ। এখন সচেতন ছড়া সৈনিকেরা নিজ নিজ ছড়ায় অন্তমিল প্রয়োগে অনেকেই চৌকষ। তারপরও একটি বইয়ে দুয়েকটি দুর্বলতা থাকতেই পারে। এসব বাদ দিয়েই শিল্পীর রচিত বইটিকে বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন দুয়েকটি বানান সমস্যা মূলত লেখক কিংবা প্রকাশকের সামগ্রিক কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। তবে এটিকে রসমিশ্রিত শব্দে বলে ছাপাখানার ভূত। কিন্তু এই ভূত কবিতা বা ছড়ার বইয়ের প্রথমেই যেন হামলে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখার জন্য দক্ষ কবিরাজের সুক্ষ প্রুফ রিডারি চোখ খোলে রাখা জরুরি। মামুন সারওয়ার "থাকিস কোথায়,,,,, থাকি মান্ডায়। "বলে ফেললেন তাড়াহুড়া করে, পরক্ষণেই তিনি আবার সরস ভঙ্গিমায় জাত ছড়াকারের মতো জবাব দিলেন কাম করি মুই/ রাত হলে আমি মা 'র / গলা ধরে শুই।"( টোকাই জীবন)।
"রাত শেষে দিন এলে/
দুঃখের ঘানি ঠেলে/ "একটা মাত্রা পড়ে গেলে খুব বেশী সমস্যা হয় না, তবে ছান্দসিক কান বড় বেয়াড়া, বলে কি এখানে একটু দাঁড়া, ভাল করে শোন।
তারপর শুনেটুনে আবার "ছোটে শুধু ছোটে/ নীল হয়ে ফোটে/"( এই ছেলে এই মেয়ে) এবার বলে সাবাস, সাবাস।
মামুন সারওয়াররা জুনিয়রদের আইকনে পরিণত হোক এটাই প্রত্যাশা। আর প্রত্যাশা যেখানে প্রবল সেখানে তো দায়িত্বটা অপরিসীমই।
মামুন সারওয়ার ইতিমধ্যে সাহিত্যে সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আমরা আশা করি তার দ্বারা ছড়ার জমিন স্বর্ণময় হবে।
"টোকাই রাজা " বইটি মুলত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জনতাকে নিয়েই লেখা। সবগুলো ছড়াতেই ঘুরেফিরে তাদের দুঃখ সুখ শোক আনন্দ বেদনার জীবন চিত্রই বর্ণিত হয়েছে। উদাহরণ দিতে গেলে যে কোন ছড়া থেকেই দেয়া যায়। আনন্দ মূলত তাদের জীবনে নাই বললেই চলে । তাই ঈদের দিনের কথা বলতে গিয়ে ছড়াকার বলেন "ঈদ এলে যার মুখে ফোটে না যে হাসি,,,,,,,,,,মুখে ভাসে কষ্টেরা দুখ রাশি রাশি।" (টোকাই)।
কবি তাদের জীবনের বাঁকে বাঁকে বিচরণ করেছেন। যেন তাদেরই কোন প্রতিনিধির একজন। তার জীবন ঘনিষ্ঠ মর্মস্পর্শী কথামালা-
"আপনি নিলে ফুলের গন্ধ/ আমি ভাতের গন্ধ পাই।/ (ভাতের জন্য)
এই উচ্চারণ মানবতাকে অশ্রুসিক্ত করে। এই চিত্র রাস্তার জ্যামে অহরহ বিরাজমান, আমরা মানুষ হয়ে হেঁটে যাই,মামুন সারওয়ার কবি হয়ে দেখেন, কলমে কাগজে তা লেখেন।
বইটিতে সূচি নাই সে জন্য সতেরটি ছড়া হিসেব করতে আমাকে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে গুনতে হয়েছে। হয়তো চব্বিশ পৃষ্ঠার বই বলে সূচি দেয়া হয় নি। প্রচ্ছদ ও অলংকরণের সব ছবি শিল্পী রফিকুন নবী 'র। বোর্ড বাঁধাইয়ের এই বইটি কাগজ ও ছাপার মান ভাল। শিশুতোষ বইটি সকল মহলের ভাবনার মালমশলা সমেত ইনভেলাপের একটি প্রশংসাযোগ্য প্রকাশনা। মূল্য ১৫০ টাকা মাত্র।