দার্শনিক মানদণ্ডে জীবনের মূল্যায়ন
পৃথিবীর বয়স বিজ্ঞানীদের মতে সাড়ে চার’শ কোটি বছর। দেড়শ থেকে দুইশ কোটি বছর আগে এটি বাসযোগ্য হয়েছে। মানুষের আগমন ঘটেছে বিশ লাখ বছর আগে। মানুষের জীবন একটাই। শাশ্বত জীবন ব্যবস্থার দর্শনে জীবনের কখনও পরিসমাপ্তি নেই।
Printed Edition
![asdad](https://static.dailysangram.com/images/asdad.original.jpg)
অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান
পৃথিবীর বয়স বিজ্ঞানীদের মতে সাড়ে চার’শ কোটি বছর। দেড়শ থেকে দুইশ কোটি বছর আগে এটি বাসযোগ্য হয়েছে। মানুষের আগমন ঘটেছে বিশ লাখ বছর আগে। মানুষের জীবন একটাই। শাশ্বত জীবন ব্যবস্থার দর্শনে জীবনের কখনও পরিসমাপ্তি নেই। তবে জীবনের স্থান পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক চলমান প্রক্রিয়া। একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে প্রাণীজগতের আগমন এবং অতঃপর মৃত্যুর মাধ্যমে প্রাণের প্রস্থান একটি প্রচলিত আদিপ্রথা। সাধারণত জন্ম, শৈশব, কৈশোর, বাল্য, যৌবন, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা, কর্মযজ্ঞ, অত:পর প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, প্রবীণ, বার্ধক্য এবং সর্বশেষ মৃত্যু এই হলো মানুষের জীবন। এই জীবন বা সময়কে পৃথিবীতে অর্থবহ করতে আপাতদৃষ্টিতে কেউ পুরোপুরি সার্থক হয়, কেউ আংশিক আর বেশির ভাগই হয় ব্যর্থ। শাসক, শোষক, শাসিত এই তিন শ্রেণির মানুষের সমন্বিত উদ্যোগে পৃথিবীর সকল প্রকার কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয়। এতে যাঁরা মানব-রচিত মতবাদের অনুসারি তারা পৃথিবীতে সাময়িক সুখের অধিকারী হলেও পরকাল তাদের জন্য অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর যাঁরা ওহীর বিধান মেনে চলবে বা মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করবে তারা পৃথিবীতে কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পারলো তা বড় কথা নয়! বরং আখিরাতে তাদের আসল ও চূড়ান্ত ঠিকানা হবে চিরস্থায়ী জান্নাত।
অবশ্য অধুনা দুনিয়ায় খুব সংখ্যক মানুষ সৃষ্টিকর্তার বিধান মেনে চলে আর অধিকাংশ মানুষ জেনে বা না জেনে মহান সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতার প্রদত্ত বিধানের তোয়াক্কা করে না। এক্ষেত্রে যারা জানে ও মানে আর যারা জানে কিন্তু মানে না তারা কখনও সমান হতে পারে না। একশ্রেণির মানুষ মনে করেন তাদের জিন্দেগীটাই স্রষ্টার বন্দেগী করার জন্য। তবে বন্দেগীর প্রকৃত অর্থ তাৎপর্য খুব কম মানুষই বোঝে। অধিকাংশ মানুষ শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ইবাদত করেই মনে করেন বন্দেগী তো পুরোপুরি হচ্ছেই, কিন্তু তাদের বেশির ভাগই জীবনের সকল ক্ষেত্রে মানব রচিত রীতিনীতির অনুসরণ করে থাকেন। অপরদিকে একশ্রেণির মানুষ আনুষ্ঠানিক ইবাদতের পাশাপাশি জীবনের সকল ক্ষেত্রে অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সকল ক্ষেত্রে স্রষ্টার বিধি-বিধান মেনে চলেন বা মেনে চলার চেষ্টা করেন। আবার অনেকে আছেন স্রষ্টাকে স্বীকার না করে নিজ নিজ ইচ্ছামতো জীবন পরিচালনা করেন। আরেক শ্রেণি সৃষ্টিকর্তাকে ভিন্ন অর্থে মানে কিন্তু তার প্রতিকৃতি প্রতিমার সামনে মাথা নত করে পূজা-অর্চনা করে দায়িত্ব শেষ করে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে এর পূর্ণাঙ্গ প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। তারা আল্লাহর পছন্দনীয় কর্মকান্ড পরিত্যাগ করে কল্পনীয় দেবতার উপাসনা করে যা স্রষ্টার নিকট বড়ই অপছন্দনীয়।
