বুধবার ০১ মে ২০২৪
Online Edition

ফেইসবুকে ডেটা প্রাইভেসি

জাফর ইকবাল: বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে ফেইসবুক। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এই মাধ্যমে তাদের নিজের মতামত প্রকাশের পাশাপাশি কথ্যও প্রদান করে থাকে। সম্প্রতি ফেইসবুকে তথ্য প্রদান, তা মুছে ফেলা এবং সেটির ব্যবহার নিয়ে নানা আলোচনা হয়। বিশেষ করে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশের পর থেকেই ফেইসবুকের ডেটা প্রাইভেসি নিয়ে জন্ম হয়েছে নতুন উদ্বেগ। শুরুতে প্রায় পাঁচ কোটি ব্যবহারকারীর ডেটা অপব্যবহার নিয়ে অভিযোগ উঠলেও, সম্প্রতি সংখ্যাটা প্রায় ৮.৭০ কোটি বলে ধারণা প্রকাশ করেছে ফেইসবুক নিজেই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক মাধ্যমটির এমন ধারণা প্রকাশে ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের মনে নিজেদের ডেটা প্রাইভেসি নিয়ে শংকা জাগতেই পারে।
এখন কেউ যদি উদ্বিগ্ন হয়ে ফেইসবুকের কাছে থাকা তার সব তথ্য মুছে চান, তাহলে তার কী করণীয়? যদি আপনার অ্যাকাউন্টটি মুছেই ফেলেন তাহলে আপনার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টটি আর দৃশ্যমান থাকবে না। আরেকটি পথ হচ্ছে অ্যাকাউন্ট ‘ডিঅ্যাক্টিভেট’ করে দেওয়া। এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে এই উদ্বেগ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। আবার আক্যাউন্ট চালু করলে সব তথ্য আবার দেখতে পাবেন। কিন্তু কেউ যদি এমন কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন যে ফেইসবুক তার সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য জানে, সেক্ষেত্রে তার জন্য সবকিছু সরিয়ে ফেলাই ‘সর্বোত্তম’। এমন অবস্থায় কী করার আছে? এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি’র এক প্রতিবেদনে।
অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলা নিয়ে ফেইসবুক এই কথাগুলো বলে থাকে- আপনি যখন আপনার অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলেন, অন্যরা তা আর ফেইসবুকে দেখতে পাবে না। আপনার ছবি, স্ট্যাটাস আপডেট বা ব্যাকআপ ব্যবস্থায় সংরক্ষিত আপনার পোস্ট করা সব কিছু মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে এরপর ৯০ দিন সময় লাগতে পারে।
আমরা যখন এই তথ্য মুছে দিচ্ছি, তখন ফেইসবুকে অন্য কেউ এই তথ্য দেখতে পাবেন না। ফেইসবুকে আপনার করা কিছু বিষয় আপনার অ্যাকাউন্টে জমা থাকে না। যেমন, আপনার অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলার পরও একজন বন্ধু আপনার কাছ থেকে মেসেজ পেতে পারেন। আপনার অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলার পরও এই তথ্য রয়ে যায়।
এই মুছে ফেলার অনুরোধ জানানোর পর ব্যবহারকারী মত পাল্টে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করতে চাইতে পারেন। সে কারণে তথ্যাবলী পুরোপুরি মুছে ফেলতে খানিকটা দেরি করা হয় বলেও জানিয়েছে সোশ্যাল জায়ান্টটি। এই মত পাল্টানোর সময় হলো দুই দিন। এই সময়ের মধ্যে কেউ লগইন করে আবার মুছে ফেলার ওই অনুরোধ বাতিল করতে পারবেন। কিন্তু একবার এই সময় পার হয়ে গেলে ব্যবহারকারীর সব তথ্যও চলে যাবে। এক্ষেত্রে সতর্কতার বিষয় হচ্ছে, কেউ যদি এই পুরো প্রক্রিয়ায় সব তথ্য মুছে ফেলেন তবে ওই অ্যাকাউন্ট পুনরায় চালু করা আর সম্ভব হবে না, হারিয়ে যাবে অ্যাকাউন্টটিতে থাকা সব তথ্যও। আরেকটি বিষয় মনে রাখা ভালো। অ্যাকাউন্ট মুছে ফেললেই যে আপনার সব তথ্য ফেইসবুক মুছে ফেলবে এমনটি না ভাবাই ভালো। কিছু তথ্য কখনোই মুছে ফেলা হবে না। কোনো না কোনো ডেটাবেসে এগুলো রয়ে যাবে। তবে, ফেইসবুক বলছে, ওইসব তথ্য কোন অ্যাকাউন্টের বা কার, সেই যোগসূত্রগুলো মুছে ফেলা হয়। আর সে কারণেই সামাজিক মাধ্যমে কোনো কিছু পোস্ট করার আগেই সতর্কতার সঙ্গে পোস্ট করাই সম্ভবত সবচেয়ে ভালো।
