মানবতাবাদী কবি ফররুখ আহমদ

ড. এম এ সবুর : যিনি অনাহারক্লিষ্ট ক্ষুধাতুর মানুষের আর্তনাদ শুনে ব্যথিত হয়েছেন, জড়সভ্যতার মুখোশ উন্মোচন করে মানবিক সভ্যতার সন্ধান দিয়েছেন। মানবতাবোধ জাগ্রত করতে কল্প জগতে যিনি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে ‘হাবেদা মরুভূমি’ পরিভ্রমণ করেছেন। যিনি জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করেও মানবতাবাদের অভিন্ন লক্ষ্যে আজীবন নিবিষ্ট থেকেছেন। মানবতাবোধকেই যিনি সাহিত্যের মুল উপজীব্য করেছেন। তিনি মানবতাবাদী কবি ফররুখ আহমদ। তাঁর কবিতার মূল সুর মানবতার জাগরণ। নির্যাতিত-নিপীড়িত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধাতুর মানুষের জন্য করুণ আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার ও বিপর্যস্ত মানবতার জন্য গভীর বেদনায় ব্যথিত হয়েছে তাঁর হৃদয়। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের করুণ চিত্র মানবতাবাদী কবিকে দারুণভাবে আহত করেছে। তাই মম্বন্তরের আনুষঙ্গিক পাশবিকতা-অমানুষিক, ববর্রতা ও ধনী গরীবের ন্যক্কারজনক ব্যবধানের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি এভাবে,
আমি দেখি পথের দুধারে ক্ষুধিত শিশুর শব
আমি দেখি পাশে পাশে উপচিয়ে প‘ড়ে যার
ধনিকের গর্বিত আসব
আমি দেখি কৃষাণের দুয়ারে দুর্ভিক্ষ বিভীষিকা
আমি দেখি লাঞ্ছিতের ললাটে জ্বলিছে শুধু অপমান টিকা।
(আউলাদ)
তবে এসব অমানবিক করুণ দৃশ্য দেখে কবি শুধু ব্যথিতই হন নাই, প্রতিকারের পথনির্দেশও দিয়েছেন। আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সর্বত্র হীনমন্য, অসাম্য-বৈষম্য, বঞ্চনা-গঞ্জনা, অমানবিকতার বিরুদ্ধে ফররুখ আহমদ ছিলেন খড়গহস্ত। তবে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের মতো ‘দেখিয়া-শুনিয়া খেপিয়া গিয়ে’ মুখে যা আসে তাই বলেন নাই। নজরুলের আঘাত প্রত্যক্ষ আর ফররুখের আঘাত পরোক্ষ। তবে তীব্রতার দিক দিয়ে উভয়ই অভিন্ন। নজরুল ইসলাম উদ্বেলিত-উচ্ছ্বসিত ও আবেগসম্পন্ন অন্যদিকে ফররুখ আহমদ স্বপ্নচারি, মথিত ও মন্দ্রিত। কিন্তু তাদের লক্ষ্য অভিন্ন, অর্থাৎ মানবতার জাগরণ। অত্যাচার-অন্যায় অমানবিকতার বিরুদ্ধে ফররুখ আহমদ ছিলেন সদা জাগ্রত। যেখানেই তিনি মানবতার বিপর্যয় দেখেছেন সেখানেই কঠোর হয়ে মানবতা উদ্ধারের পথনির্দেশ দিয়েছেন। অমানবিকতাকে কঠোরভাবে দমন করার নির্দেশনা দিয়ে তিনি লিখেন,
এ নির্লজ্জ মানবতাহীন পশুদের যেথা ভীড়,
দ্বীনের রৌশনী মুছে যারা টানে সামিয়ানা রাত্রির।
সেথা উমারের দোররা হানিয়া আনো পথ মুুক্তির
আনো আজাদীর শুভ্রতা, ভাঙো শংকা ধরিত্রীর। ( সিরাজাম মুনীরা)
‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্যে মূলত মানবতাই স্পষ্ট হয়েছে। মানবদরদী নবী মুহাম্মদ সা., চার খলিফা ও ইসলাম অনুসারী মহান সাধকদের মানবতা উল্লেখিত হয়েছে তাঁর এ কাব্যে। মানবজীবনের চরম দুর্দিনে এ দুনিয়ায় মহানবীর আবির্ভাব হয়েছিল তার এ সুস্পষ্ট ছবি এঁেক তারই পাশে দাঁড় করিয়েছেন নবীজীর মানবতাবাদী ও কল্যাণধর্মী জীবনের নানা দিক। নবীজীর প্রদর্শিত পথে মানবতা বিকাশের জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অমিয় জীবনকথা কবি তুলে ধরেছেন ‘সিরাজাম মুনীরা’তে। এটা একটি জীবনীগ্রন্থ হলেও মূলত এতে অনুপম ভাষায় আর উপভোগ্য উপমা-চিত্রকল্পে মানবতাবাদী আদর্শের উজ্জীবন প্রকাশ পেয়েছে ।
আমাদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সর্বত্র হীনমান্যতা, শঠতা, চাটুকারিতা, উচ্চমার্গীয় বুদ্ধিবৃত্তির আত্মগর্বী অন্তঃসারশুণ্যতা দেখে ব্যথিত হয়েছে তিনি। সমাজের এই ক্লেদাক্ত বিবর্ণ প্রতিচ্ছবি তাঁর বিবেক ও সচেতন অনুভূতিকে আহত করেছে। তাই স্বাভাবিক কারণে এ অমানবিকতার বিরুদ্ধে আঘাত হানতে দ্বিধা করেননি তিনি। তিনি চেয়েছেন শোষকের ধ্বংস এবং শোষিতের উত্থান। যে সভ্যতায় মানবতা নাই, মনুষ্যত্ব নাই সে সভ্যতাকে তিনি হীনসভ্যতা ও জড়সভ্যতা বলে গালি দিয়েছেন। তার ভাষায়,
হে জড় সভ্যতা!
মৃত সভ্যতার দাস-স্ফীতমেদ শোষক সমাজ ।
মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ
তারপর আসিলে সময়
বিশ্বময়
তোমার শৃঙ্খলগত মাংসপিন্ডের পদাঘাত হানি‘
নিয়ে যাব জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে টানি‘
আজ এই উৎপীড়ত মৃত্যু দীর্ণ-নিখিলের অভিশাপ বওঃ
ধ্বংস হও-
তুমি ধ্বংস হও॥ (লাশ)
মূলত মানবতা বিপর্যয়ের শিকার অত্যাচারিত-নিপীড়িত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধাতুর মানুষের প্রতি কবিহৃদয়ের সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থের ‘আউলাদ’, ‘লাশ’ ইত্যাদি কবিতায়। অন্য দিকে একই কবিতায় মানবতাবিরোধী শোষকসমাজ ও সভ্যতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভাষায় তাঁর অভিশাপও উচ্চারিত হয়েছে। আর শোষণ-শঠতা থেকে মানবতার মুক্তির জন্য তিনি পথনির্দেশনা দিয়েছেন ‘হেরার রাজ-তোরণের দিকে’।
’৪৭ এর দেশ বিভাগের পাঁচ ছয় বছর আগে ফররুখ আহমদ যখন কলকাতায় সবচেয়ে প্রগতিশীল ‘বিপ্লবী সাহিত্য সাময়িকী’ পড়তেন এবং কবিতা প্রকাশ করতে থাকেন তখন তাঁর রচনার আঙ্গিকে ও বিষয়বস্তু ছিল সর্বহারা ও শ্রমিক শ্রেণী মানুষের করুণ জীবনকথা। এ সময় অন্যান্যের মতো তিনিও শ্রমজীবি মানুষ এবং শ্রমিক শ্রেণীকে সর্বহারা বিপ্লবের নেতৃত্বের সবচেয়ে উপযোগী হিসেবে দেখাতে অভ্যস্ত ছিলেন। শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে তিনি লিখেন,
যন্ত্রের গর্জন শ্রান্ত তন্দ্রাতুর প্রেসম্যান দেখে
নতুন বিস্ময় এক পথচারি আহত বুলেটে
নির্ভীক জনতা চলে বারুদের বুকে পথ কেটে
চলেছে শতাব্দীকাল যারা পথে ক্লান্তিচিহ্ন রেখে। (প্রেসম্যান)
কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন তাওহিবাদী আদর্শে পূর্ণ বিশ্বাসী-অনুসারী। আদর্শের ব্যাপার তাঁর কাছে বাইরের কোন বিষয় নয় এবং আদর্শ তাঁর কাব্যের কোন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি; বরং আর্দশের উপর ভর করেই তিনি ‘সিন্দবাদ’ হয়ে সাগর পাড়ি দিয়েছেন এবং ‘হাতেম তা‘য়ী’ হয়ে মানবতাকে উদ্ধার করেছেন। আর এ তাওহিদভিত্তিক আদর্শই তাঁর মানবতাবোধকে জাগ্রত করেছে। ফররুখ আহমদের সাহিত্যে তাওহিদবাদ ও প্রগতিবাদের সমন্বয় ঘটেছে। এ দুটো তাঁর কাছে কোন আলাদা বিষয় নয়। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন ‘তাওহিদবাদই প্রগতিবাদ’। আর এ বিশ্বাস ও জীবনের নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁর সাহিত্যে অনুরণিত হয়েছে। তাওহিদভিত্তিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তিনি সাহিত্যে নতুনরূপে-সাজে চিহ্নিত করেছেন। এজন্য তাকে কথিত অসম্প্রদায়িকতার তকমা লাগাতে হয় নাই। তাই তাওহিদবাদে পূর্ণ আস্থাশীল কবি ফররুখ আহমদ ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হতাহত মানুষের করুণ দৃশ্য ও আর্তনাদকে মানবিক বিপর্যয় মনে করে লিখেন,
এবার দেখেছি নিজের রক্ত, দেখেছি আর
রক্ত নেবার পাশবিক মত্ততা
এবার শুনেছি কোটি ফরিয়াদ, শুনেছি আর
শত মুুমূর্ষ কন্ঠের আকুলতা। (নিজের রক্ত)
ফররুখ আহমদ মাজলুম-সর্বহারাদের কন্ঠস্বর। মজলুম-মানবতাকে পুনর্জীবিত করাই ছিল তাঁর সাহিত্য সাধনার মূল উদ্দেশ্য। জালিম অত্যাচারিকে তিনি শয়তানের মতোই ঘৃণা করেছেন। মানুষের চিরশত্রু শয়তান বর্তমান সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থাতেও বিদ্যমান। আর এ শয়তান মানবতাকে ধংস করে সভ্যতাকে কলুষিত করছে। এ জন্যই তিনি শয়তানের অমানবিক বিষয়ে মানুষদের সতর্ক থাকতে লিখেছেন,
ইবলিসের অনুগামী চলে আজও বিচিত্র মুখোশে
নর-রক্তপায়ী কিম্বা রক্ত-লোভাতুর। তবু জানি
বিকৃতির এ অধ্যায় বিভ্রান্তির প্রতিচ্ছায়া শুধু। (ইবলিশ ও বনি আদম)
ভন্ডামী-শঠতা, অত্যাচার-অবিচার, মিথ্যা-মুনাফেকির বিরুদ্ধে অনঢ় মনোভঙ্গিই মানবতাবাদের অপর নাম। আর তা বার বার ফিরে এসেছে ফররুখ আহমদের কবিতায়। ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘নৌফেল ও হাতেম’, ‘সিরাজাম মুনীরা’, সর্বশেষ ‘হাতেম তা‘য়ী’ কাব্যের মূল উপজীব্য মনুষ্যত্ব-মানবতা। যদিও সব কবিতার ভাষা- আঙ্গিক, উপমা-উৎপ্রেক্ষা ভিন্ন ভিন্ন। তবে প্রকরণের ভিন্নতার মধ্যেও তাঁর কবিতাগুলোর ঐক্যসূত্রের মূল বন্ধন অভিন্ন অর্থাৎ মানবতাবাদ। তাঁর কবিতায় পৌরাণিক আজদাহা-স্বাপদ, পশুদল-পিচাশ, মরুভূমি-বিয়াবন, হাবেদা মরুভূমির চিত্রকল্পের পৌনঃপুনিক ব্যবহারে এই জড় নিস্প্রাণ-নিষ্ঠুর মনুষ্যত্বহীন পৃথিবীর ছবি ফুঁটে উঠেছে। আবার এই পৃথিবীর পথেই মনুষ্যত্বের তীর্থযাত্রার চিরপথিক ‘হাতেম তা‘য়ী’ যার দুঃসাহসে