বুধবার ২৯ নবেম্বর ২০২৩
Online Edition

সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ মিডিয়া প্রসঙ্গ

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

মানবিক মূল্যবোধের কারণেই মানুষ শ্রেষ্ঠ। পশু এবং মানুষের মাঝে মৌলিক কতগুলো মিল-অমিল রয়েছে। এ সকল বৈশিষ্ট্যই মানুষকে পশু থেকে উচ্চতর স্থানে সম্মানিত করেছে। মিলের বিষয়গুলো হচ্ছেÑ ক্ষুধা পেলে মানুষও খায়, পশুও খায়। পরিশ্রান্ত হলে মানুষও বিশ্রাম চায়, পশুও চায়। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে মানুষও যৌনকর্ম সম্পাদন করতে চায়, পশুও করে। এ সকল কাজে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য হচ্ছে করার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। পশুরা যা তা ইচ্ছে মতো খেতে পারে। হালাল হারামের কোন বালাই নেই। কিন্তু মানুষ তা পারে না। তাকে হালাল হারাম কিংবা বৈধ-অবৈধের চিন্তা করতে হয়। পশুর বিশ্রামের কোন সময় কিংবা নিয়ম নেই। সুযোগ পেলেই যে কোন সময় যে কোন স্থানে বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু মানুষ পারে না। অপরিচ্ছন্ন স্থানে নামাজের নির্ধারিত সময়ে তারা বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারে না। বয়ঃপ্রাপ্ত হলেই পশুরা যৌন মিলনে মিলিত হতে পারে। স্থান কাল পাত্র তাদের কাছে কোন বিষয় না। কিন্তু মানুষ তা পারে না। মানুষের জন্য স্থান কাল পাত্রের নির্ধারিত প্রোফর্মা আছে। বৈধ-অবৈধের প্রশ্নের কাছে মানুষকে জবাবদিহী করতে হয়। এ জবাবদিহীতার প্রধান বিচারক হচ্ছে বিবেক। এই বিবেকই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা নিয়ে যিনি যতবেশি সতর্কভাবে চলতে পারেন তিনি ততো ভালো মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন। বিবেকই মানুষের মূল্যবোধ এবং পরিশুদ্ধ সংস্কৃতির উদ্ভাবক। বিবেক আছে বলেই মানুষ সত্যের কাছে মাথা নত করে। বিবেক আছে বলেই মানুষ স্রষ্টার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। বিবেক আছে বলেই মানুষ সুন্দর সমাজ গঠনে উৎসাহী হয়।

রাজনীতি শুধু ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে হতে পারে না। রাজনীতি সমাজকে উন্নতির দিকে, জাতিকে সম্মানের দিকে নিয়ে যায়। না পারলে সে রাজনীত রাজনীতি হয় না। সেটাও সন্ত্রাসের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। পেশীশক্তি এবং মিথ্যাচারের রাজনীতি বৃদ্ধি পেয়ে পাশবিক পর্যায়কে অতিক্রম করার মতো ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সমাজে। নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পেয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে আমরা একে অপরের প্রতি কল্যাণকামী না হয়ে বিনাশকামীতে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি অন্যায় করে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ করার ভয়াবহ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোন অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হচ্ছে না। অন্যায় কাজের প্রতি ঘৃণা ও অন্যায় করলে লজ্জিত হবার প্রবণতাও সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। যারা সমাজের নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করে আছেন তারা মিথ্যা অহমিকায় মিকি চাকচিক্যর মাঝে রাজনৈতিক মিথ্যাচার ও ধোঁকাবাজি করে জনগণের রক্ত শোষণ করছে। যারা জ্ঞানের অলংকার নিয়ে সবজান্তার ভাব করে আছেন তাদের মাঝে সত্যিকার অর্থেই জ্ঞান বলতে কিছুই নেই। ফলে সমাজে আজ দুর্বৃত্তায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে যা নয় তাই সাজতে চায়। চোরের হাতে গৃহ পাহারার দায়িত্ব পড়েছে। নিম্ন শ্রেণীর অযোগ্য লোকেরাই সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে আছে। ফলে হাজার বছর পূর্বের সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের অসভ্য সমাজ ব্যবস্থা পুনরায় যেন আমাদের কাঁধে এসে ভর করেছে। যে রাজনীতি রাজনৈতিক কর্মীকে ঘাতক হতে শেখায়, যে রাজনীতি মানুষের মধ্যে থেকে মনুষত্ব কেড়ে নেয়, তার হৃদয়বৃত্তিকে পাষাণে পরিণত করে সেই রাজনীতিকে ধিক্কার জানাতে হবে। সেই রাজনীতিকে না বলতে হবে। বলতে হবে- সেই রাজনীতি চাই, যা মানবতার কথা বলে, মানুষের কথা বলে, ন্যায় বিচারের কথা বলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচারের কথা বলে। স্বপ্ন দেখায় সত্যিকার মানুষ হবার।