ফেইসবুকে কন্টাক্টস আপলোড আটকাবেন কীভাবে? স্মার্টফোনে ফেইসবুক অ্যাপ ইনস্টলের সময়ই আপনার কন্টাক্টস ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে নেয় ফেইসবুক। আর এতে নিয়মিতভাবে আপনার কন্টাক্টস আপলোড হয় ফেইসবুক সার্ভারে। ফেইসবুককে নিজের কন্টাক্টস দেওয়া সহজেই আটকাতে পারেন গ্রাহক। অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস ডিভাইস থেকে ফেইসবুকে কন্টাক্টস আপলোড আটকানোর উপায় জানানো হয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি’র প্রতিবেদনে।
অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে কীভাবে ফেইসবুক কন্টাক্টস আপলোড আটকাবেন: অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ফেইসবুক অ্যাপ চালু করুন। পর্দার ডানদিকে ওপরে মেনু বাটন চাপুন, তালিকা থেকে ‘সেটিংস অ্যান্ড প্রাইভেসি’ বাছাই করুন। ‘অ্যাপ সেটিংস’ অপশন বাছাই করুন ‘কন্টিনিউয়াস কন্টাক্টস আপলোড’ ফিচার বন্ধ করুন।
আইফোন এবং আইপ্যাডে কীভাবে ফেইসবুক কন্টাক্টস আপলোড আটকাবেন: আইফোন বা আইপ্যাডের ফেইসবুক অ্যাপের মেনু বাটন চাপুন। সেটিংস বাছাই করুন,অ্যাকাউন্ট সেটিংস-এ যান। জেনারেল ট্যাব বাছাই করুন,আপলোড কন্টাক্টস’ বাছাই করে তা বন্ধ করুন।
যে কন্টাক্টসগুলো ইতোমধ্যেই আপলোড করেছেন তা মুছবেন কীভাবে: প্রথমে নিশ্চিত ক্রুন ওপরের ধাপগুলো ঠিকমতো অনুসরন করেছেন। ওয়েব ব্রাউজার থেকে ফেইসবুকের কন্টাক্ট ম্যানেজমেন্ট পেইজে যান। রিমুভ অল কন্টাক্টস’ বাছাই করুন।
ফেইসবুক আপনার কতটা জানে, কী রাখে? প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর প্রায় প্রতিটি কাজের তথ্যই সংরক্ষণ করে রাখে ফেইসবুক। সামাজিক মাধ্যমটির অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকেই শুরু হয় এই তথ্য সংগ্রহ। এরপর ব্যবহারকারীর কোনো বিজ্ঞাপন ক্লিক করা, কোনো ইভেন্টে আমন্ত্রণ পাওয়া, তার বন্ধুতালিকা, তিনি কোনো মেসেজ পাঠালে বা গ্রহণ করলে, তিনি কাদেরকে ফলো করছেন, প্রতিটি স্ট্যাটাস আপডেটসহ প্রতিটি তথ্যই সংরক্ষিত থাকে।
সরাসরি বলতে গেলে, ফেইসবুকে যাত্রা শুরুর পর থেকে আজ অব্দি সোশ্যাল নেটওয়ার্কটিতে ব্যবহারকারীর করা সবকিছুর ইতিহাসই লিপিবদ্ধ থাকে। এই ডেটা ব্যবহার করে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জেনে নিতে পারে। বাইরের কেউ যদি এই ডেটায় একবার অনুমোদিত প্রবেশাধিকার পেতে পারে, তবে তারা ব্যবহারকারী সম্পর্কে যে অনেক কিছু জেনে যাবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে কেমব্রিজ অ্যান্যালিটিকা কেলেঙ্কারি’র ঘটনায় বিষয়টি কিছুটা আঁচ করা যায়।
ফেইসবুক আপনার সঙ্গে কী কী জানে তা চাইলে দেখতে পারবেন আপনি। এজন্য ‘অ্যাকসেসিং ইওর ফেইসবুক ডেটা (Accessinog Your Facebook Data)’- নামের পেইজটিতে যেতে হবে। সেখানে একটি তালিকার মাধ্যমে ফেইসবুক আপনার সম্পর্কে কী কী ডেটা রাখছে তা প্রকাশ করা হয়েছে।
ফেইসবুকের আর্কাইভে আপনার সম্পর্কে কী কী ডেটা জমা হয়েছে তা দেখতে নিচের ধাপগুলো অবলম্বন করতে হবে। Facebook.com/settings- এই পাতায় যেতে হবে। ডাউনলোড এ কপি অফ ইওর ফেইসবুক ডেটা’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। ডাউনলোড আর্কাইভ’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। এতে কিছু সময় লাগতে পারে, কিন্তু আপনার পুরো আর্কাইভ তৈরি হয়ে গেলে ফেইসবুক আপনাকে জানাবে। এটি তৈরি হওয়ার পর আবারও ‘ডাউনলোড আর্কাইভ’-এ ক্লিক করলে আপনার কম্পিউটারে একটি জিপ ফাইল ডাউনলোড হবে।  এই ফোল্ডার-এর প্রতিটি ফাইল খোলার মাধ্যমে আপনি এই আর্কাইভ ব্রাউজ করতে পারবেন।
