খুলনা পাউবোর দু’টি ড্রেজার এক বছর বিনা ভাড়ায় এক ছাত্রলীগ নেতার দখলে
খুলনা অফিস: পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার প্রায় ৪০ কোটি টাকা মূল্যের দু’টি ড্রেজার বিনা ভাড়ায় এক বছরের বেশি সময় ধরে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতির দখলে রয়েছে। যা ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হাওলাদার কনস্ট্রাকশনের নামে ঘাঘর নদী খননের কথা বলে ভাড়া নেয়া হয়েছিল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দক্ষিণ মুগদাপাড়া ঠিকানা ব্যবহার করে মোসার্স হাওলাদার কনস্ট্রাকসনের স্বত্বাধিকারী মেহেদী হাসান ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর পাউবোর মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। আবেদনে ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড অধীনস্থ ড্রেজার পরিদফতর, খুলনা ড্রেজার বেইজ এসডি কপোতাক্ষ ১৮ ইঞ্চি ও এসডি ভদ্রা ১২ ইঞ্জি ডায়া কাটার সাকশন ড্রেজার ২টি আমার নামীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভাড়া চাওয়া হয়।
আবেদনপত্রে বলা হয়, তার প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে গোপালগঞ্জ জেলাধীন কোটালীপাড়া থানার ঘাঘর নদী খননে তার প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক ড্রেজারের ড্রেজিং কাজ চলমান। সরকারি নিয়ম কানুন মেনে ড্রেজার দু’টি ভাড়া নিতে আগ্রহী। তিনি আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন, ড্রেজার দু’টি তার নিজস্ব অর্থায়নে সচল করে নেবেন। এই আবেদনপত্র’র পর কোন চুক্তিপত্র ছাড়াই ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ড্রেজার পরিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কে এম নুরুল ইসলাম এক দপ্তারাদেশ ড্রেজার দু’টি হাওলাদার কনস্ট্রাকশনকে সকল মালামলসহ অবিলম্বে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন।
এই দফতরাদেশে বলা হয়, খুলনা ড্রেজার বেইসে অবস্থানরত এসডি কপোতাক্ষ এবং এসটি ভদ্রা দু’টি হাউজবোট, ফ্লোটিং পাইপ, সোর পাইপ ও অন্যান্য অনুষঙ্গিক মালামাল বাৎসরিক ভাড়াভিত্তিক মেসার্স হাওলাদার কনস্ট্রাকশনকে প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হল। এই দফতরাদেশের পর হাওলাদার কনস্ট্রাকশন ২০১৬ সালের নবেম্বর প্রথম সপ্তাহে ড্রেজার দু’টি খুলনা থেকে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় নিয়ে যান। কিন্তু ড্রেজার দু’টি গ্রহণের পর ভাড়া পরিশোধ বা চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য খুলনা ড্রেজার বিভাগ থেকে বার বার তাগাদাপত্র দেয়া হয়। গত ২৮ জুন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম খান স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়, ‘চুক্তিপত্র সাক্ষরের জন্য বারংবার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি চুক্তিপত্র সাক্ষর করেননি। একই সাথে প্রথম কিস্তির টাকা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়।
চুক্তিপত্রের ৪নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ড্রেজার সচল/অচল/মেরামতাধীন যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন ত্রৈমাসিক হিসেবে প্রতি তিন মাস পরপর ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। সে হিসেবে ড্রেজার দু’টি গ্রহণের পর এক বছরের বেশি সময় পার হলেও লীজ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান কোন অর্থ প্রদান করেনি।
গত ১ আগস্ট তিনশ’ টাকার স্ট্যাম্পে এই চুক্তিপত্রে খুলনা ড্রেজার বিভাগের পক্ষে প্রথম পক্ষ হিসেবে স্বাক্ষর করেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম খান এবং সাক্ষী রয়েছেন উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. গোলাম নবী ও খান মো. আব্দুস সালাম। লীজ গ্রহণকারী হাওলাদার কনস্ট্রাশন এর স্বত্বাধিকারী মেহেদী হাসান এবং তাদের সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন মেহেদী হাসানের পিতা কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার, ক্ষিতীশ দত্ত।