আমাদের সমাজ এবং সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। এমন কোন অপরাধ নেই যেটা আমাদের বর্তমান সমাজে ঘটছে না। খুন, অপহরণ, ধর্ষণের পর হত্যা, চাদাবাজি, ছিনতাই এবং সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ বলতে গেলে প্রায় সব ধরণের অপরাধই ঘটছে। আর নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় ঘটার ফলে মানুষ হিংস্র ও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আইন আদালত সব কিছুই যেন অকার্যকর। অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে সন্ত্রাসীরা মানুষ মেরে ফেলছে আর সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে অন্য অনেক মানুষ। এমনকি পুলিশের সামনে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরেও পুলিশ নিরব দর্শক। সহিংসতার ক্রমাগত নৃশংস ঘটনা নাগরিক ও মানুষ হিসেবে আমাদেরকে দারুণভাবে শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন ও বিধ্বস্ত করে তোলে। দুর্বৃরা যখন নায়কের বেশে আর্বিভূত হয়, অসৎ-লুটেরা অযোগ্য লোক যখন ইতিহাসের অংশ হয়, গণতন্ত্র তখন পর্যুদস্ত হয়, সভ্যতা-মানবতা তখন বিপন্ন হয়, আইনের শাসন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ভুলুণ্ঠিত হয়। তাইতো সাতবছরের শিশু সায়মা’রাও নিস্তার পায়না দাঁতাল শুয়োর আর হায়েনাদের হাত থেকে।

সবশ্রেণির মানুষের মুখে আজ একই কথা। দারুণ সংকটে কাটছে দিন। উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা সকলের মধ্যে। একের পর এক খুন হচ্ছে মানুষ। পারিবারিক কলহে স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের শিকার হচ্ছেন। ব্যক্তিস্বার্থ আর দ্বন্দ্বে সহোদর, নিকট আত্মীয়, বন্ধু, বান্ধবকেও খুন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণ কিংবা সন্ত্রাসী ঘটনাও মানুষ খুন হচ্ছে। প্রতিনিয়তই পত্রিকার পাতা খুললে গুম-খুনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে বাড়ছে হতাশা, মানসিক বিষন্নতা, আর্থিক দৈন্য। ফলে সমাজে বেড়েই চলছে অপরাধ। নৃশংস এই হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে শিশু সন্তানেরাও। পারিবারিক কলহ, রাজনৈতিক বিরোধ, পরকীয়া, ছিনতাইকারীর আক্রমণ ও পেশাদার অপরাধী গ্রুপের অভয়ারণ্য আজ বাংলাদেশ। 