এক্ষেত্রে জীবন বা সময়কে সাজাতে সময়ের সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত-এর আদর্শকে বুকে ধারণ করে যারা নশ্বরকে অবিনশ্বরের চিন্তা চেতনা পরিত্যাগ করতে পেরেছেন তারাই শেষ পর্যন্ত দুনিয়া ও আখিরাতে সার্থক জীবনের অধিকারী। এ ব্যাপারে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে সূরা নিসা এর ৭৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে-“দুনিয়ার সুখ সুবিধাকে যারা আখিরাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দিতে পারে, শুধু তারাই দ্বীনের জন্য সংগ্রাম করার জন্য যোগ্য, অচিরেই আমি (তাদেরকে) পুরস্কার দান করব”। সূরা আত্-তওবা ১১১ নং আয়াতে বলা হয়েছে-“জান্নাতের বিনিময়ে আল্লাহ্ মুমিনদের জান-মাল অবশ্যই ক্রয় করে নিয়েছেন”। সূরা আলে-ইমরানের ৮৫নং আয়াতে বলা হয়েছে-“এবং কোন ব্যক্তি যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন বিধান তালাশ করে তা কখনো কবুল করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে”।
“নিশ্চয়ই বিশ্বজাহানের সকল প্রাণি ও বস্তুর একমাত্র সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালা। আসমান ও জমিনের রাজত্ব আল্লাহর। এ রাজত্বে তাঁর কোনো শরীক নেই, তিনি ছাড়া ফয়সালা করার কারো এখতিয়ার নেই। আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা এবং সার্বভৌমত্বের সমস্ত ক্ষমতা মহা পরাক্রমশালী বিধায়ক, রক্ষক, চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী মহান রবের হাতে। প্রতিটি মুমিনের সালাত, সাধনা, জীবন, মৃত্যু একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত। আল-কুরআন, তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, তামান্না, তাক্ওয়া, হাশর, মিজান, জান্নাত, জাহান্নাম এই কয়েকটি বুনিয়াদি অর্থবোধক মূল্যবান শব্দের মধ্যে ইসলামের মৌলিক পরিচয় ও পূর্ণাঙ্গতার সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া সঠিক ইসলামকে জানতে হলে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও মহানবীর জীবনাদর্শ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করে সে দর্শনের ভিত্তিতে মানুষের মনোজগৎ, সে আলোকে বিকশিত করার বিকল্প নেই।
প্রতিটি জ্ঞানী মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা দু’ধরনের হয়ে থাকে-এক পৃথিবীতে সফলতা লাভের লক্ষ্য, দুই পরকালীন শান্তি ও পুরস্কার লাভের লক্ষ্য। পৃথিবীতে ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সফলতাকে দুনিয়াবী সফলতা বলা হয়ে থাকে, আর এজন্য তাকে প্রচুর সময়, শ্রম, মেধা, অর্থ বিনিয়োগ করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। অপরদিকে দুনিয়ার সময় বা জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে আখিরাতকে আবিষ্কার করা সম্ভব। এতে তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কার প্রাপ্তির পূর্বাভাস মহাগ্রন্থ আল-কুরআনসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
