অজস্র রহমতের বৃষ্টিঝরা রাত...
তাইয়্যেবা : “হাজার মাসের চাইতে যে রাত মহামূল্যবান
শবে কদর সেই সে রাত শোন মুসলমান.....”
আল্লাহ তায়ালার রুবুবিয়্যাতের? অন্যতম নিদর্শন হল মানবজাতির প্রতি আল্লাহ্ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে দান করেছেন দয়াদরবশ হয়ে। এ মাসেই নাজিল হয়েছিল আল- কুরআন, যা হেদায়াত ফুরকান রহমত নূর ও শেফা। আর যা নাজিল করা হয়েছিল এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মহামূল্যবান রজনীতে,যে রাতে হাজার মাসের চেয়েও অধিক কল্যান ও বরকতের কোষাগার লুটিয়ে দেয়া হয়েছে। যাকে বলা হয় লাইলাতুল কদর, লাইলাতুল মুবারাজান।
লাইলাতুল কদর কি?
“আমি ইহা (এ কুরআন) নাযিল করেছি রাত (লাইলাতুল কদর) সম্পর্কে? সে মহিমান্বিত রাত হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। প্রত্যেক কাজে সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ (অর্থাৎ জিব্রাঈল (আ:) নাজিল হন তাদের অনুমতিক্রমে। সকাল না হওয়া পর্যন্ত এ রাত্রি পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার।” (সূরা কদর)
লাইলাতুল অর্থ রাত। আর কদরের অর্থ দুইটি-১ম ভাগ্য তাকদীর নির্ধারন করা, সময় নিদিষ্ট করা, সিদ্ধান্ত করা এটি এমন একটি রাত যে রাতে আল্লাহ্ তাকদিরের ফয়সালা জারি করার জন্য তা ফেরেশতাদের হাতে তুলে দেন। এই রাতেই আল্লাহ্ প্রত্যেক বস্তুর সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করেন তার সময় নির্দিষ্ট করেন এবং হুকুম নাযিল করেন ও প্রত্যেক বস্তুর ভাগ্য নির্ধারণ করেন। এ রাতেই নির্ধারিত হয় আগামী ১ বছররের রিসিক, হায়াত, মৃত্যু সহ সকল কিছুর ফয়সালা।
“আমরা এ কুরআনকে এক বরকতময় ও মর্যাদা সম্পূর্ন রাতে নাজিল করেছি। কারণ আমরা লোকদের সর্তক করতে চেয়েছিলাম। এ রাতে বিজ্ঞ ও হেকমতপূন বিষয়ের ফয়সালা করা হয়।” (সূরা দুখান ৩-৪)
২য় অতীব উচ্চমান, মর্যাদা ও সম্মানের রাত্রি।
এ রাত মর্যাদা ও মূল্যের দিক থেকে, এ রাতে সংগঠিত ঘটনার দিক থেকে, এ রাতে বণ্টনকৃত এবং সংগৃহীত সব ভান্ডারের দিক থেকে হাজার মাস তথ্য হাজার বছরের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-এ রাতের সৎ কাজ হাজার মাসের সৎ কাজের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতে কিয়াম করবে তাকে সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়ার সু-সংবাদ দেয়া হয়েছে। অন্যান্য রাতের মতো এ রাতেও সেই নিদিষ্ট সময়টি আছে যখন দোয়া কবুল করে নেয়া হয়। এ রাতে ইহকাল ও পরকালের যে কোন কল্যান প্রার্থনা করা হয় তা প্রদান করা হয়।
কদরের রাত কেন এবং কোনটি?
