জাতীয় খেলা কাবাডির নতুন শুরু

-মাহাথির মোহাম্মদ কৌশিক
শুধুমাত্র কথা দিয়েই নয় স্বাধীনতা কাপ কাবাডির মূল পর্ব গড়িয়ে ফাইনাল শেষ হয় তখন বোঝা গেছে জাতীয় খেলা হিসেবে কাবাডি একটু একটু করে ঘুরে দাড়ানোর রাস্তায় রয়েছে। কর্মকর্তারা শুধু কথা দিয়েই সন্তুষ্ট রাখতে চাননা। আগে কোন লিগ কিংবা টুর্নামেন্ট এতটা জমজমাট হয়, এবার এক স্বাধীনতা কাপে যা হয়েছে। এমনিতেই কাবাডি মাঠেই খেলাটা হয়ে থাকে। সেখানে ম্যাটে নিয়মিত পারফর্ম করে থাকেন রাইডাররা। মিরপুর ইনডোর ষ্টেডিয়াম সেখানে বড় চমক হয়েই দেখা দিয়েছিল। জামজমকভাবে আয়োজনের পাশাপাশি দর্শকদের উপস্থিতি বাড়াতেই ক্রিকেটের মতোই মিরপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবারের আসর। সেখানেই নতুনত্বের বার্তা নিয়ে শুরু হওয়া আসরটি শেষ হয়েছে প্রত্যাশার ঢালি ছড়িয়ে। সেখানে শেষ হাসি হেসেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। ফাইনালে তারা ২৯-২৭ পয়েন্টে হারিয়েছে বাংরাদেশ নৌবাহিনীকে। ফলাফল দিয়েই বোঝা যাবে কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে স্বাধীনতা কাপের আসর। সেখানেই নতুন স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছে।
নিয়মিত আয়োজনেই তাই ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করা খেলাটি এবার নিয়ে আসছে নতুন স্বপ্ন নিয়ে। জাতীয় খেলা হলেও কাবাডির পরিচিতি, জনপ্রিয়তা আর সাফল্য কমছে আশংকাজনকহারে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরের বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক অচেনা খেলার নাম কাবাডি। বইয়ে পড়ে যতটা জানা যায় তাতেই থাকতে হয় সন্তুষ্ট। কিন্তু এতে করে যে খেলাটি তার ঐতিহ্য হারিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এশিয়ান গেমসে তো নয়ই এসএ (সাউথ এশিয়ান) গেমসেও বড় কোন সাফল্য নেই অনেকদিন হলো।
এবার সেই সাফল্য পেতে নতুন নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়ে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের অন্তর্বর্তীকালীন অ্যাডহক কমিটি। দায়িত্ব নিয়ে স্বাধীনতা দিবস কাবাডিকে দেওয়া হয়েছে নতুন প্রাণ। আগে যেখানে শুধু রাজধানীতে কয়েকটি সার্ভিসেস দল নিয়ে নামকাওয়াস্তে আয়োজন করা হতো এবার তাতে এসেছে নতুনত্ব। এক টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে সারা বাংলাদেশে। ৪৬০টি উপজেলায় প্রাথমিক পর্ব আয়োজন করা হয়েছিল। তার আগে অনেক উপজেলায় খেলোয়াড় বাছাই করার জন্য ইউনিয়নব্যপী আয়োজিত হয়েছে এবারের আসর। এখন চলছে চূড়ান্ত পর্ব। আর এতেই নতুন দিনের সূচনা করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের কোনো কাবাডি ম্যাচ ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়নি। স্বাধীনতা দিবস কাবাডির চূড়ান্ত পর্বে এই প্রথম তেমন ঘটনাই ঘটছে। অবহেলিত জাতীয় খেলা কাবাডির জন্য যা একেবারেই নতুন। টুর্নামেন্টটি আয়োজনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে মিরপুর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়াম। সেখানে রঙিন একটা আবহ তৈরির চিন্তা আছে। ফুটবল কিংবা ক্রিকেটের মতো এলইডি টিভি স্ক্রিন ছিল মাঠে। ভারতের প্রো-কাবাডি লিগে এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। ক্রিকেটের দেশের মতো বিশাল কোনো আয়োজন বাংলাদেশে হওয়াটা একেবারেই অসম্ভব কাজ। তবে দিনে দিনে অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কাবাডির গায়ে কিছুটা রঙ্গিন আবহ তৈরি করতেই ব্যতিক্রমী এই আয়োজন।