তবে যারা পরকালে সফলতা অর্জন করতে চায় তাদেরকে পৃথিবীর জীবনে লোভ, হিংসা, মোহ, রাগ, কুদৃষ্টি, কুচিন্তা, অশ্লীলতা, নেশা, অমিতাচার, অবৈধ যৌনাচার, কৃপণতা, অপব্যয়, লৌকিকতা, বাচালতা, পরশ্রীকাতরতা, চোগলখুরি, ছিদ্রান্বেষণ, চলনে বলনে, কথাবার্তায় অমার্জিত বদভ্যাস পরিত্যায্য। প্রতিটি মানুষের দেহে এক অদৃশ্য পারমানবিক শক্তি বিরাজ করে, তাহলো আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয় তারা পথভ্রষ্টতায় নিপতিত হতে বাধ্য। আর যারা বিবেক দ্বারা বা বিবেকের শাসন দ্বারা জীবন সাজাতে পারে তারা হয় সফল। এক্ষেত্রে যারা জ্ঞানী বুদ্ধিমান বিবেকসম্পন্ন, তারা মনে করেন- “আবেগের ঘোড়া যত দ্রুতই ছুটুক বিবেকের লাগাম তাকে পরাতেই হবে”। “ক্ষণিকের নশ্বর জীবনকে অর্থবহ করে গড়ে তোলার উপরই নির্ভর করে অবিনশ্বর পরকালীন অনন্ত জীবনের সুখ-দু:খ”।
জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করে সে লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য সিরিয়াস না হওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য মস্তবড় বোকামি। জীবনে অর্জিত শ্রম, মেধা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা যোগ্য নেতৃত্বের একটি বিরাট সম্পদ। এই ধরনের নেতার অর্জিত উল্লেখিত সম্পদ পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সর্বস্তরে বিনিয়োগ করতে পারলে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে, পৃথিবীটা হবে স্বর্গরাজ্য। অবশ্য এর জন্য তাদেরকে নিয়মিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, দ্রুত বাস্তবায়ন, আত্মসমালোচন, ধ্যান, জীবন দর্শন, তথা ঐশী জীবনব্যবস্থার চর্চা অপরিহার্য। সততা, সময়ানুবর্তিতা, দায়িত্বশীলতা, শিক্ষা-দীক্ষা, মানবতা, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, আলোকিত মহান জীবনাদর্শের অনুশীলন নেতাদের দেহ, মন ও আত্মার উন্নতি সাধন করে আলোকিত Homo sapiens জ্ঞানী মানুষ তৈরিতে সহায়তা করে।
এ ধরনের নেতৃতত্বই পারে অপরিকল্পিত ছন্নছাড়া, বল্গাহীন, বৈরাগ্য, সন্যাসী, আবেগ প্রবল, পাগলামি জীবনাচরণ থেকে মুক্ত করে মানুষকে একটি পরিকল্পিত অর্থবহ, সার্থক জীবন গঠনের জন্য মূল্যবান সময়, মেধা, শ্রম ও অর্থব্যয় করানোর মাধ্যমে একটি সুখী সুন্দর নিরাপদ মানবিক শান্তিময় বিশ্ব বিনির্মাণ করতে। কারণ এ ধরনের সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কারণে দুনিয়াতে বাতিলের বিরুদ্ধে হকের বিজয় দান করে সমগ্র দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে চান। “যাঁরা সৎকর্মশীল ও সৎকর্ম পরায়ণ আল্লাহ তাদেরই সঙ্গে রয়েছেন”। ন্যায়বিচার, আতংক ও দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনই পারে শান্তিময় সমাজ কায়েম করতে। মানুষ মেধা বিকাশ, সংরক্ষণ, মূল্যায়ন, বিন্যাস, স্মৃতিচারণ, মুখস্থকরণ, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা, আবেগ, বিবেক, হাসি-কান্না, ইশারা অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। যাবতীয় অসাধ্যকে সাধন করতে মানুষ জলে, স্থলে ও আকাশ পথের যাত্রী হয়ে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করতে পারে।
আল্লাহর সৈনিক তথা ইসলামী নেতাদের খাওয়া-দাওয়া, পয়ঃপ্রণালী, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিদ্রা, আনুষ্ঠানিক, শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা পাশাপাশি পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ-সংগঠন ও রাাজনৈতিক নীতি আদর্শের চর্চা করা একটি নিত্যদিনের কাজ। এক্ষেত্রে নিরাপদ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন-যাপনে খাদ্য, পুষ্টি, পানীয় ওষুধ সেবনে সতর্কতা অবলম্বন করে পরিমিত মাত্রায় গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া নিরাপদ পরিবেশে স্বাস্থ্যসম্মত বায়ু গ্রহণ, শরীরচর্চা করা অত্যাবশ্যক ।
