ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা
ভূমিকা: ইসলাম মানুষের চিন্তা ও আকিদা বিশ্বাস থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ের পরিপূর্ণ একমাত্র সুষ্ঠু সমাধান ও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
Printed Edition
ড. মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মাদানী
ভূমিকা: ইসলাম মানুষের চিন্তা ও আকিদা বিশ্বাস থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ের পরিপূর্ণ একমাত্র সুষ্ঠু সমাধান ও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই রহমানের বান্দাগণ তাদের অধীনস্থ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বদা সজাগ সচেতন সতর্ক ও দায়িত্ববান থাকবে এটিই ইনসাফের দাবি। আমরা জানি ইসলামী রাষ্ট্র ও দেশে দেশে প্রচলিত জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মাঝে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র [Ideological State] । এর ধরন ও প্রকৃতি প্রচলিত জাতীয় গণতান্ত্রিক [National Democratic] রাষ্ট্র থেকে একেবারেই ভিন্ন। ইসলামী রাষ্ট্র ওহী ভিত্তিক নৈতিকতার উপরে সুপ্রতিষ্ঠিত।
ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
১. যে আদর্শ ও মূলনীতির ওপর ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, তাকে কে মানে আর কে মানে না, সে হিসেবেই ইসলামী রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিভক্ত করে থাকে। ইসলামী পরিভাষায় উক্ত দুই ধরনের জনগোষ্ঠীকে যথাক্রমে মুসলিম ও অমুসলিম বলা হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন: “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হলে তা অমান্য করা, অস্বীকার করা এবং না মানার কোন সুযোগ নেই! বরং দ্বিধাহীন চিত্তে সবাই আল্লাহ এবং রাসুল সা. প্রদর্শিত সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হবে।’ সূরা নিসা:৬৫।
২. ইসলামী রাষ্ট্র চালানো তার আদর্শ ও মূলনীতিতে বিশ্বাসীদের কাজ। এ রাষ্ট্র স্বীয় প্রশাসনে অমুসলিমদের সেবা গ্রহণ করতে পারে বটে, তবে নীতি নির্ধারক ও প্রশাসনের পদ তাদের দিতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাম চার খলিফা এবং পরবর্তীতে এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম উম্মাহর আমির উমারাগণ মজলিসে শূরা, পরামর্শ সভা, আহলুল হিল্লি ওয়াল উকাদ ইত্যাদি বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী বডির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। যেখানে সদস্য হতেন ন্যায়পরায়ণ ঈমানদার যোগ্য ব্যক্তিগণই। (আল কাদা ফি হাদিস উমার রা. ২/১৯৭
৩. ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিম ও অমুসলিমদের সুস্পষ্টভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করতে বাধ্য। অমুসলিমদের কি কি অধিকার দিতে পারবে আর কি কি অধিকার দিতে পারবে না তা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়া তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন “দ্বীনের মধ্যে,ইসলামের মধ্যে জোর জবরদস্তি বলে কিছু নেই” অন্যায় তো বলা হয়েছে, “মুশরিক অমুসলিমদের কেউ যদি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, নিরাপত্তা চায় তাহলে তাদেরকে পূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে আশ্রয়- প্রশ্রয় দিন। যাতে তারা আল্লাহর কালাম আল্লাহর বিধান ইসলামের সৌন্দর্য শুনতে পারে, বুঝতে পারে। সূরা তাওবাহ ৬:
৪. ইসলামী রাষ্ট্র তার প্রশাসনে অমুসলিমদের উপস্থিতি জটিলতার সমাধান এভাবে করে যে, তাদেরকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারের কার্যকর নিশ্চয়তা guarantee] দিয়ে সন্তুষ্ট করে দেয়। নিজেদের নীতি নির্ধারণী ব্যবস্থাপনায় তাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করে এবং তাদের জন্য সব সময় এ ব্যাপারে দরজা খোলা রাখে যে, ইসলামী আদর্শ যদি তাদের ভালো লেগে যায় তাহলে তারা তা গ্রহণ করে শাসক দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে।
