শনিবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

বিচারহীনতার মর্মস্পর্শী প্রতিবাদ

মাত্র আট বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন পিতার আত্মহত্যার খবরে সারা দেশে আলোড়ন উঠেছে। গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত ২৯ এপ্রিল সকালে ঘটনা যিনি ঘটিয়েছেন তার নাম হজরত আলী। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কর্ণপুর ছিটপাড়া গ্রামের গরীব রাজমিস্ত্রী হজরত আলী ও তার স্ত্রী হালিমা বেগমের কোনো সন্তান ছিল না। তারা আয়েশা আক্তার নামের এক শিশুকে নিজেদের কন্যা হিসেবে লালন-পালন করে আসছিলেন। মেয়েটি হেরাপটকা প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী ছিল। কিন্তু এতটুকু একটি মেয়েও নির্বিঘেœ স্কুলে যাতায়াত করতে পারতো না। স্থানীয় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে তাকে উত্ত্যক্ত করতো। বিষয়টি সম্পর্কে গ্রামের লোকজন জানতো। এ ব্যাপারে হজরত আলী ওই যুবকের পিতার কাছে নালিশ করেছিলেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছে। গরীব একজন মজুরের নালিশকে ধৃষ্টতা হিসেবে দেখেছে ওই প্রভাবশালী পরিবার। অন্যদিকে প্রভাবশালী ব্যক্তির কীর্তিমান ছেলে শিশু আয়েশা আক্তারকে জোর করে সাইকেলে উঠিয়ে নিয়ে গেছে জঙ্গলের ভেতরে। সেখানে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়েছে আট বছরের শিশুটিকে। এতে জড়িত ছিল একাধিকজন। দিন শেষে প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে আয়েশাকে রক্তাক্ত অবস্থায় তার বাড়ির কাছে ফেলে রেখে গেছে।
মেয়ের অবস্থা দেখে ক্ষোভে ও দুঃখে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন হজরত আলী। তিনি নালিশ জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন সেই প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে। কিন্তু প্রতিকার পাওয়ার পরিবর্তে তাকে উল্টো গালমন্দ ও ধমক শুনতে হয়েছে। হজরত আলী এরপর স্থানীয় ইউপি সদস্যের কাছে গেছেন। সেখানেও তাকে নিরাশই হতে হয়েছে। থানায় গিয়েও পুলিশের কাছে কোনো প্রতিকার পাননি হজরত আলী। অভিযোগ রয়েছে, অপরাধী প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে হওয়ায় পুলিশ নাকি হজরত আলীকেই ধমকে দিয়েছে। তাছাড়া ধর্ষণের অভিযোগও আমলে নেয়নি পুলিশ। খবরে বলা হয়েছে, ধর্ষণ সংক্রান্ত খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকলে পুলিশ এবং ইউপি সদস্যসহ বিভিন্নজনের মাধ্যমে হজরত আলীর ওপর চাপ সৃষ্টি করার পাশাপাশি নগদ অর্থের প্রলোভনও দেখানো হয়েছিল। তাকে এক হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু টাকার বিনিময়ে মেয়ের ইজ্জতের সওদা করতে রাজি হননি হজরত আলী। ক্ষুব্ধ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তার লোকজন তখন হজরত আলীর গরু চুরি করেছে। শুধু তা-ই নয়, গরুটি জবাই করে তারা হজরত আলীর বাড়ির পাশে বসেই রান্না করে খেয়েছে। সবই ঘটানো হয়েছে হজরত আলীকে দেখিয়ে দেখিয়ে। এভাবেই তাকে নাকি ‘শিক্ষা’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, যাতে তার সঙ্গে গ্রামের অন্য লোকজনও বোঝে, ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর পরিণাম কতটা মারাত্মক হতে পারে। তাকে গ্রাম থেকেও তাড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তার লোকজন। এভাবে সব দিক থেকেই হজরত আলীকে বিপন্ন করা হয়েছিল। তিনি অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। বলা হচ্ছে, এটাই শিশুকন্যাকে নিয়ে হজরত আলীর আত্মহত্যা করার প্রধান কারণ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গাজীপুরের কর্ণপুর ছিটপাড়া গ্রামের গরীব রাজমিস্ত্রী হজরত আলীর এই আত্মহত্যার ঘটনাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এর মধ্য দিয়ে সমাজের পচন ও অধঃপতন যেমন প্রাধান্যে এসেছে তেমনি এসেছে বিচারহীনতার দিকটিও। একজন আট বছরের শিশুও নির্বিঘ্নে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে না এবং প্রতিবাদ জানালে তাকে ধর্ষণের শিকার হতে হবে- এমন অবস্থা কোনো রাষ্ট্র বা সমাজের জন্যই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অথচ সেটাই ঘটেছে রাজধানী থেকে দেখা যায় এমন দূরের একটি গ্রামে। পর্যালোচনায় পরিষ্কার হয়েছে, ঘটনাপ্রবাহে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে অনেকেই। প্রভাবশালী নামে বর্ণিত ব্যক্তির দুর্বৃত্ত ছেলে তো বটেই, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে উল্টো বিপন্ন পিতাকে প্রথমে ধমক দেয়ার পর মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে শিশুটির ইজ্জত কিনে নেয়ার প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমেও ওই ব্যক্তি ঘৃণ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। ইউপি সদস্য থেকে পুলিশ পর্যন্ত সকলেই বিচারহীনতার নজীরই স্থাপন করেছেন। একই কারণে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকেও স্বীকার করতে হয়েছে, হজরত আলীর আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা দেশ ও সমাজের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।
আমরাও মনে করি, সবই সম্ভব হয়েছে আসলে দেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে। মেয়েরা, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত নির্বিঘেঘ্নে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে না, তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে, তারা ধর্ষণেরও শিকার হবে- এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে দেয়া যায় না। শুধু তা-ই নয়, বিচার চাইতে গিয়ে শিশুর পিতাকে উল্টো লাঞ্ছিত হতে হবে, তার ওপর নেমে আসবে নির্যাতনের খড়গ এবং তাকে এমনকি গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়ারও চেষ্টা চালানো হবেÑ এসবের কোনো একটিও সভ্য সমাজের লক্ষণ নয়। আমরা তাই কর্ণপুর ছিটপাড়া গ্রামের হজরত আলীর আত্মহননের মর্মস্পর্শী সম্পূর্ণ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানাই। কথিত ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তার দুর্বৃত্ত ছেলের পাশাপাশি ইউপি সদস্য এবং থানায় কর্তব্যপালনরত পুলিশ সদস্য পর্যন্ত সকলের বিরুদ্ধেই আইনত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা চাই, দেশে আর কোনো শিশুকন্যাকে যাতে আয়েশা অক্তারের পরিণতি বরণ করতে না হয় এবং আর কোনো অসহায় পিতাও যাতে হজরত আলীর মতো আত্মহত্যার পথে পা বাড়াতে বাধ্য না হন। একথা বুঝতে হবে যে, অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলেই এমন মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটতে পেরেছে। জীবন বিসর্জন দেয়া হজরত আলী ও তার মেয়ে আয়েশা আসলে বিচারহীনতার বিরুদ্ধে মজলুমের মর্মান্তিক পরিণতির প্রতীক। সেই সাথে জ্বলন্ত প্রতিবাদও। যারা আমরা সুশাসনের কথা বলি এই প্রতিবাদ তাদের বিরুদ্ধে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