বৃহস্পতিবার ৩০ নবেম্বর ২০২৩
Online Edition

আসিয়ানের বৈঠকে চাপে মিয়ানমার॥ সুর নরম সু চির

রোহিঙ্গা ইস্যুতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের বৈঠকে চাপে পরেছে মিয়ানমার সরকার। অবশেষে সুর নরম করল অং সান সু চি। চাপে পরে রোহিঙ্গাদের নিবাস রাখাইন রাজ্যে জরুরি মানবিক সহায়তার জন্য আসিয়ান দেশগুলোকে প্রবেশের অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছে সরকার।

এদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সহিংসতার ঘটনায় দেশটির সেনাবাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সোমবার মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় মিলিত হন। মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কার্যত সরকার প্রধান অং সান সু চি ছিলেন এ বৈঠকের আয়োজক।

অস্ট্রেলিয়ার এবিসি নিউজের খবরে বলা হয়, বৈঠকে আসিয়ান দেশগুলোর নজিরবিহীন চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসার অঙ্গীকার করে। সূত্র এবিসি নিউজ।

অক্টোবরে একটি পুলিশ ফাঁড়িতে জঙ্গি হামলার পর থেকে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে এবং সেখানে সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে সেখানে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে।

বিবিসির খবরে বলা হয়- সোমবার আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে সু চি বলেন, রাখাইন রাজ্যে ত্রাণকর্মীদের ঢুকতে দেয়া হবে, কিন্তু তারা সব জায়গায় যেতে পারবেন না। আরাকানের যেসব জায়গায় রোহিঙ্গাদের হত্যা এবং ধর্ষণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে, সেসব জায়গায় প্রবেশাধিকারের সম্ভাবনা তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। 

এর মানে হচ্ছে, ইয়াঙ্গুনের এই বিশেষ বৈঠকে সু চি যা বলেছেন, তাতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতিতে খুব সামান্যই পরিবর্তন হচ্ছে। 

তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি জটিল বিষয় এবং এর নিষ্পত্তি করার জন্য তার সরকার যা করছে তার সুফল পেতে সময় লাগবে।

তবে বৈঠকের পর মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘রাখাইন রাজ্যের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আসিয়ান সদস্যদের অবহিত করতে মিয়ানমার সরকার জরুরি মানবিক প্রবেশাধিকার দিতে প্রস্তুত থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করছে।’

আসিয়ান সনদ অনুসারে কোনো সদস্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য সদস্য দেশের হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকলেও এবার মিয়ানমারকে নজিরবিহীন চাপ দিয়েছে সংস্থাটি। 

বিশেষ করে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী জনসভা করে রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলে মন্তব্য করেন এবং অং সান সু চির কঠোর সমালোচনা করেন। 

 বৈঠকে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফাহ আমান মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্দশাকে আঞ্চলিক উদ্বেগের বিষয় দাবি করে তা অবসানে পদক্ষেপ নিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক জোট আসিয়ান নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। 

আসিয়ানকে রোহিঙ্গাদের মানবিক ত্রাণ সহায়তা দেয়ার কাজে সমন্বয় এবং তাদের ওপর পরিচালিত নিপীড়নের ঘটনা তদন্তের দাবিও জানান তিনি। 

 বৈঠকে আনিফাহ আমান বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ধীরগতিতে অগ্রগতি হচ্ছে। পাশাপাশি সেখানে মিয়ানমার সেনারা রোহিঙ্গাদের গণগ্রেপ্তার, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং ধর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। 

তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি রাখাইনের পরিস্থিতি আঞ্চলিক উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কাজেই এর সমাধানও সবাইকে একসঙ্গে মিলেই করতে হবে।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ: নতুন এক প্রতিবেদনে লন্ডনভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী দেশটিতে বেআইনিভাবে বেসামরিক লোকদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট ও পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। 

অ্যামনেস্টির মতে, এসব কর্মকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল হতে পারে। সোমবার অ্যামনেস্টি প্রকাশিত ৫৯ পৃষ্ঠার নতুন এ প্রতিবেদনে নানা ধরনের নির্যাতন ও বর্বরতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বিবিসির খবরে বলা হয়, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সাক্ষাৎকার, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া চিত্র বিশ্লেষণ এবং ভিডিও ও ছবির ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে অ্যামনেস্টি। 

সংস্থাটির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাবিষয়ক পরিচালক রাফেন্দি ডিজামিন বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বেসামরিক রোহিঙ্গাদের অনুভূতিহীন ও নিয়মতান্ত্রিক সহিংসতার লক্ষ্যে পরিণত করেছে। একটি সমন্বিত শাস্তির অংশ হিসেবে সেখানে পুরুষ, মহিলা, শিশু, তাদের পুরো পরিবার ও গ্রামের ওপর হামলা হয়েছে এবং নির্যাতন করা হয়েছে।’ 

এ ইস্যুতে মিয়ানমারের নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি তার রাজনৈতিক এবং নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

১২ নবেম্বরের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অ্যামনেস্টির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সেনাবাহিনী রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে মোতায়েন করা দুটি হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে নির্বিচারে গুলী চালায়। আতংকে গ্রামবাসী পালাতে থাকেন। এ হামলায় অজ্ঞাতসংখ্যক মানুষ মারা যান।’ 

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অবশ্য রাখাইন রাজ্যে তাদের ভাষায় ‘বাঙালি’ দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে, যারা ৯ অক্টোবর পুলিশের একটি তল্লাশি চৌকিতে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ। এ সেনা অভিযানে ৮০ জনের মতো মানুষ নিহত হয়েছেন বলে তারা স্বীকার করেছে। 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুসারে নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। যদিও তারা নিহতের কোনো সংখ্যা নিরূপণ করতে পারেনি। সেনাবাহিনী নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়ন করেছে বলেও অভিযোগ অ্যামনেস্টির। 

সেনা সদস্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন কয়েকজন মহিলার সাক্ষাৎকারও নিয়েছে বলে জানাচ্ছে অ্যামনেস্টি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