৫. ইসলামী রাষ্ট্র অমুসলিম সংখ্যালঘু নাগরিকদেরকে শরীয়ত প্রদত্ত অধিকারগুলো দিতে বাধ্য। এসব অধিকার কেড়ে নেয়া বা কমবেশী করার এখতিয়ার কারো নেই। এসব অধিকার ছাড়া অতিরিক্ত কিছু অধিকার যদি মুসলমানরা নিতে চায় তবে ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী না হলে তা দিতে পারে। আমরা জানি ইসলাম ইমাম দায়িত্বশীল নেতা রাষ্ট্রপ্রধানের উপরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিম্মাদারি অর্পণ করেছে। এজন্য রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শরীয়ত নির্ধারিত বিধানাবলীর ব্যাপারে কোন কমবেশি করা যাবে না ঠিকই। এর পাশাপাশি সামাজিক শৃংখলার জন্য কিছু জিনিস ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের উপরে ন্যাস্ত করা হয়েছে। আইনের পরিভাষায় বলা হয় ‘মাউকুলুন ইলাল ইমাম’ এ সমস্ত কিছু ইমামের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়:- মদখোরের শাস্তি ৮০ টি বেত্রাঘাত। রাষ্ট্রপ্রধান, বিচারক বা ইমাম যদি মনে করেন সামগ্রিক শৃঙ্খলা স্বার্থে আরও ২০টি বেত্রাঘাত নির্ধারিত আসামির জন্য প্রয়োজন, তাহলে ইমামের পক্ষ থেকে সেটি সিদ্ধান্ত দেয়া শরয়ী আইনের বিপরীত নয়।
প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
১. প্রচলিত সমাজে ইসলাম বিবর্জিত গোষ্ঠীসমূহ ভারসাম্য হীন বৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করেছে। যা জনগণের শোষণের হাতিয়ার রূপে প্রভাব ফেলছে।
প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ মনে করে, যে জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, কারা সেই জাতির বংশোদ্ভূত আর কারা তা নয়, তার ভিত্তিতেই একটা জাতীয় রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিভক্ত করে ফেলে। আধুনিক পরিভাষায় উক্ত দু’ধরনের জনগোষ্ঠীকে যথাক্রমে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বলা হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে যিনি বেশি মুত্তাকী আল্লাওয়ালা তিনিই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত’ মর্যাদা সম্মান ইজ্জত পদ-পদবি এসব কিছুই নির্ভর করবে তাকওয়া ন্যায়নীতি ইত্যাদি গুণাবলীর ভিত্তিতে। ইসলামী আইনে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বলতে কোন মৌলিক পরিভাষা নেই। অথচ প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বলে একটি বৈষম্য পূর্ণ নীতিমালা প্রচলন করেছে, যা সম্পূর্ণ নৈতিকতা বিবর্জিত।
২. প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে, জাতীয় রাষ্ট্র স্বীয় নীতি নির্ধারণ ও প্রশাসনের কাজে শুধু আপন জাতির লোকদের ওপরই নির্ভর করে। অন্যান্য সংখ্যালঘু নাগরিকদের এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য মনে করা হয় না। এ কথাটা স্পষ্ট করে বলা না হলেও কার্যত এটাই হয়ে থাকে। সংখ্যালঘুদের কোনো ব্যক্তিকে যদি কখনো কোনো শীর্ষস্থানীয় পদ দেয়াও হয়, তবে তা নিছক লোক দেখানো ব্যাপার হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে তার কোনোই ভূমিকা থাকে না।
৩.জাতীয় রাষ্ট্রের পক্ষে এরূপ দ্বিমুখী আচরণ করা নিতান্তই সহজ কাজ যে, সে দেশের সকল অধিবাসীকে নীতিগতভাবে এক জাতি আখ্যায়িত করে কাগজে কলমে সকলকে সমান অধিকার দিয়ে দেবে। কিন্তু কার্যত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু ভেদাভেদ পুরোপুরি বহাল রাখবে এবং সংখ্যালঘুদের বাস্তবিক কোনো অধিকারই দেবে না।