সম্প্রতি বিশৃঙ্খলা, অদক্ষতা আর দুর্নীতির অভিযোগে কাবাডির নেতৃত্ব বদলে নতুন অ্যাডহক কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটিই এবারের স্বাধীনতা দিবস কাবাডিকে ছড়িয়ে দিয়েছে তার চেনা গন্ডির বাইরে। আর এই প্রথম একটি ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে কাবাডির ঘরোয়া টুর্নামেন্টে।
এই টুর্নামেন্টে এত দিন খেলত সার্ভিসেস দলগুলো। প্রচারের আলোর বাইরে কেমন যেন নিষ্প্রাণ ছিল টুর্নামেন্ট। আন্তর্জাতিক আসরগুলোতে যার ফলও ছিল স্পষ্ট। ৫২০৮ জন খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কোনো কাবাডি টুর্নামেন্টে যেন হার মানিয়েছে কল্পনাকে। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ যদিও অনেক বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়। তবে উপজেলা পর্যায়ে কখনোই সেই আসরকে নিয়ে যাওয়া যায়নি। জেলা পর্যায় থেকে শিরোপাধারী দলগুলো আসে বিভাগীয় পর্যায়ে। আট আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নের শীর্ষ তিন দলকে আবার বেছে নেওয়া হয় পরবর্তী ধাপের জন্য। সেই তিন দলের সঙ্গে চূড়ান্ত পর্বে যোগ হয় সাতটি সার্ভিসেস দল। বাংলাদেশের কাবাডি বিশ্বকাপ, এশিয়ান গেমস, বিচ গেমসে বারবরই ব্যর্থ এক দলে পরিণত হয়েছে। কাবাডিতে ভালমানের খেলোয়াড় না থাকায় দুর্দিন চলছে গ্রামে-গঞ্জে হাডুডু খেলা হিসেবে পরিচিত। বছরে কিছু টুর্নামেন্ট ও লিগ করে শেষ করত ফেডারেশনের গত কমিটিগুলো। খেলাটির উন্নতিতে ২০১৮ সালের ইন্দোনেশিয়া এশিয়ান গেমসে রুপাকেন্দ্রিক পরিকল্পনা নিয়েছে অ্যাডহক কমিটি। অনেকটাই নতুনত্ব নিয়ে এসেছে বর্তমান কমিটি। যার সভাপতি পুলিশের মহা পরিদর্শক একেএম শহিদুল হক বলেন, ‘জাতীয় খেলা হিসেবে কাবাডির পুরনো দিন ফিরিয়ে আনসতে চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। দক্ষ-নতুন খেলোয়াড় তৈরি, দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় দলের জন্য গড়ে তোলা হবে। পাইপলাইনে পর্যাপ্ত খেলোয়াড় থাকলে সংকট থাকবে না।
অনূর্ধ্ব-১৪ বালক ও বালিকাদের জাতীয় স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপ এবং অনূর্ধ্ব-১৮ আইজিপি কাপ নিয়মিত করব’। এদিকে কাবাডি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিকেএসপিকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি। জাতীয় খেলা কাবাডি এক সময় আন্তর্জাতিক আসরে পদক জয়ের ধারাবাহিকতায় ছিলো জাতীয় পুরুষ ও মহিলা কাবাডি দলের। কিন্তু বর্তমানে বিবর্ণ দেশের কাবাডি।
আন্তর্জাতিক আসর থেকে পদক জয় তো দূরের কথা, এখন নিজেদের সুনাম রক্ষা করতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। যদিও এরই মধ্যে গত বছর গৌহাটি-শিলং সাউথ এশিয়ান গেমস থেকে বাংলাদেশ মহিলা দল রৌপ্যপদক জয় করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। অন্যদিকে ব্রোঞ্জপদক জিতে কোন রকমে মান বাঁচিয়েছে পুরুষ দল। তবে বিশ্বকাপ কাবাডিসহ অন্য আসরে ব্যর্থ বাংলাদেশ। এ ব্যর্থতা কাটাতেই এবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কাবাডি ফেডারেশন। বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ও কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি একেএম শহিদুল হকের নেতৃত্বাধীন নতুন অ্যাডহক কমিটির প্রত্যয় লাল-সবুজ কাবাডির হারানো গৌরব ফেরানো। গত বছর আইজিপি কাপ থেকে ৩৯ জন খেলোয়াড় বাছাই করা হয়েছিল। কিন্তু আগের কমিটির অব্যবস্থাপনায় তাদের পরিচর্যা করার মাধ্যমে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