আল্লাহর দলের নেতাদের দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, বছর ও যুগের তথা দীর্ঘমেয়াদী ব্যক্তিগত কর্মপরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। এসবের উপরেই জীবনের সফলতা-বিফলতা নির্ভর করে। তবে সাহস, ধৈর্য্য, প্রচেষ্টা, আত্মবিশ্বাস থাকা অত্যাবশ্যক। বেহুদা কাজ বর্জন করে সময় বাঁচানোর পাশাপাশি বিপরীত পরিবেশে প্রতিকূল অবস্থায় অসাধ্যকে সাধন করা অথবা অনিশ্চিত কাজে জড়িয়ে পড়া এক ধরনের বোকামি যা জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তবে সমাজ, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ও নীতিমালা বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদী কর্মযজ্ঞে আপোসহীনভাবে ব্যক্তিগত মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিনিয়োগের পাশাপাশি সম্মিলিত আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকা সকল সচেতন নাগরিকের জন্য অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যক।
পৃথিবীর সকল প্রাণির চেয়ে মানুষ নামক প্রাণি জন্মের পর সবচেয়ে বেশি অসহায় ও পরনির্ভরশীল। এদের সাধারণ জ্ঞান বা অনুভূতি অর্জনে বারো বছর সময় লাগে। এরা গড়ে ষাট বছর জীবিত থাকলে অন্তত বিশ বছর সময় পরিমাণ ঘুমায় আর জীবন সায়াহ্নে অবসরে কাটায় আট বছর। এক্ষেত্রে ষাট বছর বয়সের অধিকারী হলেও মূলত মানুষ সচেতন অবস্থায় কর্মময় জীবনের অধিকারী হয় বিশ বছর। আর অন্যান্য প্রাণি জন্মের পর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই নিরাপত্তা, ভারসাম্যতা, পরিবেশ ও জীবন ধারণের কলাকৌশল প্রাকৃতিকভাবেই শিখে ফেলে, কিন্তু মানুষ তা পারে না। আবার মানুষ যা পারে অন্যান্য প্রাণি তার ধারেকাছেও নেই। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে মানুষ তার মেধা, অভিজ্ঞতা শ্রম ও অর্থবিনিয়োগ করে বিশ্বকে আজ হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। মানুষ আজ চাঁদে বসবাসের কল্পনা করছে। রোবট আবিষ্কার করে মানুষের কর্মক্ষমতার অধিক অসাধ্যকে সাধন করছে।
এই মানুষের জীবনকে দুনিয়া ও আখিরাতে নিরাপদ ও শান্তিতে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে দুনিয়াকে একমাত্র কেন্দ্র হিসেবে মূল্যায়ন করে অতুলনীয়ভাবে সাজাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন মহান সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার ঐশীবাণী। এ বাণীর সমষ্টি হলো পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। যা সমস্ত জ¦ীন ও ইনসান এর জন্য একান্তভাবে অনুকরণীয়। এর মূল বিষয়বস্তু হলো মানবতা ও শান্তি। ইনসান, ইনিসানিয়াত ও ইনসাফ তথা মানব মানবতা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই হলো এ জীবন বিধানের মূল বিষয়। যারা এ বিধান মেনে চলবে তাদের জিন্দেগীটাই কাটে বন্দেগীর মাধ্যমে। এদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো তাক্ওয়া বা আল্লাহর নীতিমালা অনুসরণের ভয়। এই মহাগুণ অর্জনই তাদের দোজাহানে বিজয়ের অনিবার্য হাতিয়ার ও সফলতার সোপান। এজন্য দার্শনিকরা বলেন-ইলম তাক্ওয়া ইহ্তেসাব ও তাসকিরায়ে নফস্ অর্থাৎ জ্ঞান, খোদাভীতি, আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধিই হলো আলোকিত পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার মহৌষধ। এর মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রিয় সৈনিক ও নেতা হতে সক্ষম। আর এ ধরনের মুমিন মুত্তাকিদের হাতে বিশ্বের শাসন ক্ষমতা অবশ্যই একদিন হস্তগত হবে।