৪.একটি জাতীয় রাষ্ট্র স্বীয় রাষ্ট্র কাঠামোতে বিজাতীয় লোকদের উপস্থিতি জনিত জটিলতার সমাধান তিন উপায়ে করে। প্রথমত: তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত করে নিজেদের জাতিসত্তার বিলীন করে নেয়। দ্বিতীয়ত: তাদের জাতিসত্তাকে নির্মূল করার জন্য হত্যা, লুটতরাজ ও দেশান্তরিতকরণের নিপীড়নমূলক কর্মপন্থা অবলম্বন করে। তৃতীয়ত: তাদেরকে নিজেদের ভেতরে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রেখে দেয়। দুনিয়ার জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এই তিনটি কর্মপন্থা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে এবং এখনও গৃহীত হয়ে চলেছে। আজকের ভারতে খোদ মুসলমানদেরকে এসব নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
৫. যুগে যুগে দেখা গিয়েছে শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণিবৈষম্য, কৌলিন্যের বাহাদুরি ইত্যাদি। কে কোন বংশের, কে কোন গোত্রের, কে কোন প্রদেশের? এ সমস্ত অহংকারপূর্ণ দাপট ইসলামী বিধানে নেই। জাতীয় অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদেরকে যে অধিকারই দেয়া হয় তা সংখ্যাগুরুর দেয়া অধিকার। সংখ্যাগুরুরা ওসব অধিকার যেমন দিতে পারে তেমন তাতে কমবেশী করা বা একেবারে ছিনিয়ে নেয়ারও অধিকার রাখে। এ ধরনের রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা পুরোপুরিভাবে সংখ্যাগুরুর করুণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। তাদের জন্য মৌলিক মানবাধিকার পর্যন্ত।
এরই মাধ্যমে পরিষ্কার হলো ইসলামের রাষ্ট্র এবং প্রচলিত রাষ্ট্রের মৌলিক ধারণা ও গুণগত পার্থক্য।
উল্লেখিত মোলিক পার্থক্যগুলো থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, অমুসলিম সংখ্যালঘুদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের আচরণ এবং সংখ্যালঘু জাতির সাথে জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আচরণে কি আকাশ পাতাল ব্যবধান। এ ব্যবধানকে বিবেচনায় না আনলে মানুষ এই ভুল বুঝাবুঝি থেকে মুক্ত হবে না যে, আধুনিক যুগের জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সংখ্যালঘুদেরকে সমানাধিকার দেয় আর ইসলাম এ ব্যাপারে ভারসাম্য ও ইনসাফপূর্ণ কার্যকর বিধান জারি করেছে। ।
১. অমুসলিম নাগরিকের প্রকার সমুহ:
সহি হাদিসে মহানবী সাল্লাল্লাহু সাল্লাম অমুসলিম নাগরিকদের কে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। মুয়াহাদা, জিম্মি, হরবী।
এক. মুয়াহাদা: চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক।
দুই. জিম্মি: যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক-যারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
তিন. হরবী: যারা যুদ্ধ কিংবা সন্ধি ছাড়া অন্য কোনো পন্থায় ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
যদিও উক্ত তিন প্রকারের নাগরিকরাই সংখ্যালঘু অমুসলিমদের জন্য নির্ধারিত সাধারণ অধিকারগুলোতে সমভাবে অংশীদার।
১.চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিক:
যারা যুদ্ধ ছাড়া অথবা যুদ্ধ চলাকালে বশ্যতা স্বীকার করতে সম্মত হয়ে যায় এবং ইসলামী সরকারের সাথে সুনির্দিষ্ট শর্তাবলী স্থির করে সন্ধিবদ্ধ হয় তাদের জন্য ইসলামদের বিধান এই যে, তাদের সাথে সকল আচরণ তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযায়ী করা হবে। আজকালকার সভ্য জাতিগুলো এরূপ রাজনৈতিক ধড়িবাজীতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে, শত্রুপক্ষকে বশ্যতা স্বীকারে উদবুদ্ধ করার জন্য কিছু উদার শর্ত নির্ধারণ করে নেয়। তারপর যেই তারা পুরোপুরি আয়ত্তে এসে যায় অমনি শুরু হয়ে যায় ভিন্ন ধরনের আচরণ। কিন্তু ইসলাম এটাকে হারাম ও মহাপাপ গণ্য করে। কোনো জাতির সাথে যখন কিছু শর্ত স্থির করা হয়ে যায় (চাই তা মনোপুত হোক বা না হোক) এখন তাতে চুল পরিমাণও হেরফের করা যাবে না। চাই উভয় পক্ষের আপেক্ষিক অবস্থান, শক্তি ও ক্ষমতায় [Relative position] যতোই পরিবর্তন এসে থাক না কেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
