গণপরিবহনে বিশৃংখলা
বাসের যথেচ্ছ ভাড়া আদায় বন্ধ এবং যাত্রীদের কষ্ট ও ভোগান্তি কমানোর ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার রাজধানীতে গেটলক ও সিটিং সার্ভিসসহ বিভিন্ন নামে চলতে থাকা বাসের চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। গত রোববার থেকে সরকারের এই নির্দেশ বাস্তবায়নের কার্যক্রম চালাচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআরটিএ। ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে চলছে তদারকি ও পরিদর্শনের অভিযান। সরকার চেয়েছিল সব বাসই যাতে একই পরিমাণ ভাড়া আদায় করে এবং গেটলক ও সিটিং সার্ভিস ধরনের কোনো নামের আড়াল নিয়ে যাতে কারো পক্ষেই বেশি ভাড়া আদায় বা যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করা সম্ভব না হয়। এর কারণও সবার জানা। গেটলক কথাটার অর্থ হলো, কোনো একটি স্থান থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের মাঝখানে অন্য কোনো স্থানে বাস থামানো বা যাত্রী নামানো হবে না। আর সিটিং সার্ভিসের শর্ত ছিল, নির্দিষ্ট সংখ্যক সিটের বাইরে বাড়তি কোনো যাত্রীকে ওঠানো বা নামানো হবে না। সব যাত্রীকেই বসার সিট দিতে হবে। ভাড়ার পরিমাণও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে এতদিন ধরে চলছিল চরম স্বেচ্ছাচারিতা। গেটলক হোক অথবা হোক সিটিং সার্র্ভিস- সব বাসেই যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো যেমন হতো, তেমনি আদায় করা হতো ইচ্ছামতো ভাড়াও। অর্থাৎ সাধারণ বাসের তুলনায় দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি ভাড়া আদায় করলেও বাসগুলো আইন ও নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করতো না। এসব বাসের সঙ্গে সাধারণ বাসের কোনো পার্থক্যই ছিল না। যার কারণে সাধারণ যাত্রীরা সিটিং সার্ভিসকে বলতো চিটিং সার্ভিস। অর্থাৎ প্রতারণা করা হতো প্রকাশ্যেই। তাছাড়া বিআরটিএর স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও খুব কম বাসেই দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার তালিকা ঝুলিয়ে রাখা হতো। ঝুলিয়ে রাখলেও নির্ধারিত হার অনুযায়ী ভাড়া আদায় করা হতো না।
এমন অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্য নিয়েই সরকার বিআরটিএকে দিয়ে গেটলক ও সিটিং সার্ভিস ধরনের বিশেষ বাসগুলোর চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল। এ ব্যাপারে সময়ও যথেষ্টই দেয়া হয়েছিল। বিআরটিএ একই সঙ্গে আরো কিছু নির্দেশনা জারি করেছিল। প্রতিটি বাসে নারী এবং অন্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কয়েকটি করে সিটের ব্যবস্থা রাখা ছিল এসব নির্দেশনার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ক্ষোভ ও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কোনো বাসই সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী চলাচল করছে না। মালিকরা তাই বলে প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ জানাননি। তারা বরং চাতুরিপূর্ণ কৌশল হিসেবে সরকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। তারা এমনকি বিআরটিএর কর্মকর্তা এবং ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সভায়ও অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের আসল রূপ দেখা গেছে বাস চালানোর সময়ে। দু-একজন ছাড়া প্রায় কোনো মালিকই নিজেদের বাস নামাননি রাজপথে। যে কয়েকটি মাত্র বাস রাস্তায় চলাচল করেছে সেগুলোতে শুধু আগের মতো ভাড়া আদায় করা হয়নি, বেশির ভাগ বাসে অনেক বেশি ভাড়া দিতেও বাধ্য হয়েছে যাত্রীরা। নির্ধারিত গন্তব্যের আগে বা মাঝপথের কোথাও যাত্রী নামালেও সব যাত্রীর কাছ থেকে পূর্ণ দূরত্বের ভাড়া আদায় করেছে বাসের কন্ডাক্টররা- যেটা এতদিন করা হতো না। দৈনিক সংগ্রামসহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে প্রথম দিনটি থেকেই। কিন্তু কোনো মালিক এবং বাস কন্ডাক্টরই বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। যেখানে সেখানে কন্ডাক্টরদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে যাত্রীরা। কোথাও কোথাও যাত্রীদের ওপরই চড়াও হয়েছে বাসের কন্ডাক্টর ও হেল্পাররা। অনেক যাত্রীকে শারীরিকভাবেও হেনস্থা করেছে তারা। সবচেয়ে বড় কথা, নানা অজুহাতে মালিকরা বাসই বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে বিগত কয়েকদিন ধরে যানজটের নগরীতে বাস চলাচল করছে না বললেই চলে। অন্যদিকে অফিস, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা কাজে যেহেতু না গিয়ে উপায় নেই সেহেতু বিপদে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিটি বাস স্টপেজে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কিন্তু খবর নেই কোনো বাসের। হঠাৎ একটি বাস এসে হাজির হলেও বাসটিতে ওঠার জন্য কয়েকশ মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, রাজধানীতে এখন বাসের আকাল চলছে। ফলে মানুষের বিপদও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কোনো কূল-কিনারাই দেখতে পাচ্ছে না যাত্রী তথা সাধারণ মানুষ। গার্মেন্টকর্মী এবং অন্য পেশার নারীদের কথা নিশ্চয়ই পৃথকভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা মনে করি, রাজধানীতে চলমান গণপরিবহনের নৈরাজ্য ও বিশৃংখলার অবসান ঘটানো দরকার অনতিবিলম্বে। এজন্য বিআরটিএর তথা সরকারের উচিত কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। গেটলক এবং সিটিং সার্র্ভিস ধরনের বাসগুলোকে চলাচল নিষিদ্ধ করার আগে যেহেতু যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে এবং এসব বাস যেহেতু আইন ও নির্দেশনা অমান্য করে এসেছে সেহেতু তাদের পক্ষের কোনো দাবি বা যুক্তিই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে যেসব বাস চলাচল করছে না সেসব বাসের লাইসেন্স বাতিল করাই একমাত্র শাস্তি হতে পারে। পাশাপাশি এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে প্রতিটি বাস আইন মেনে চলে এবং সরকার নির্ধারিত ভাড়া গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বিআরটিএকে একই সঙ্গে ভাড়ার হারও এমন পরিমাণে নির্ধারণ করতে হবে যাতে মালিক পক্ষ লাভ না হওয়ার যুক্তি দেখানোর সুযোগ না পায়। যাদের লাভ হবে না কিংবা যারা ক্ষতির মুখে পড়বে তাদের জন্য ব্যবসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পথ খোলা রাখতে হবে। কিন্তু কোনো অজুহাতেই যাত্রীদের ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ভোগান্তির শিকার বানানো যায় না। সব মিলিয়ে আমরা চাই, স্বল্প সময়ের মধ্যে গণপরিবহনের ক্ষেত্রে সুচিন্তিতভাবে সৃষ্ট সংকটের অবসান ঘটুক।