এক্ষেত্রে ঈমান, সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্জ এর মতো আনুষ্ঠানিক ইবাদতের বুনিয়াদি শিক্ষা তথা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তা পরিপূর্ণভাবে অনুকরণ বা অনুশীলনের সংগ্রাম অব্যাহত রাখা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের জীবন অতি মহামূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদের মুখে নিরাপত্তা ও শান্তির হাসি ফোটানোর জন্য ইসলামের আগমন ঘটেছে। এই হাসি তর্জন গর্জনে বা এমনি এমনি ফোটানো সম্ভব নয়। এর জন্য পৃথিবীর কিছু সংখ্যক মানুষকে নেতৃত্বের ও আনুগত্যের শপথ নিতে হয়। যারা এ শপথ নিবেন তাদের উদ্দেশে মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, “তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের আগে গনীমত মনে করো। সেই পাঁচটি জিনিস হচ্ছে: ১. যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে; ২. সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে; ৩. প্রাচুর্যকে দরিদ্রতা আসার আগে; ৪. অবসর সময়কে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে; ৫.হায়াতকে মওত আসার আগে”।
পৃথিবীতে বিচিত্র মানুষের বসবাস। কেউ কেউ মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আর অধিকাংশ মানুষই সুস্থ বলে মনে হলেও নানা রকম মেনিয়া, সুরা, সিফিলিস্, সাইকোসিস এবং টিউবারকুলার লক্ষণ বা চরিত্রের অধিকারী। এগুলোর কারণ কখনও জন্মগত, কখনও শিক্ষাগত এবং কখনও পরিবেশগত। মানুষ কখনও স্বনির্ভর হতে পারে না। সর্বজান্তাও হতে পারে না। জীবনের নানা বাঁকে কখনও স্রষ্টা কখনও সৃষ্টির সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে,“মানুষ মানুষের জন্যে-জীবন জীবনের জন্যে-একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না? ও বন্ধু.....।” এই সহানুভূতিটুকুর বিবেকবোধ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দুনিয়া জয় করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে কিছু লোক আছেন যারা অনেক কিছু অর্জন করেও ডুবে যাওয়া নৌযানের সাঁতার না জানা যাত্রীর ন্যায় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে থাকেন। যাদের তাক্ওয়া নেই তাদের অবস্থাও তেমনি হয়ে থাকে।
দুনিয়াতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের জীবনটা নানা প্রতিঘাতে রুক্ষ-সূক্ষ্ম খেজুর গাছের ন্যায়। অর্থাৎ কঙ্কালসার খেজুর গাছ যেমন মরুভূমিতে পিপাসার্ত মানুষের ক্ষুধা ও তৃস্না নিবারণ করে তেমনি আলোকিত জ্ঞানীরা তাদের লেখা বই, সাহিত্য, আলোচনা, জীবনাচরণ, গবেষণা ও অডিও ভিডিও সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের আত্মার খোরাক যুগিয়ে বিবেককে শানিত করে, ফলে সমাজ দিনে দিনে সভ্য হয়। এ ধরনের মানুষ মূলত মোম বাতির মতো নিজেকে জ¦ালিয়ে অন্যদের আলো দান করেন। এ আলোকিত অসাধারণ মানুষেরা অন্ধকার আকাশের তারকা সদৃশ, যে তারকা দেখে পথহারা নাবিকেরা সঠিক পথের সন্ধান লাভ করে সাধারণ যাত্রীদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও গবেষক