বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের দুর্ভোগ
দেশের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, গ্রাহক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের বিরোধিতা উপেক্ষা করে সরকার আবারো গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে আওয়ামী সরকারের দুই মেয়াদের মধ্যে ২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত বছরে খুচরা গ্রাহক বা ভোক্তা পর্যায়ে ৮ বার এবং পাইকারী পর্যায়ে ৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। চলতি ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে এই দাম বৃদ্ধি কার্যকর করা হবে বলে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। এতে সরকারের আয় হবে ১৭০০ কোটি টাকা। জনদরদী (?) সরকার কেন ও কী কারণে বিদ্যুতের দাম আবারো বাড়ালো - তার কোনো সন্তোষজনক জবাব বিইআরসি দিতে পারেনি। তারপরও বলা হচ্ছে, খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে ৫.৩ শতাংশ দাম বাড়ানো হলেও বিদ্যুতের ন্যূনতম বিল প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। মাসে ৫০ ইউনিটের কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করা ৩০ লাখ দরিদ্র গ্রাহকের বিল এতে কমে যাবে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের প্রায় ৬০ লাখ গ্রাহকের মাসিক বিল বাড়বে না। বিইআরসি’র (বিদ্যুৎ) এক সদস্য জানিয়েছেন, সরকারের ভর্তুকি বছরে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা অনুদান দেয়ার বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তবে বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দাম কমানোসহ অন্যান্য বিষয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারেননি। তাই গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াতে হয়েছে। বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধিকে ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে বিইআরসি’র কেউই যৌক্তিক প্রমাণ দিতে পারেননি। তারপরও কী করে মূল্য বাড়ে? এটা কেবল আমাদের মতো দেশের প্রেক্ষাপটেই সম্ভব। এর সাথে ন্যায়নীতি, ভোক্তাদের স্বার্থ-অধিকার ও আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। গণশুনানি যে এক ধরনের প্রহসন এবং অকার্যকর ও অর্থহীন, তা মূল্যবৃদ্ধি ঘোষণায় প্রতীয়মান হচ্ছে।
খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর, প্রান্তিক কৃষক, হতদরিদ্র, বেসরকারি চাকরিজীবী, স্বল্প আয়ের কর্মজীবী, পেশাজীবী, আয়হীন বেকার এবং সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক ও স্বস্তিকর জীবনযাপনের পরিবর্তে নিত্য অভাব অনটনের মধ্যে তারা নিপতিত। বেশিরভাগ মানুষ খরচের খাত কাটছাঁট করেও স্বস্তি পাচ্ছে না। এমন শোচনীয় অবস্থায় সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিয়ে ধুঁকতে থাকা সাধারণ মানুষকে শোষণে নেমে পড়েছে। এতে জনগণের ভোগান্তি চরমে গিয়ে পৌঁছবে। শিল্প-কারখানার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে পণ্যমূল্যও আকাশ ছোঁয়া হবে। এর সব দায়ভারই নিতে হবে সাধারণ মানুষকে। আওয়ামী সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড অত্যন্ত গর্ব সহকারে ঘোষণা করা হয়। অথচ এর সুফল দেশের সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। উল্টো সরকার বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়িয়েই চলছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের জনগণের উপকারার্থে নয়, বিদ্যুৎ নিয়ে সরকার ও সরকারি মহলের ব্যবসায়িক মনোভাবই প্রকাশিত হচ্ছে। গত ২০০৮ সালে আওয়ামী জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল। দায়মুক্তি দিয়ে বেসরকারী খাতে বিনা টেন্ডারে তরল জ্বালানি নির্ভর কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল। এ নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনা হলেও সরকার কান দেয়নি। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অনেক বেশি দামে কিনেছে এবং এখনো কিনছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের চাপে পড়ে সরকারও ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে চলেছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এসব রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র যখন অনুমোদন দেয়া হয়, সরকার তখন বলেছিল এটা স্বল্প সময়ের জন্য করা হয়েছে। সরকারের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এসব ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে। একটানা ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও মধ্যমেয়াদি কোন পরিকল্পনা সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য দেশের জনগণের উপর চেপে বসেছে। দাম বাড়িয়ে সরকার লাভ করলেও সাধারণ মানুষ পড়েছে চরম দুর্ভোগে। অভিযোগ রয়েছে, সরকার পিডিবি’র কম দামের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে। এ থেকেও সরকারের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি প্রকাশিত হচ্ছে। গোটা বিশ্বে যখন জ্বালানি তেলের দাম সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, সরকার তখন দেশে তেলের দাম কমায়নি। অন্যদিকে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানোর জন্য দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের পকেটের টাকা শুষে নিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে সাশ্রয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি ও পুনরায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলেও সেদিকে সরকার খেয়াল করার যেন সময়ই পাচ্ছে না। বিদ্যমান ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বিদ্যুতের উপরই নির্ভর করে চলছে এবং ঘাটতি পূরণের নামে মূল্যবৃদ্ধি করে দেশের আপামর জনসাধারণকে ক্রমাগত শোষণ করে যাচ্ছে।
অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেই হয় না, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ও যথাযথভাবে সরবরাহের উপরই এর সার্বিক সাফল্য নির্ভর করে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের স্বল্পমূল্যের এ যুগে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে ঠিক তেমনি সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহকদের তা সরবরাহ করার সুযোগ হাতছাড়া করা হচ্ছে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে দুঃখ-দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে একের পর এক বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির গতি ধীর রেখে এবং দাম বাড়িয়ে তা অর্জন করা সম্ভব নয় বলে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আংকটাড সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটান বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এ প্রতিবেদন থেকে এটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার যে বিপুল সাফল্য অর্জনের কথা বলে নিজেরাই উল্লাস প্রকাশ করছে তা জনগণের সাথে তামাশা নয় কী?
সরকারের কথা মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য হলে জনগণ সাশ্রয়ী মূল্যে কেন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না? আবার বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের সাথে সরকার যদি তাল মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারতো, একই সাথে দাম কমাতো তবে গ্রাহকদের দাম বৃদ্ধির এই চাপে পড়তে হতো না। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে তা সাশ্রয়ী করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া বেশি দরকার ছিল তার কোন কিছুই সরকার করেনি। বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে জনগণের উপর দুর্ভোগ চাপিয়ে দেয়া যা আওয়ামী সরকারের খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেই আমরা মনে করি।