সোমবার ০৫ জুন ২০২৩
Online Edition

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে ফজলে রাব্বী দ্বীন

পহেলা বৈশাখ। বাংলা নতুন বছরের প্রথম মাস। ঋতুরাজ বসন্তকে বিদায় জানিয়ে আনন্দের নববর্ষটাকে প্রাণমনে উদযাপিত করার জন্য আমাদের সামনে হাজির হয়েছে বৈশাখ। চারদিকটায় কেবল খুশির বন্যায় ভাসছে। রঙে রঙে রঙিন হওয়া সব বয়সের মানুষই চোখে মুখে আঁকছে স্বপ্নীল ছবি। সুখ-দুঃখের ক্লান্ত অতীতকে এখন আর ভাবার সময় নেই। এখন শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। সামনের দিকে ধাবিত হবার সময় এসেছে। নববর্ষ সবাইকে এই বিষয়টিই শিক্ষা দেয়। সকল প্রকার হিংসা বিদ্বেষ, ঝগড়া বিবাদ পথচলার ধুলোয় যেন সব নিঃশেষ হয়ে যায়। পারস্পরিক ভালবাসার বন্ধনটাকে শক্ত করে বাঁধতেই বৈশাখের আমন্ত্রণ।
বাংলা নববর্ষ প্রতিষ্ঠা করেছেন মুঘল সম্রাট আকবর। ১৫৫৬ সালে ঐতিহাসিক পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বৈরাম খাঁন কর্তৃক হিমু পরাজিত হওয়ার পর মসনদে নিজের অভিষেক ঘোষণা করেন। এটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন এবং বাংলা নববর্ষের প্রচলন করেছিলেন। সেই থেকে বাঙালি জাতি বৈশাখের প্রথম দিনটাকে নানান উৎসব আনন্দের মধ্য দিয়ে পালন করে। এই দিনটাতে বাঙালির খাবার তালিকায় থাকে পান্তা ভাত, পিঁয়াজ, পোড়া মরিচ সাথে ইলিশ ভাজা। মিলেমিশে খাওয়া দাওয়ার দারুণ আয়োজনটা সবার হৃদয়টাকেই সতেজ করে তুলে। গ্রাম গঞ্জ শহর নগর হাট বাজার সব জায়গাতেই উৎসবের মেলা বসে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মেলাতে যাওয়ার জন্য বড়দের  কাছে গিয়ে বায়না ধরে। বড়দের কাছ থেকে কিছু কিছু করে টাকা তুলে অনেকগুলি টাকা জমা করে মেলাতে গিয়ে সব খরচ করে। আতিপাতি অনেক খেলনা জিনিস কিনে তৃপ্ত হয় তারা। মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় চড়লেই যেন না হয়! লাল সাদা পোশাক পরে সবার জমকালো সাজে মুখরিত হতে থাকে সারাদিন।
বৈশাখে বাংলার মুখ আরও সবুজ হয়ে যায়। মাঠ ঘাট ভরে উঠে ফসলের সিক্ত জোয়ারে। ফসলের মাঠের এককোণায় দাঁড়িয়ে সারা মাঠের বিশেষ করে ধানক্ষেতের উপরে বাতাসের তুমুল মুগ্ধ সুরের ঢেউখানা একবার দেখলে পাগল না হয়ে কি কেউ পারবে! কৃষকের মনে খুশির যেন সীমা নেই এই বৈশাখে। কৃষক বধুর চপল চোখে স্বপ্নের হাতছানি খেলা করতে থাকে। নববর্ষে গ্রাম গঞ্জের মানুষেরা নতুনের সাজে সেজে উঠে। পরনের নতুন জামা কিনতে না পারলেও পরিষ্কার জামা পরিধান করতে ভুল করেনা কেউ। তবে তারা শহরাঞ্চল মানুষদের মত পান্তা ভাত আর ইলিশ খেয়ে নয় সারাদিন ভালো ভালো খাবার খেয়ে দিনটাকে পার করে। তারা ভাবে বছরের এই প্রথম দিনটায় যা যা করা যাবে সারা বছর সেই এই রকমভাবেই জারি থাকবে। সুন্দর এই ভাবনাটা যুগ যুগ ধরে গ্রাম গঞ্জের সরল সোজা মানুষদেরকে আলোড়িত করে আসছে। তারা নববর্ষের এমন সুন্দর দিনটাকে ভালো কাজ দিয়ে পার করে। গ্রাম গঞ্জে নানান ধরনের ঐতিহ্যের খেলাগুলো আয়োজন করা হয় এই দিনে। বৈশাখে গাছ গাছালি ফুল ফলে ভরা থাকে। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা আরও মজার মজার যত ফল আছে সবই এই বৈশাখেই চোখ মেলে। তবে বেশ কিছু ফল আছে যেগুলো পাকে জ্যৈষ্ঠতে। বৈশাখে কাঁচা কাঁচা ফলগুলি খেতে যে কি স্বাদ তা ভাবতে গেলেই জিভে পানি এসে যায়। এ সময়ে প্রকৃতির কিছু বাধাবিঘœতাও সামনে এসে দাঁড়ায়। চলার পথকে থমকে দিতে চেষ্টা করে। বৈশাখের প্রধান দুটি ক্ষীপ্র সীমাবদ্ধতা হচ্ছে খর রোদ আর কালবৈশাখীর দুরন্ত ঝড়। খররোদে মাঠ-ঘাট সব ফেটে চৌচির হয়ে যায়। সূর্যের তেজী রশ্মি কৃষকের মাথায় ফাটল ধরায়। আবাদী জমি পানির জন্য হাহাকার করতে থাকে। পানির অভাবে মাঝে মাঝে নষ্টও হয়ে যায় ক্ষেত খামার। আবার হঠাৎ করেই ভয়ংকর রূপে কালবৈশাখী ঝড় এসে হাজির হয় সামনে। এলোমেলো করে দেয় গোছানো সব সংসার। ঝড়ের তা-বলীলায় গরীব দুঃখীর কষ্টের কোন শেষ থাকেনা। ফসলি জমি, বাড়ি ঘর, গাছ পালা সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করে দেয় ঝড়। হারিয়ে যায় গৃহপালিত পশুসহ মুল্যবান সবকিছু। এতদ্বসত্বেও মানুষ থেমে থাকেনা। খররোদ আর কালবৈশাখীকে পিছনে ফেলেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে মানুষ বৈশাখের সত্যিকার আহ্বান শুনতে পায়। যে আহ্বান ভয়কে জয় করার। তাইতো জাতীয় কবি লিখেছেন, ‘ওই নূতনের কেতন উড়ে কালবোশেখীর ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ নববর্ষ মানুষকে আশায় বুক বাঁধতে শিখায়। ধ্বংসকে দূর করে নির্মানের কাজ করতে অণুপ্রেরণা জোগায়। তাইতো বাঙালিরা কালবৈশাখীর ঝড়ে সবকিছু হারিয়েও আবার আশাতে ঘর বাঁধতে পারে।
বৈশাখ এলে প্রাণ ফিরে পায় বাঙালিরা। দোকানে দোকানে হালখাতার নতুন খাতা খোলা হয়। পুরনো খাতাকে ছিঁড়ে ফেলে উৎসবমুখর করে তুলে দোকানের চারপাশ। রঙিন আলোর বাতি জ্বালায়। দূর থেকে তাকালেই বুঝা যায় হালখাতার আয়োজন চলছে। সন্ধ্যায় শিল্পকলা, নানান ধরনের স্কুল ক্যাম্পাস বা কলেজ ক্যাম্পাসে শুরু হয় নববর্ষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ গান অভিনয়ে মঞ্চ কেঁপে উঠে বারবার। লোকজ ঐতিহ্যকে এসময় তুলে আনা হয় বেশি। দেশ বিদেশের চেনা অচেনা সব বাউলের কণ্ঠের ধ্বনি আকাশ বাতাসকে আলোড়িত করে তুলে। চৈত্রকে বিদায় জানানো বাংলার কবি তাই কলম ধরে বসে থাকে না। আমোদে আত্মহারা হয়ে ক্ষুদে কবিও আজ কবিদের কবি হয়ে যায়!
শক্ত হাতে হাল ধরেছি
নব দিগন্তে পাল তুলেছি
অতীত গ্লানি সব মুছে যাক
তোমার ডাকে ‘হে বৈশাখ’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