প্রকৃত পক্ষে লাইলাতুল কদর উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য একটি মহামূল্যাবান নেয়ামত। পূর্ববর্তী আম্বিয়া কেরাম গনের উম্মত গন দীর্ঘ আয়ু পাওয়র কারণে স্বভাতেই আল্লাহর ইবাদত বেশি বেশি করতে পারতেন। পক্ষান্তরে উম্মাতে মুহাম্মাদী স্বল্প আয়ু পাওয়ার সত্ত্বেও যাতে ইবাদত বন্দেগীর দ্বারা আল্লাহর নৈকন্য লাভে তাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে সেজন্য মহান প্রভু দয়াবারবতা হয়ে এ রজনী আমাদের উপহার দিয়েছেন।
কদরের রাত নির্ধারণ নিয়ে প্রায় ৪০টি মতের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় রমজানের দশ দিনের বেজোর রাত গুলোর মধ্যেই রয়েছে কদর।
হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত- হযরত উবাইদা ইবনে সামেত (রা:) বর্ণনা করেছেন রাসূল (সা.) বলেছেন রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোর রাত গুলোর যেমন-২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ বা শেষ রাতের মধ্যে রয়েছে কদরের রাত)” (মুসনাদে আহমদ)
হযরত আয়েশা (রা:) বলেন নবী (সা:) বলেন- “আমাকে শবেকদর দেখানো হয়েছে তারাপর আমি তা ভুলে গিয়েছি বা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা রমজানের শেষ দশদিনের বিজোর রাত গুলোতে লাইলাতুল কদর সন্ধান কর।” (বুখারী)
এ রাতকে গোপনীয় রাখার রহস্য হল- আল্লাহ্ দেখতে চান এ রাতের বরকত ফজিলত ও কল্যাণ লাভের জন্য কে কতটা প্রচেষ্টা চালায়। আল্লাহ্ তায়ালার উদ্দেশ্য হলো মহামূল্যবান এ রাতের অনুসন্ধানে বান্দাগন সাধনা করুক। এর ফলে যে সুবিধা গুলো হয়েছে-
- এ কারণে আজকেই শবেকদর কিনা ভাবতে ভাবতে অনেক গুলো রাত ইবাদত করার সুযোগ হবে।
- তা না থাকলে এ দিনটি ছুটে গেলে পরবর্তী রাত গুলোতে মন ভরে ইবাদতের মাধ্যমে সে ক্ষতি পুরনের মানসিকতা থাকতো না।
- যতগুলো রাত এভাবে ইবাদতে কাটাবে প্রত্যেকটারই স্বতন্ত্র প্রতিদান মিলবে।
মহিমান্বিত রজনীর নির্দাশনা সমূহঃ
আবু মুনযির (রা:) ও অন্য সাহাবাগণের প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ্র রাসূল (সা:) বলেছেন যে, এই রাতের পরবর্তী সকালে সূর্য আলোক রশ্মিহীন অবস্থায় উদিত হয়।” (মুসলিম)
এ রাতের আরো কিছু নিদর্শন-
১. কদরের রাত মিতিরাচ্ছন্ন হবে না।
২. নাতিশীতোষ্ণ হবে।
৩. মৃদু বায়ু প্রবাহিত হবে।
৪. উক্ত রাতে মুমিনগণ ইবাদত করে অন্যান্য রাত আবোঙ্গা অধিক তৃপ্তি পাবে না।
৫. ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
৬. হয়তোবা আল্লাহ্ তার কোন ইমানদার বান্দাকে তা স্বপ্নে দেখাবেন।
এ রাতের ফজিলত
আবু হুবায়বা (রা:) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন- যে ব্যাক্তি কদরের রাতে ইমানের সাথে এবং আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদতের জন্য দাড়ালো তার পেছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)
এ রাতে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সারারাত শুধু আল্লাহর রহমত, কল্যাণ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ থাকে। ফিতনা, দুষ্কৃতি ও অনিচ্ছাকারীতার প্রভাব তখন ছিটেফোঁটাও থাকে না।
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেছেন- কদরের রাতে ফেরেশতার সংখ্যা পাথর কনার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে ফলে শয়তানের রাজত্ব বাতিল হয়ে যায় এবং সে রাতে লোকেরা শয়তানের ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে।
রাসূল (সা:) বলেন- যখন কদরের রাত উপস্থিত হয় তখন আল্লাহ্ তায়ালা জিবরাঈল (আ:)কে নির্দেশ দেন এবং তদনুযায়ী জিব্রাঈল (আ:) বিরাট একদল ফেরেশতা নিয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। আর তাদের সাথে সবুজ বর্ণের একটা নিশান থাকে। অতঃপর তার নিশানটিকে কা’বা ঘরের মাঝখানে গেড়ে দেন। জিব্রাঈল (আ:) এর একশ’ ডানা (পাখা) আছে, সেগুলোর মধ্যে এমন দু’টি ডানা আছে যা তিনি কদরের রাত ছাড়া কোন রাতে খুলেন না। তিনি সে ডানা দু’টি এই রাতে বিস্তৃত করেন এবং তা পূর্বপ্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি ফেরেস্তাগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ফেরেস্তাগণ ঐ সমস্ত লোককে সালাম করতে থাকে যারা দাঁড়িয়ে, বসে ইবাদত করে আর নামাজ পড়ে এবং যারা আল্লাহকে স্বরণ করে, তারা তার সাথে করমর্দন করে এবং তাদের দোয়ায় ও শামিল হয়ে আমিন আমিন বলতে থাকে উজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। অতঃপর ফজর হলে জিব্রাঈল (আ:) উচ্চস্বরে বলেন, হে ফেরেস্তাগণ! চল, চল, তখন ফেরেস্তাগণ বলে হে জিব্রাঈল আহমদ (সা.) এর মুমিন উম্মতের আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনগুলো সম্বন্ধে আল্লাহ্ তায়ালা কি করলেন? উত্তরে তিনি বলেন আল্লাহ তায়ালা এ রাতে তাদের প্রতি সুদৃষ্টি নিয়োগ করেছেন এবং তাদের ক্ষমা করেছেন। (আত তারগীর, ওয়াত তারহীব)
মহামূল্যবান রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত করা?