গত ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে গোপলগঞ্জ কোটালীপাড়ার ঘাঘর নদীতে দেখা যায়, এসডি কপোতাক্ষ ড্রেজারটি নদীতে নোঙর করা রয়েছে। সেখানে লীজ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃতরা মেরামত কাজ করছে। অপর ড্রেজার এসডি ভদ্রা ঘাঘর নদীতে ড্রেজিং কাজে নিয়োজিত। কপোতাক্ষ ড্রেজারটি মাঝে মাঝে খনন কাজ করে, আবার মেরামতের জন্য খনন কাজ বন্ধ রাখা হয়। ড্রেজার দু’টিতে নুতনভাবে রঙ করে আগের নাম মুছে ফেলা হয়েছে। এলাকার লোকজন জানে ড্রেজার দু’টি উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার ক্রয় করেছেন।
পাউবোর ড্রেজার বিভাগের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শামসুদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি যোগদানের পর কৌশল করে ড্রেজার গ্রহণের দশ মাস পর গত ১ আগস্ট হাওলাদার কনস্ট্রাকশন এর সাথে দু’টি ড্রেজার ভাড়া প্রদানের চুক্তি সম্পাদন করান। চুক্তিপত্রে এসডি কপোতাক্ষ’র বাৎসরিক (ভ্যাট সহ) দুই কোটি ৭৯ লাখ ৮২ হাজার ৮০, পাইপ ভাড়া ৬৪ হাজার ৫১২ এবং এসডি ভদ্রা বাবদ ৭৯ লাখ ২৮ হাজার ২৫৬ টাকা ও পাইপ ভাড়া ৬২ হাজার ৫১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। চুক্তিপত্রের ১৪নং ধারায় বলা হয়, চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের ৭ দিনের মধ্যে ড্রেজার মবিলাইজেন করতে হবে এবং মবিলাইজেন করার বা চুক্তিপত্রের ৮ দিন হতে ভাড়া কার্যকর হবে।
বাস্তবে চুক্তিপত্র সম্পাদনের প্রায় দশ মাস আগেই ড্রেজার হস্তান্তর করা হয়। এবং ড্রেজার গ্রহণের এক বছরের বেশি সময় পার হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রেজার বিভাগে কোন ভাড়ার টাকা জমা হয়নি। চুক্তিপত্রে রয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়োজিত কর্মীরা ড্রেজার পরিচালনা করবেন এবং তাদের সকল বেতন, ভাতা সব দ্বিতীয় পক্ষ বহন করবে। কিন্তু ড্রেজারটিতে পাউবোর কোন কর্মী নেই। রয়েছে লীজ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের লোকবল। লীজ গ্রহিতারা কোন ভাড়া প্রদান করেনি, আবার লোকবলের বেতন-ভাতাও পরিশোধ করেনি। ফলে এই দুই ড্রেজার লোকবল খুলনা অফিসে অলস সময় অতিবাহিত করছে এবং তাদের বেতন ভাতা পাউবো পরিশোধ করছে। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।
কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান বলেন, তার ছেলে মেহেদী হাসান উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি। ড্রেজার বিভাগের কেউই ড্রেজারে থাকে না। সব তার লোকজনই ড্রেজার পরিচালনা করেন। তিনি ১১ মাসে কোন ভাড়া প্রদান করেননি বলেও স্বীকার করে বলেন, ২০১৬ সালে নবেম্বর মাসে তিনি খুলনা ড্রেজার বিভাগের ঘাট থেকে এই ড্রেজার দুটি নিজ খরচে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ড্রেজার দু’টি এনে শুধু একটির পেছনে মেরামত বাবদ তিন কোটি টাকা ব্যায় করেছেন।
ড্রেজার বিভাগের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. গোলাম নবী জানান, ড্রেজার দু’টি কেজিডিআরপি প্রকল্প আওতাধীন ভবদহ খনন কাজের জন্য প্রথম আনা হয়েছিল। সে কাজ শেষ করার পর তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ড্রেজার দু’টির বাজার মুল্য ৪০ কোটি টাকার বেশি। তিনি জানান, চুক্তিপত্রে কাজের তফসিল অনুযায়ী ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। যাত্রার নির্দেশ উল্লিখিত সময় থেকে এক বছর। সে হিসেবে ড্রেজার ব্যবহারের সময়সীমা ২০১৭ সালের নবেম্বর শেষ হয়েছে। তিনি জানান, বিষয়টি প্রধান প্রকৌশলীর দফতর হতে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হয়ে থাকে। তারা কেবল নির্দেশনা অনুসরণ করেন।
উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান মুন সাংবাদিকদের জানান, তিনি নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর জন্য ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে তিনি ছাত্রলীগ সভাপতি হয়েছেন, তার আগে থেকেই তিনি ঠিকাদারী করেন। তিনি বলেন, ড্রেজার দু’টি এক বছরের বেশি সময় তাদের কাছে থাকলেও বেশি লাভবান হতে পারেননি।