‘যদি তোমরা কোনো জাতির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হও, বিজয়ী হও এবং সেই জাতি নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের প্রাণ রক্ষার্থে তোমাদের মুক্তিপণ দিতে রাযী হয় (অপর বর্ণনায় আছে যে, তোমাদের সাথে কোনো সন্ধিপত্র সম্পাদন করে) তাহলে পরবর্তী সময়ে ঐ নির্ধারিত মুক্তিপণের চেয়ে কণা পরিমাণও বেশি নিও না। কেননা সেটা তোমাদের জন্য বৈধ হবে না।’ [আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ]।
অপর হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ নাগরিকের ওপর যুলুম করবে কিংবা তার প্রাপ্য অধিকার থেকে তাকে কম দেবে, তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি বোঝা তার ওপর চাপাবে অথবা তার কাছ থেকে কোনো জিনিস তার সম্মতি ছাড়া আদায় করবে, এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি নিজেই ফরিয়াদী হবো।” [আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ]
উক্ত উভয় হাদীসের ভাষা ব্যাপক অর্থবোধক। তাই ঐ হাদীস দুটি থেকে এই সাধারণ বিধি প্রণয়ন করা হয় যে, চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকদের সাথে সন্ধিপত্রে যেসব শর্ত নির্ধারিত হবে, তাতে কোনো রকম কমবেশি করা কোনোক্রমেই জায়েয হবে না। তাদের ওপর করা খাজনাও বাড়ানো যাবে না। তাদের জমিজমাও দখল করা যাবে না, তাদের ঘরবাড়ি, দালান-কোঠাও কেড়ে নেয়া যাবে না। তাদের ওপর কড়া ফৌজদারী দণ্ডবিধিও চালু করা যাবে না, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তাদের ইজ্জত সম্মানের ক্ষতি করা যাবে না এবং তাদের সাথে এমন কোন আচরণ করা যাবে না, যা যুলুম, অধিকার হরণ, সামর্থ্যের মাত্রাতিরিক্ত বোঝা চাপানো অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে সম্পত্তি হস্তগত করার পর্যায়ে পড়ে। এই নির্দেশাবলির কারণেই ফকীহগণ সন্ধি বলে বিজিত জাতিগুলো সম্পর্কে কোনো আইন প্রণয়ন করেননি বরং শুধুমাত্র একটি সাধারণ সংক্ষিপ্ত বিধি প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত থেকেছেন। সেটি এই যে, তাদের সাথে আমাদের আচরণ হুবহু সন্ধির শর্ত অনুসারে পরিচালিত হবে। ইমাম আবু ইউসুফ লিখেছেন:
‘তাদের সন্ধিপত্রে যা নেয়া স্থির হয়েছে, তাদের কাছ থেকে শুধু তাই নেয়া হবে। তাদের সাথে সম্পাদিত সন্ধির শর্ত পূরণ করা হবে। কোনো কিছু বাড়ানো হবে না।’ [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৩৫]
২. যুদ্ধে বিজিত অমুসলিম নাগরিক-দ্বিতীয় প্রকারের অমুসলিম নাগরিক হচ্ছে যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে লড়াই করেছে এবং ইসলামী বাহিনী যখন তাদের সকল প্রতিরোধ ভেংগে তাদের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করেছে, কেবল তখনই অস্ত্র সংবরণ করেছে।
এ ধরনের বিজিতদেরকে যখন “সংরক্ষিত নাগরিকে” (যিম্মী) পরিণত করা হয়, তখন তাদের কয়েকটি বিশেষ অধিকার দেয়া হয়। ফিক্হ্ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাবলীতে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। নিম্নে এই সকল বিধির একটা সংক্ষিপ্তসার দেয়া হচ্ছে। এ থেকে এই শ্রেণীর অমুসলিম নাগরিকদের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাবে :
১. মুসলমানদের সরকার তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই তাদের সাথে সংরক্ষণ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবে এবং তাদের জান ও মালের হিফাযত করা মুসলমানদের জন্য ফরয হয়ে যাবে। কেননা জিযিয়া গ্রহণ করা মাত্রই প্রমাণিত হয় যে, জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। [বাদায়েউস্ সানায়ে, ৭ম খণ্ড, ১১১ পৃষ্ঠা]
