সম্পাদকীয়
পুলিশের ভূমিকায় অতীতের পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনীটি দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির অনুশীলনের মধ্য দিয়ে উপকৃত হয়েছে এবং এ কারণেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও সংশ্লিষ্ট বহিনীকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। প্রতিবেদনে আশংকা ব্যক্ত করা হয় যে, যদি অন্তর্বর্তী সরকার এ বাহিনীর দ্রুত কাঠামোগত সংস্কার না করে তাহলে কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জন করা সব অগ্রগতি হারিয়েও যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে যে ছাত্রজনতার আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তা যেভাবে পুলিশ বাহিনী দমন করেছিল সেখানে দমন প্রক্রিয়ায় সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। দৈনিক সংগ্রাম সংস্থার প্রতিবেদনটি বিস্তারিত প্রকাশও করেছে। এতে জানা যায়, ঐ আন্দোলনের সময় মাঠ পর্যায়ে পুলিশ যে ভূমিকা পালন করেছে তা নির্ধারণে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের ভূমিকার তুলনায় বরং তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ভূমিকাই বেশি ছিল।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনীটি দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির অনুশীলনের মধ্য দিয়ে উপকৃত হয়েছে এবং এ কারণেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেও সংশ্লিষ্ট বহিনীকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। প্রতিবেদনে আশংকা ব্যক্ত করা হয় যে, যদি অন্তর্বর্তী সরকার এ বাহিনীর দ্রুত কাঠামোগত সংস্কার না করে তাহলে কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জন করা সব অগ্রগতি হারিয়েও যেতে পারে।
‘আফটার দ্য মনসুন রিভোলিউশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এ প্রতিবেদনে আরো দাবি করা হয় যে, বিগত সরকারের আমলে আইন-শৃংখলা বাহিনীগুলো বরাবরই রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। গত ছাত্র অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ যে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে তার নির্দেশনাও রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকেই এসেছে মর্মে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন। বড়ো বড়ো অফিসারেরা রাজপথের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেও মাঠ পর্যায়ের পুলিশদেরকে গুলি করার নির্দেশনা দিয়েছেন বলেও প্রমাণ পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যগুলো সত্যিই উদ্বেগজনক। এ বিষয়গুলো আমাদের অজানা তা নয়, তবে বিদেশী একটি মানবাধিকার সংস্থা থেকে এ তথ্যগুলো সামনে আসায় পুরনো শংকা ও বাস্তবতাগুলো নতুন করে আমাদের সামনে এসেছে। রাজনৈতিক সরকারগুলো অতীতেও পুলিশকে নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। কিন্তু আওয়ামী আমলে যা ঘটে গেছে তা সত্যিই ভয়াবহ ও নজিরবিহীন। গত আন্দোলনের সময় আইনশৃংখলা বাহিনী যেভাবে সক্রিয় হয়েছে, গুলি করেছে তাতে মনে হয়েছে তারা নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নয় বরং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় রয়েছে।
এখানে আন্দোলনরত বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে গুলি করা হয়েছে, লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, গ্রেনেডে মারা হয়েছে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে গুলি করা হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত গুলি ও অস্ত্র অহরহ এবং কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়াই ব্যবহার করা হয়েছে। ঘটনার জেরে প্রাণ গেছে দেড় হাজারের বেশি মানুষের, আহত হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। অসংখ্য আহত ভিকটিম এখনো হাসপাতালগুলোর বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। এরকম কোনো পরিস্থিতি বাংলাদেশের মানুষ আর দেখতে চায় না।
অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃংখলা বাহিনীর পোশাক পরিবর্তন নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন। তবে এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন বাহিনীর সদস্যদের আচরণগত ও মানসিক পরিবর্তন। বর্তমান সরকার আসার পরও যেভাবে পুলিশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ্যাক্ট করেছে বিশেষ করে সর্বশেষ এবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে তারা যেভাবে এ্যাকশনে গিয়েছেন তা লজ্জাজনক এবং এ ঘটনাবলি প্রমাণ করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আচরণে আহামরি কোনো পরিবর্তন আসেনি। আর বাহিনীতে বা বিভিন্ন বিভাগে এখনো ফ্যাসিবাদের দোসর বা সমর্থকেরা আছেন- এ কথা বলে এ সরকার খুব বেশি দিন জনগণের কাছ থেকে সহানুভূতিও পাবে বলে মনে হয় না। পুলিশসহ আইনশৃংখলা বাহিনীগুলো নিয়ে সরকারের আরো বেশি সক্রিয়তা ও বাস্তবসম্মত তৎপরতা আমরা প্রত্যাশা করি। পুলিশ যেন আর কখনো নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়। পুলিশকে আমরা জনবান্ধব ভূমিকাতেই দেখতে চাই।