মরুভূমিতে ফুল ফুঁটেছে, অন্ধকার তার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেয়েছে। হাতেম তা‘য়ীকে কবি মানবতার প্রতীক হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। জালিম শোষকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসী সৎ ও কর্মঠ এক অনন্য প্রতিভূ হাতেম তা‘য়ী। ফররুখ আহমদ হাতেম তা‘য়ীকে মূলত মানবতার উদ্ধারকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনুরূপভাবে তিনি ‘সাত সাগরের মাঝি’র সিন্দবাদকেও মানবতাবাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত. দুর্ভিক্ষপীড়িত ক্ষুধাতুর মানুষকে উদ্ধার করাই সিন্দবাদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছেন তিনি। ফররুখের ‘সিন্দবাদ’ শুধু আরব্য উপন্যাসের চরিত্র নয় বরং এই সিন্দবাদ দুঃসাহসী, অক্লান্ত পরিশ্রমী, আশাবাদী ও অপরাজেয় এক মানবিক সত্তার প্রতীক। ‘নৌফেল ও হাতেম’ কাব্যখানি মূলত মানবতারই জয়গান। আর এ জয়গান উৎসারিত হয়েছে কবি আত্মার গভীর থেকে এবং জীবনের স্বাভাবিক দাবীতে। ত্যাগী, সত্যব্রতী, মানবতাবাদী হাতেমের জীবনাদর্শের আলোকে কবি মূলত ‘নৌফেল ও হাতেম’ কবির মনোগত মানবিক আদর্শের একটি বাস্তব ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হাতেম ভৌগোলিক বা পৌরাণিক জগতের অধিবাসী নন; তিনি নৈতিক জগতের অধিবাসী। আর মানবতা তার লক্ষ্য, পরোপকার তার উদ্দেশ্য। কবি হাতেমকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এভাবে,
কাব্য নয়, গান নয়, শিল্প নয়-শুধু সে মানুষ
নিঃস্বার্থ ত্যাগী ও কর্মী, সেবাব্রতী- পারে যে জাগাতে
সমস্ত ঘুমন্ত প্রাণ- ঘুমঘোরে যখন বেঁহুশ,
জ্বালাতে পারে যে আলো ঝড়ক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতে।
প্রকৃতপক্ষে ফররুখ আহমদ মানবতাবাদী কবি। ইসলামী রেনেসাঁর কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য মানবতাবাদ। আর ইসলামকে তিনি মানবতার আদর্শ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। ইসলামকে তিনি চেয়েছেন শোষণমুক্ত সমাজের নির্মাতা হিসেবে, মানবতার মুক্তির নির্দেশনা হিসেবে। এজন্য তাঁর ইসলামি ভাবধারার সাহিত্য মানবতাবাদী সাহিত্যে পরিণত হয়েছে। ইসলাম যে মানবতার আদর্শ তা বার বার উল্লেখিত হয়েছে কবি ফররুখের কবিতাতে। মানুষের তৈরী ইসলামের সংকীর্ণতা ও মেকীরূপ ছিন্ন হয়ে ইসলামের প্রকৃতরূপ উদ্ভাসিত ও মানবতার জয়গান উচ্চারিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যে। এ প্রবন্ধে ফররুখ সাহিত্যের মানবতাবাদ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হলেও বেশিরভাগ থেকে গিয়েছে অন্তরালে। তাই কবির নিজের ভাষায় বলতে হয়,
কিছু লেখা হ‘ল আর অলিখিত র‘য়ে গেল ঢের,
কিছু বলা হ‘ল আর হয়নি অনেক কিছু বলা
অনেক দিগন্তে আজও হয় নাই শুরু পথ চলা। (শেষ কণ্ঠ)