রাসুল (সা:) বলেছেন রমজান মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাস হতে উত্তম যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, সে সক্ষ্য কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত, আত তারগীব)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বণির্ত, রাসুল (সা.) বলেছেনÑ আল্লাহ কদরের রাতে উম্মতে মুহাম্মদীর দিকে তাকান এবং তাদেরকে ক্ষমা ও দয়া করেন তবে চার ব্যক্তি দয়ার আওতায় পড়ে না-
১. মদ পানকারী ২. পিতা-মাতার সাথে সর্ম্পক ছিন্নকারী ৩. হিংসুক-নিন্দুক ৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী।
অন্যদিক এ যারা বিশ্বাসগত ভাবে মুনাফিক, ইসলাম ও কুফরের সাথে যখণ যেটা প্রয়োজন সেটাকে গ্রহণ করে, এরাতে তারাও বঞ্চিত হবে।
তবে তারা যদি খালেস ভাবে তওবা করে পবিত্র জীবন যাপনের চেষ্টা করে আল্লাহ নিজ করুনা ও দয়ার মাঝে তাদের ও শামিল করবেন।
এ রাতে আমাদের করণীয়-
আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত- রমজানের শেষে দশক শুরু হলে রাসূল (সা:) কদরের রাত লাভের উদ্দেশ্যে পূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন, রাত্রি জাগরণ করতেন এবং নিজ পরিবারকে জাগাতেন।” (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:) রমজানের শেষ দশকে এত বেশি পরিশ্রম ও ইবাদত করতেন যা তিনি অন্য সময়ে করতেন না। তিনি রমজানের শেষ দশকে কে এমন কিছু নেক কাজের জন্য নির্দিষ্ট করতেন যা মাসের অবশিষ্টারশের জন্য করতেন না। এর মধ্যে রাত্রি জাগরণ অন্যতম।” (মুসলিম)
হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত- রাসুল (সা:) বিছানা উঠিয়ে ফেলতেন, স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকতেন এবং ভোর রাতে সেহরীর সময় সন্ধ্যাবেলার খাবার খেতেন।” (তারবানী)
তাই আমরা যা করতে পারি-
- রাতের ১ম অংশেই এশার সালাত আদায় করা।
- রাতের কিছু অংশ কোরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা।
- বিশেষ অংশে তারাবীহ, নফল, তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা।
- বেশি বেশি যিকির, দরুদ, তাসবীহ পাঠ করা।
- তাওবা, ইস্তেগফার ও আল্লাহ্র কাছে কান্নাকাটি করা।
- দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য দু’আ করা।
- প্রয়োজনে বিশ্রাম নেয়া, সেহরী খাওয়া ও ফজরের সালাত আদায় করা।
- রাসূল (সা:) আয়েশা (রা:)কে এ রাতে যে সংক্ষিপ্ত ও ব্যাপক অর্থবোধক, তাৎপর্যপূর্ণ দোয়াটি শিখিয়ে দিয়েছেন সেটা পড়া-
“আল্লাহুম্মা ইন্নকা আফুয়ান তুহীব্বুন আফওয়া ফা কু আন্নী।”
অর্থ- “হে আল্লাহ! তুমি মহান ক্ষমাশীল। ক্ষমা প্রার্থনা তোমার নিকট খুবই প্রিয়। অতএব আমাকে ক্ষমা কর।”
আমিন! আমিন! আমিন!