বিএনপির সহায়ক সরকারের দাবি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়
সংসদ রিপোর্টার : বিএনপির নির্বাচনকালীন ‘সহায়ক’ সরকারের দাবি আবারও প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আমাদের সরকার গণতন্ত্রকে সবসময় সমুন্নত রাখবে। সে জন্য সংবিধান পরিপন্থি কোনো সরকার ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব না। তারা (বিএনপি) অসাংবিধানিকভাবে সহায়ক সরকারের দাবি করে আসছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে তানভীর ইমামের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধান অনুয়ায়ী আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচের সময় সহায়ক সরকার বলে কোনো সরকার গঠনের বিধান নেই। বিএনপি জন্ম নিয়েছে মার্শাল’ল জারি করে সংবিধান লংঘন করার মাধ্যমে অবৈধ পথে, তাই অবৈধ দাবি করাটা তাদের অভ্যাস।
আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করার পর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামে বিএনপি। দাবি না মানায় দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। একাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর নির্বাচনকালীন ‘সহায়ক’ সরকারের দাবি তুলেছে তারা, তবে এর রূপরেখা এখনও তারা দেয়নি।
এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১২ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচনের সময় গতবারের মতো ছোট সরকার গঠনের ইঙ্গিত দিলে তা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয় বিএনপি। যদিও বিএনপির সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে আসা শেষ হাসিনা প্রশ্নোত্তর পর্বে সহায়ক সরকারের প্রস্তাবও নাকচ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলেছিলাম। তার মানে, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালন করবে, সরকারের পরিসর ছোট করা হবে। সরকার নির্বাচনকালীন সময়ে শুধু রুটিন কার্যক্রম পরিচালনা করবে, কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে না।’
বিএনপির প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি জন্ম নিয়েছে মার্শাল ল জারি করে সংবিধান লঙ্ঘন করার মাধ্যমে অবৈধ পথে, তাই অবৈধ দাবি করাটা তাদের অভ্যাস।’ জিয়াউর রহমানের ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ ভোটারবিহীন গণভোট করেছিল বিএনপি। সামরিক বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে কোনো নিয়মনীতি অনুসরণ না করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরবর্তীতে তার উক্ত কর্মকান্ড অবৈধ ঘোষিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে মাগুরা ও ঢাকার উপনির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি করেছিল এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে অবৈধ সরকার গঠন করে বিএনপি। উল্লেখ্য, গণ আন্দোলনের সম্মুখীন হয়ে দেড় মাসের মাথায় তাদের পতন ঘটে। ওই সময়ে বিএনপি নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ষ্পষ্ট রূপরেখা থাকা সত্ত্বেও তাদের পছন্দসই ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার চেষ্টা করে নির্বাচনের নামে প্রহসন করার উদ্দেশ্য থাকায় দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয় এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২ বছর ক্ষমতায় থাকে। এসব ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বিএনপি কোন দিনই গণতন্ত্রিক ধারাবাহিকতার পক্ষে ছিল না। আর এজন্যই বর্তমানে তারা অসাংবিধানিকভাবে সহায়ক সরকারের দাবি করে আসছে যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই : শেখ মো. নূরুল হকের চিহ্নিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে বর্তমানে শীতকালে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে প্রায় ৮ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াট এবং এর বিপরীতে উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার ৪৫ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভসহ)। ফলে বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। তবে গ্রীষ্মকালে সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্কের সীমাবদ্ধতা, গ্যাস সরবারাহের অপ্রতুলতা ও রক্ষণতাবেক্ষণ কাজের জন্য মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রান্ত ঘটে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ২০২১ সারের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বাস্তবে ২০১৮-১৯ সালের মধ্যেই দেশের শতভাগ এলাকায় নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে প্রাপ্ত চাহিদার তথ্য অনুযায়ী আসন্ন সেচ মৌসুম ও গ্রীষ্মকালীন সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ১১ হাজার ৫০০-১৩ হাজার মেগাওয়াট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিতকল্পে বিদ্যুৎ খাতে যুগোপযোগী বাস্তবসম্মত টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যবস্থা নিয়েছে। এর ধারাবাহিতকায় ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
নিরবচিছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ : নিরবচিছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ জাতীয় সংসদে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এগুলো হচ্ছে- বর্তমানে মোট ১৩ হাজার ৭৭১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৪৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিমার্ণাধীন রয়েছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ২০১৮ হতে ২০২৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে। মোট ৫ হাজার ৯২ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ২০১৮ হতে ২০২২ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে। মোট ২০ হাজার ৭৩২ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ভারতে ৩টি স্থান হতে ২ হাজার ৩৩৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ আমদানি পর্যাক্রমে অব্যাহত রয়েছে, যা ২০১৮ হতে ২০২২ সালের মধ্যে শুরু হবে। বর্তমানে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত হতে আমদানি করা হচ্ছে।
অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি হবে না : আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের অবসরের বয়সসীমা বড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপতত বাড়ানো সম্ভব না, পরবর্তীতে দেখা যাবে। ফখরুল ইমামের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করার কোন পরিকল্পনা সরকারের আপাতত নেই। ভবিষ্যতে এ বিষয়টি দেখা যাবে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন অবসরসীমা বাড়ানো হয়নি। একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অবসরের বয়সসীমা ৬৭ থেকে ৬৯ বছর করে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে ৬০ বছর করে দিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, যদি অবসরের বয়সসীমা শুধু বাড়ানোই হয় তবে নীচের স্তরে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে এবং নতুনদের চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ অনেক হ্রাস পায়। তাই যত বেশি অবসরের বয়স বাড়ানো হবে তত চাকরিতে প্রবেশ কমে যাবে। আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট ছিল, এখন তেমন সেশনজট নেই। ফলে চাকরিতে প্রবেশের জন্য এখন অনেক সময় পাচ্ছে। তাই এখন আর অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর কোন পরিকল্পনা নেই।
প্রসঙ্গ বিনিয়োগ : সামশুল হক চৌধুরীর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা জানান, দেশের ভেতরে বিনিয়োগের জন্য সকল সুযোগ-সুবিধাই নিশ্চিত করেছে সরকার। কিন্তু দেশে বিনিয়োগ না করে যারা অর্থ পাচার করতে চায় তারা তো তা করতেই চাইবে।
তিনি বলেন, টাকা পাচার করলে আমরা তা শনাক্ত করে দেশে ফেরত আনছি। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলের পাচারকৃত অর্থ আমরা দেশে ফেরত এনেছি। অন্যরা যারা অর্থ পাচার করছে তা দেশে ফেরত আনতে সরকার যথেষ্ট তৎপর রয়েছে।