এরপর মুসলিম সরকারের বা সাধারণ মুসলমানদের এ অধিকার থাকে না যে, তাদের সম্পত্তি দখল করবে বা তাদেরকে দাসদাসী বানাবে। হযরত ওমার রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হযরত আবু উবায়দাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেনঃ
‘যখন তুমি তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করবে, তখন তোমার আর তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না।’ [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮২]
২. “সংরক্ষিত নাগরিকে” (যিম্মী) পরিণত হয়ে যাওয়ার পর তাদের জমির মালিক তারাই হবে। সেই জমির মালিকানা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হবে এবং তারা নিজেদের সম্পত্তি বেচা, কেনা, দান করা ও বন্ধক রাখা ইত্যাদির নিরঙ্কুশ অধিকারী হবে। ইসলামী সরকার তাদেরকে বেদখল করতে পারবে না। [ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৯]
৩. জিযিয়ার পরিমাণ তাদের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। যারা ধনী তাদের কাছ থেকে বেশি, যারা মধ্যবিত্ত তাদের কাছ থেকে কিছু কম এবং যারা দরিদ্র তাদের কাছ থেকে অনেক কম নেয়া হবে। আর যার কোনো উপার্জনের ব্যবস্থা নেই অথবা যে অন্যের দান-দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে, তার জিযিয়া মাফ করে দেয়া হবে। জিযিয়ার জন্য যদিও কোনো বিশেষ পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই, তবে তা অবশ্যই এভাবে নির্ধারিত হওয়া চাই যাতে তা দেয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ধনীদের ওপর মাসিক এক টাকা, মধ্যবিত্তদের ওপর মাসিক ৫০ পয়সা এবং গরীব লোকদের ওপর মাসিক ২৫ পয়সা জিযিয়া আরোপ করেছিলেন। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৩৬]
৪. জিযিয়া শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম লোকদের ওপর আরোপ করা হবে। যারা যুদ্ধ করতে সমর্থ নয়, যথা শিশু, নারী পাগল, অন্ধ, পংগু, উপাসনালয়ের সেবক, সন্যাসী, ভিক্ষু, খুনখুনে বৃদ্ধ। বছরের উল্লেখযোগ্য সময় রোগে কেটে যায় এমন রোগী, এবং দাস দাসী ইত্যাদিকে জিযিয়া দিতে হবে না। [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১১-১১৩; ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩, ৩৭২; কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭৩]
৫. যুদ্ধের মাধ্যমে দখলীকৃত জনপদের উপাসনালয় দখল করার অধিকার মুসলমানদের রয়েছে। তবে সৌজন্য বশত এই অধিকার ভোগ করা থেকে বিরত থাকা এবং উপাসনালয়গুলোকে যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় বহাল রাখা উত্তম। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে যতো দেশ বিজিত হয়েছে তার কোথাও কোনো উপাসনালয় ভাঙ্গা হয়নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ইমাম আবু ইউসুফ লিখেছেন:
“সেগুলোকে যেমন ছিলো তেমনভাবেই রাখা হয়েছে। ভাঙ্গা হয়নি বা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়নি।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮৩]তবে প্রাচীন উপাসনালয়গুলোকে ধ্বংস করা কোনো অবস্থায়ই বৈধ নয়। [বাদায়ে,৭/ ১১৪]
[ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার,ও ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা ইত্যাদি বইয়ে বিস্তারিত পাওয়া যাবে]
অমুসলিম নাগরিকদের সাধারণ অধিকার
উল্লেখিত তিন শ্রেণীর নাগরিকদের সকলেই নিম্নোক্ত অধিকারগুলোতে সমান অংশীদার।