ফেইসবুকে একজন ব্যবহারকারীর পুরো জীবনই এই আর্কাইভে সংরক্ষিত। কেউ ফেইসবুক ছেড়ে দিতে চাইলে যদি নিজের প্রোফাইলের কার্যক্রমের একটি কপি রেখে দিতে চান, তবে অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলার আগে এই ফাইলটি ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। তবে, এর মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের কী কী ডেটা কীভাবে সংরক্ষণ করছে।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে প্ল্যাটফর্মে থাকা ফোন নাম্বার আর ইমেইল অ্যাড্রেস দিয়ে সার্চ করার সুবিধা কাজে লাগাচ্ছে ‘বিদ্বেষপরায়ণ লোকেরা’, এমন তথ্যের সন্ধান পেয়েছে ফেইসবুক। এ কারণে সাইটটি থেকে এই সুবিধা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড মিরর।  এই উপায়ে ‘অধিকাংশ’ ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যেত বলে জানিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক মাধ্যমটি। এ নিয়ে ফেইসবুকের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মাইক শোফার বলেন, “এ কারণে আমরা এই ফিচার বন্ধ করে দিয়েছি। বাংলাদেশ থেকে কোনো ব্যক্তির প্রোফাইল খুঁজতে করা সব সার্চের মধ্যে সাত শতাংশই ফোন নাম্বার দিয়ে করা হতো বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ফেইসবুকের প্রায় পাঁচ কোটি ব্যবহারকারীর ডেটা ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অপব্যবহার করেছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় কাজ করা ডেটা বিশ্লেষণা প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা, এমন অভিযোগ উঠার পর থেকে সমালোচক, নীতিনির্ধারক আর বিনিয়োগকারীদের চাপের মুখে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু পাঁচ কোটি নয়, প্রায় আট কোটি ৭০ লাখ গ্রাহকের তথ্য লন্ডনভিত্তিক কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার হাতে গেছে বলে বৃহস্পতিবার ধারণা প্রকাশ করে ফেইসবুক। এ খবর প্রতিষ্ঠানটির উপর থাকা চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের সেক্রেটারি অফ স্টেট ফর ডিজিটাল, কালচার, মিডিয়া অ্যান্ড স্পোর্টস ম্যাট হ্যানকক বলেন, ফেইসবুক “আমাদের এক মিলিয়নেরও বেশি নাগরিকের ডেটা ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
ফেইসবুক এর আগে ব্যবহারকারীদেরকে তাদের অ্যাকাউন্টে ফোন নাম্বার যুক্ত করতে উৎসাহিত করত। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, এর মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আর অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তা বাড়ানোর পথ আরও সহজ হয়। প্রোফাইলে ফোন নাম্বার দেখানো হবে কিনা তা ব্যবহারকারীরা ঠিক করে দিতে পারেন, কিন্তু ডিফল্ট ব্যবস্থা হচ্ছে, যে কেউ কারও ফোন নাম্বার দিয়ে সার্চ করে তার প্রোফাইল বের করতে পারে। ফোন নাম্বার দিয়ে প্রোফাইল দেখানো বা না দেখানোর ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী পুরোপুরি নিজের ইচ্ছামতো বাছাই করতে পারতেন তাও নয়। এই সুবিধা শুধু নিজের বন্ধুদের জন্যই করে রাখতে পারতেন তারা।
এই ফিচার কীভাবে একজন প্রতারক অপব্যবহার করতে পারেন তা নিয়ে এর আগে বলেছেন বিভিন্ন নিরাপত্তা গবেষক, বলা হয়েছে বিবিসি’র প্রতিবেদনে। ফোন নাম্বার আর ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে পাওয়া ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে একজন প্রতারক আক্রান্ত ব্যক্তিকে ফোন করে তাদেরকে নাম ধরে ডাকতে পারেন। এমন ফোন দিয়ে প্রতারক নিজেকে ব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবেও দাবি করতে পারেন। পেন টেস্ট পার্টনারস-এর নিরাপত্তা গবেষক কেন মুনরো বলেন, “আপনি যদি কারও সঙ্গে প্রতারণা করতে চান, আপনার কাছে তার বিস্তারিত তথ্য আর তাদের নাম জানতে একটি পথ রয়েছে প্রতারণার জন্য এটি একটি চমৎকার ব্যবস্থা। এ দিকে ফেইসবুক বলেছে, বন্ধুদের খুঁজে পেতে এই ফিচার একটি ‘দরকারি’ সুবিধা,  বিশেষত যেসব দেশে একই নামে অনেক ব্যক্তি রয়েছেন। এমন দেশের উদাহরণে টেনে আনা হয় বাংলাদেশের কথা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