তবে এবার খেলোয়াড় বাছাই করে তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এদেশের কাবাডির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছে ফেডারেশনের কর্মকর্তারা। ফেডারেশন সূত্রে জানা গেছে, দেশের কাবাডিকে এগিয়ে নিতে করা হয়েছে বর্ষপঞ্জি। সেই অনুযায়ী বছরে ১১টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হবে। এমন আয়োজনের মাধ্যমেই জাতীয় এ খেলাটির সুদিন ফিরে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্বাধীনতা দিবসের পুরো আসরেই জমজমাট ছিল মিরপুর ইনডোর ষ্টেডিয়াম।
চারদিকে রঙিন আলো। ম্যাটের পাশে ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে ভেসে উঠেছে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের নাম, টুর্নামেন্টের লোগো। অদূরে দৈত্য পর্দায় দেখানো হচ্ছে দুই দলের স্কোর। খেলার বিরতিতে উচ্চগ্রামে গান বাজছে। সরাসরি খেলা সম্প্রচার হচ্ছে ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকে। আলো-আঁধারীতে কাবাডি খেলার এমন অভিজ্ঞতা দেশের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের জন্যই প্রথম। ভারতের পেশাদার লীগ প্রো-কাবাডিতে খেলেছেন বলে জিয়াউর রহমান, আরদুজ্জামানদের মতো কয়েকজনের এমন পরিবেশের সঙ্গে একটু পরিচয় আছে। গত বছর ভারতে সর্বশেষ বিশ্বকাপে আহমেদাবাদের ইনডোরে এভাবে খেলেছে জাতীয় দলও। কিন্তু অন্য খেলোয়াড়দের চোখে মিরপুর শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ইনডোরকে এক স্বপ্নরাজ্যই হয়তো মনে হয়েছে।
মনে হয়েছে সেখানে স্বাধীনতা দিবস কাবাডির চূড়ান্ত পর্বের জন্য। পাঁচ দিনব্যাপী প্রতিযোগিতায় দুই গ্রুপে অংশ নিয়েছিল ১০টি দল। ফেডারেশন এই টুর্নামেন্টকে বলছে প্রো-কাবাডির মহড়া। পেশাদারির এই যুগে বাংলাদেশের কাবাডি খেলোয়াড়দের ভাগ্য এখনো সার্ভিসেস সংস্থার হাতে। পুলিশ, জেল, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবির দাপটই এখানে বেশি। সাধারণ খেলোয়াড়েরা শখের বশেও কাবাডিতে আসতে চান না। কিন্তু চাকরির সুবাদে এই খেলাটাকে প্রতিদিনের ‘ডিউটির’ অংশ বলে ধরে নিয়েছেন খেলোয়াড়েরা। তবে শিগগিরই বাংলাদেশের কাবাডি ইতিহাসে যোগ হতে পারে নতুন অধ্যায়। ভারতের আদলে এবার প্রো-কাবাডির আয়োজন করতে চায় ফেডারেশন। কিছুদিন পূর্বে দায়িত্ব নেওয়া অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান পুলিশের বড় কর্মকর্তা (অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক) হলেও খেলাধুলায় ভীষণ উৎসাহী। স্বপ্ন দেখছেন প্রো-কাবাডি আয়োজনের। পাশাপাশি নতুনত্ব হিসেবে চলচিত্র তারকাদের নিয়ে আসা হয়েছিল খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতে। মার্শাল আর্ট হিরো রুবেল থেকে শুরু করে হাল আমলের ফেরদৌস, মৌসুমী, রিয়াজ, জায়েদ খানরা এসেছিলেন। এবার দেখা যাক জাতীয় খেলার হারানো দিন ফিরে আসে কিনা।