কোরিয়ায় যুদ্ধ যদি লাগেই...
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : ফের যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে কোরীয় উপদ্বীপে। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষেরা এটা বিশ্বাস করতে চান না যে, এই যুগে কেউ পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে পৃথিবীতে যুদ্ধের সূচনা করবে। কিন্তু কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধ যেন ঠোঁট এবং দাঁতের মতো কাছাকাছি চলে এসেছে। সম্ভাব্য এই যুদ্ধে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতা তৈরির সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদি যুদ্ধ লাগেই তাহলে বিশ্বব্যাপী এমন সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যার কিছু আমরা ধারণা করতে পারি, আর কিছু ধারণারও বাইরে। দীর্ঘকাল ধরেই উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে দখলে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসছে। এটা কোনো অজানা ব্যাপার নয়। সে আশঙ্কা থেকেই দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থাপন করা হয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। ১৯৫০ থেকে ৫৩ সাল পর্যন্ত কোরিয়ায় যুদ্ধ হয়েছে। তারপর জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি যুদ্ধ বিরতি রেখাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আর তখন থেকেই সে রেখা নিশ্চিত করার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় মোতায়ন আছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মার্কিন সেনা। তারা ২৪ ঘণ্টা উত্তর কোরিয়ার তৎপরতার উপর নজর রাখছে।
এখন উত্তর কোরিয়া আন্তর্জাতিক বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে ব্যাপকভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে। ফলে চীনও আশঙ্কিত যুদ্ধের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। আর সে কারণেই এই বিপদ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে কোরিয়ায় যুদ্ধ বিষয়টি বেশ জটিল। পুরো কোরিয়া উপদ্বীপ পর্বত দিয়ে ঘেরা। এটি প্রশস্ত আড়াই শ’ কিলোমিটার এবং এর দৈর্ঘ্য ১০০০ কিলোমিটার। এখানে সমতল ভূমি খুবই কম। যেটুকু আছে, তাও জলাভূমি ও কৃষি জমি। ফলে এখানে বড় ধরনের কৌশলগত যুদ্ধ বেশ কঠিন। ট্যাঙ্ক নামিয়ে একে অপরকে শায়েস্তা করার কাজও সহজ নয়। উভয়পক্ষের সৈন্যদের সামরিক সামর্থ্য সমান সমান। এটিও যুদ্ধের জন্য একটি ফ্যাক্টর। যুদ্ধ বিরতি রেখা চার কিলোমিটার প্রশস্ত ও আড়াই শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ। কৌশলগত অবস্থানের দিকে থেকে এর পশ্চিমে রয়েছে পীত সাগর আর পূর্বে জাপান সাগর।
আর পরিহাসের বিষয় এই যে, যুদ্ধ বাধলে খুব দ্রুতই সেই যুদ্ধে ভারতকে জড়িয়ে পড়তে হবে। কারণ সম্প্রতি সম্পাদিত ভারত-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন বাহিনীর জন্য ভারতীয় জলপথ, স্থলপথ এবং আকাশপথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে ওয়াশিংটন এই সুবিধা ব্যবহার করবে। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবে এবং একই সঙ্গে তারা দক্ষিণ কোরিয়া দখলের অভিযানে নামবে। উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার রয়েছে ১০ লাখ করে সৈন্য, বিশ হাজার সাঁজোয়া গাড়ি ও আর্টিলারি কামান। উভয়েই পুঁতে রেখেছে কমপক্ষে দশ লাখ মাইন আর সীমান্তের উভয় পাশে তৈরি করা আছে কংক্রিটের হাজার হাজার বাঙ্কার। যুদ্ধ বাধলে যুদ্ধবিরতি রেখা থেকে এক শ’ পঁচিশ কিলোমিটার দূরে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ং-এর দিকে ছুটে যাবে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র। তেমনি যুদ্ধ বিরতির রেখা থেকে মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজধানী সিউলের দিকেও ছুটে যাবে ক্ষেপণাস্ত্র বহর।
যুক্তরাষ্ট্র বা দক্ষিণ কোরিয়া যদি পিয়ংইয়ং এর কোনো পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করে বসে, তাহলে গোটা অঞ্চল জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে। উত্তর কোরিয়া একে পারমাণবিক হামলা বলে উল্লেখ করে প্রতিশোধ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ায় সরাসরি পারমাণবিক হামলা চালাবে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া তার ৬৫ ভাগ সামরিক ইউনিট এবং প্রায় ৮০ ভাগ যুদ্ধাস্ত্র যুদ্ধ বিরতি রেখা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে মোতায়েন করে রেখেছে। সংখ্যার হিসাবে উত্তর কোরিয়া যে কোনো সময় সাত লাখ সৈন্য, আট হাজার আর্টিলারি কামান ও ২ হাজার ট্যাঙ্ক নামিয়ে দিতে পারে। উত্তর কোরিয়ার ধারণা, এভাবেই তারা দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল দখল করে দুই কোয়িায়াকে এক করে ফেলতে পারবে। কিন্তু পিয়ংইয়ং-এর এই পরিকল্পনা সহজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাসহ দক্ষিণ কোরিয়ারও রয়েছে ৬ লাখ ৮৬ হাজার সৈন্য, তাছাড়া সঙ্কটকালে তারা আরও ৪৫ লক্ষ লোককে সৈন্য হিসেবে নামাতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার নিজেস্ব সৈন্য সংখ্যা উত্তর কোরিয়ার অর্ধেক। তবে তাদের রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অধিকতরও উন্নতমানের যুদ্ধাস্ত্র, তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে বিমান ও নৌ বাহিনীর সহায়তা দিতে পারবে।