সভ্যতার বিকাশ এবং মানব সমাজ গঠনে বিশেষ প্রভাব রয়েছে যৌনতার। সমাজে বিয়ে প্রথা চালু হওয়ার পর কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রীর মিলনকেই বৈধতা দেওয়া হয়। এর বাইরের অন্য সব সম্পর্কই অনৈতিক বলে মনে করা হয়। চীন দেশে নিকটাত্মীয়র মধ্যে বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ। আধুনিক সভ্য সমাজে অনৈতিক সম্পর্ক রোধের জন্য আইন-কানুনও চালু রয়েছে বিভিন্ন দেশে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদিআরবসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে এবং চীন দেশে পর্নো আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ওইসব দেশে অনৈতিক সম্পর্ক বা ধর্ষণের মতো ঘটনার খবর খুব একটা পাওয়া যায় না। মুক্ত যৌনতার সমর্থকরা বলতে পারেন, সৌদি আরবে আইন-কানুন ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশে চলে। কিন্তু আধুনিক চীন, সেখানেতো ধর্মের বিষয় নেই সেখানেও অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে রয়েছে কঠোর আইন।  আমাদের দেশে নারীবাদীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে অবৈধ প্রেম বা অনৈতিক সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চাইছেন। নারীবাদীরা পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে নারীর অপরাধ আড়াল করে সমস্ত অপরাধের জন্য পুরুষকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় কারানোর চেষ্টায় সচেষ্ট থাকেন। ধর্ষণ নিয়ে দেশব্যাপী হুলস্থুল হচ্ছে অথচ সম-অপরাধ অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে কেউ কোনও ধরনের প্রশ্ন তুলছেন না। আসলে ধর্ষণ আর অনৈতিক সম্পর্ক দুটোই একই সমস্যার এপিঠ-ওপিঠ। ধর্ষণে অপরাধী একজন আর অনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে অপরাধী উভয়েই। ধর্ষণ বলপূর্বক আর অনৈতিক সম্পর্ক স্বেচ্ছায়। দুটোতে আসলে মৌলিক কোনও তফাৎ নেই। দু’টো সমস্যাকে একই দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে যুগপৎভাবে।

অমুসলিম দেশগুলোর মতো আমাদের ভোগবাদী সমাজে এক ধরনের যৌন প্রবণতা প্রবলতর হয়েছে। অমুসলিম দেশগুলোর সমাজ ব্যবস্থায় যৌনতাকে কেন্দ্র করে যে অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তাতে ওসব দেশে পরিবার ব্যবস্থায় ভাঙ্গন সৃষ্টি হচ্ছে। সামাজিক জীবনে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে, মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে সামাজিক বন্ধন। আমরাও যেন তাদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানের উন্নততর তথ্য প্রযুক্তির অপপ্রয়োগই এর অন্যতম কারণ বলা চলে। পর্নোগ্রাফির করাল গ্রাসে নিপতিত আজকের সমাজ। মা মেয়েদের নিয়ে টিভির পর্দায় এমনসব ছবি দেখছেন, যাতে এক পুরুষ একাধিক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করছে, আবার এক নারী একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন তৃপ্তি ভোগ করছে। এইসব সরকারি সেন্সর প্রাপ্ত ছবি পুরোপুরি পর্নো না হলেও সমাজের জন্য সত্যিই ক্ষতিকর। পর্নোর সঙ্গে সা¤্রাজ্যবাদের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক পর্নোর ব্যবস্থা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এইসব পর্নো এবং টিভি সিরিয়ালের পাশ্চাত্যমুখী প্রভাব পড়ছে আজকের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ের উপর, বিশেষ করে কম্পিউটার নেটিং-এর নানা প্রোগ্রামের মধ্যে প্রায় সব কিছুই পাওয়া সম্ভব। এদিকে কম্পিউটার তো আজ নব প্রজন্মের ছেলেমেয়ের হাতে হাতে। ফলে সহজ মেলামেশার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে নারী-পুরুষের মধ্যে। পাশ্চাত্যের অনুকরণে ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ যৌনতার ব্যাপারে অনেকাংশে দায়ী। সমাজে আর্থিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সামাজিক অবক্ষয়, কালো টাকা ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে। 

এ সব সমস্যা নিয়ে নানাজন নানাভাবে কথা বলছেন; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই ধরেনর নৈতিক মূল্যবোধের সমস্যায় পরিবারগুলো ভাঙতে ভাঙতে একদিন সমাজটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আর সে কারণেই অনৈতিক সম্পর্কের সূত্র ও উৎস গভীরভাবে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা মানুষ জন্মগত ভাবে ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। মনুষ্যত্বববোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মনুষ্যত্বের কার্যকর উপস্থিতির মধ্যেই মানুষ এর প্রকাশ। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি-রহস্য, একটুখানি সহায়তা, একটু স্নেহের বাক্য, অসহায়ের প্রতি একটুখানি দয়া প্রদর্শন, একটুখানি ন¤্রতা, একটুখানি সৌজন্যতাই মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। মিডিয়াই বিকাশমান সংস্কৃতির বাহক। মিডিয়াকে তাই এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। 

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