প্রয়োজন হলে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য আরও সৈন্য সরবরাহ করতে পারে। আর দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভূরাজনৈতিকভাবে অপরিহার্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের (১৯০১-১৯০৯) আমল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেদেরকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তি হিসেবে দেখতে চেয়েছে। আর সে কারণেই রুজভেল্ট প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ব্যাপক প্রভাব বলয়ের সৃষ্টি করেন। সেই লক্ষ্যেই স্পেন থেকে ফিলিপাইনস্, গুয়াম থেকে হাওয়াই পর্যন্ত প্রভাব বলয় তৈরি করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার উপকূলে বিমানবাহী জাহাজ পাঠিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া ২ হাজার ট্যাঙ্ক, ৩০০ এফ৫, এফ১৫ ও এফ১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে রেখেছে। ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার লক্ষ্যগুলোতে ব্যাপক বোমা হামলার নির্দেশ দিতে পারেন। তা যে তিনি পারেন, তার প্রমাণ মিলেছে আফগানস্তানে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে। সেখানে তিনি ১০ টন ওজনের এমওএবি বোমার পরীক্ষামূলক বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছেন।
এ রকম পরিস্থিতিতে কারণ যাই হোক না কেন, চীন যদি এই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তাহলে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী যে কোনো চীনা হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক সুবিধা দেবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উন্মাদনায় নিজেদের কতটা মুক্ত রাখতে পারবে, সেটা তার কৌশলের উপর নির্ভর করবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে উত্তর কোরিয়ার কোনো ক্ষেপণাস্ত্র যদি ভারতে আঘাত করে বসে তাহলে সেই সুযোগে পাকিস্তান কাশ্মীর দখল করে নিতে পারে।
উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। তারা বলছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধসহ যে কোনো যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত। উত্তর কোরিয়ার বর্তমান নেতা কিম জং উন ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তার দেশের পারমাণবিক অস্ত্রের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে সক্ষম এমন বেশকিছু রকেট উত্তর কোরিয়া পরীক্ষা করেছে। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সম্ভাব্য যুদ্ধে মার্কিন সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করে ভারত বা জাপানে আঘাত হানতে তারা কসুর করবে না। গবেষকরা বলছেন, পিয়ংইয়ং এর কমপক্ষে ২০টি পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার রয়েছে। তবে এটা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
উত্তর কোরিয়ায় মহাকাশ যান উৎক্ষেপণের জন্য তায়েফডং-২ অস্ত্রাগার নির্মাণ করেছে। এর মাধ্যমে তারা পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারবে। তাছাড়া উত্তর কোরিয়ার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ১১,৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। দু’সপ্তাহ আগে তারা এমন একটি পরীক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। এছাড়াও উত্তর কোরিয়া তাদের নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম। তা যদি হয়, তাহলে ঐ অস্ত্র মার্কিন উপকূলে আঘাত হানতে পারবে এবং সেখানকার শহরগুলোতে ব্যাপক ত্রাসের সৃষ্টি করতে পারবে। আবার এ কথাও সত্য যে, উৎক্ষেপণের পরপরই এসব অস্ত্র চিহ্নিতকরণ ও ধ্বংসকরণের সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের মৈত্রীবন্ধন দীর্ঘদিনের। ১৯৫০ সালে যখন কোরিয়ায় যুদ্ধ বাধে, তখন চীনা নেতা মাও সেতুং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কোরিয়ায় তার পিপল্স লিবারেশন আর্মি পাঠিয়েছিলেন। তবে গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা অনেক বেড়েছে। আর বেড়েছে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও। বেইজিং চেষ্টা করেছিল, উত্তর কোরিয়া যেন আর কোনো নতুন পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা না করে। কিন্তু পিয়ংইয়ং সে কথা শোনেনি। আর তার ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধের জন্য প্রস্তুুতি ঘোষণা করেছেন। চীন এই যুদ্ধে ঘোরতর বিরোধিতা করছে। তাদেরও ভয়, যুদ্ধ বাধলে লাখ লাখ কোরীয় আশ্রয়ের জন্য চীনে গিয়ে হাজির হবে। এতে আরও একটি বিষয় ঘটতে পারে। তা হলো যুক্তরাষ্ট্র যদি দেখতে পায় যে, চীন উত্তর কোরিয়ায় জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে তাহলে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হবে। উত্তর কোরিয়ার ৬০ শতাংশ বাণিজ্যই চীনের সঙ্গে। আর সেই কারণেই শত্রুর দৃষ্টি এড়াতেই উত্তর কোরিয়া চীনের আকাশ ও ভূমি ব্যবহার করতে পারে।
আমাদের জন্য বিপদের এটাই কারণ। এর ফলে কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধ যেমন ছড়িয়ে পড়তে পারে, তেমনি তা সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে। বিশ্বের মোট জিডিপি’র অর্ধেকের উৎস এশিয়া। আর চীন সামরিক ও অর্থনীতির দিক থেকে এশিয়ায় সব থেকে শক্তিশালী দেশ। আবার যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশ হয় এশিয়ায়। তাদের কৃষি পণ্যের মোট ৭২ ভাগ রপ্তানি হয় এশিয়ায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরীক্ষা এখানেই। অনেকেই মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক শক্তিকে দমিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার উপর এই নির্ভরতা কমিয়ে দেবে। এদিকে ট্রাম্প আবার এটা কমাতে গিয়ে একঘরে হয়ে পড়েন কিনা, সেটাও লক্ষ্য রাখার বিষয়। তবে এটাও ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন পৃথিবীর যেখানে-সেখানে বোমা ফেলতে শুরু করেছে। সুতরাং যে যেখানে পারে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা তো করবেই।