১. প্রাণের নিরাপত্তার অধিকার: অমুসলিম নাগরিকদের রক্তের মূল্য মুসলমানদের রক্তের মূল্যের সমান। কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, তাহলে একজন মুসলমান নাগরিককে হত্যা করলে যেমন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো ঠিক তেমনি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলে জনৈক মুসলমান অমুসলিমকে হত্যা করলে তিনি খুনীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তিনি বলেন “যে নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে, তার রক্তের বদলা নেয়ার দায়িত্ব আমারই।” [ইনায়া শরহে হিদায়া, ৮ম খণ্ড, ২৫৬ পৃষ্ঠা]
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হীরাবাসী অমুসলিম যিম্মীকে হত্যা করে। তিনি খুনীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পনের আদেশ দেন। অতঃপর তাকে উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণ করা হলে তারা তাকে হত্যা করে। [বুরহান শরহে মাওয়াহিবুর রহমান, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৭] উসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে হযরত ওমরের ছেলে উবায়দুল্লাহকে হত্যার পক্ষে ফতোয়া দেয়া হয়। কেননা তিনি হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে হরমুযান ও আবু লুলুর মেয়েকে হত্যা করেন। আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে জনৈক মুসলমান জনৈক অমুসলিমের হত্যার দায়ে গ্রেফতার হয়। যথারীতি দোষ সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। এই সময় নিহত ব্যক্তির ভাই এসে বললো, “আমি মাফ করে দিয়েছি।” কিন্তু তিনি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে বললেন, “ওরা বোধ হয় তোমাকে ভয় দেখিয়েছে।” সে বললো, “না, আমি রক্তপণ পেয়েছি এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওকে হত্যা করলে আমার ভাই ফিরে আসবে না।” তখন তিনি খুনীকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন: “আমাদের অধীনস্থ অমুসলিম নাগরিকদের রক্ত আমাদের রক্তের মতোই এবং তাদের রক্তপণ আমাদের রক্তপণের মতোই।” [বুরহান, ২য় খণ্ড, ২৮২ পৃষ্ঠা]।
অপর এক বর্ণনা মুতাবিক হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছিলেন “তারা আমাদের নাগরিক হতে রাজি হয়েছেই এই শর্তে যে, তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো এবং তাদের রক্ত আমাদের মতো মর্যাদাসম্পন্ন হবে।”
এ কারণেই ফকীহগণ এই বিধি প্রণয়ন করেছেন যে, কোনো অমুসলিম নাগরিক কোনো মুসলমানের হাতে ভুলক্রমে নিহত হলে তাকেও অবিকল সেই রক্তপণ দিতে হবে, যা কোনো মুসলমানের নিহত হবার ক্ষেত্রে দিতে হয়। [র্দুরুল মুখতার, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০৩]
২. ফৌজদারী দণ্ডবিধি অধিকার : ফৌজদারী দণ্ডবিধি মুসলিম অমুসলিম সকলের জন্য সমান। অপরাধের যে সাজা মুসলমানকে দেয়া হয়, অমুসলিম নাগরিককেও তাই দেয়া হবে। অমুসলিমের জিনিস যদি মুসলমান চুরি করে, কিংবা মুসলমানের জিনিষ যদি অমুসলিম চুরি করে, তাহলে উভয় ক্ষেত্রেই চোরের হাত কেটে ফেলা হবে। কারো ওপর ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে অপবাদ আরোপকারী মুসলমানই হোক আর অমুসলমানই হোক উভয়কেই একই শাস্তি দেয়া হবে। অনুরূপভাবে ব্যভিচারের শাস্তিও মুসলিম ও অমুসলিমের জন্য একই রকম। তবে মদের বেলায় অমুসলিমদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। [কিতাবুল খারাজ, পৃ. ২০৮, ২০৯; আল-মাব্সূত, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৫৭-৫৮। ইমাম মালেকের মতে অমুসলিমকে মদের ন্যায় ব্যভিচারের শাস্তি থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ইমাম মালেকের অভিমতের উৎস হলো হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এই সিদ্ধান্ত যে, অমুসলিম নাগরিক ব্যভিচার করলে তার ব্যাপারটা তাদের সম্প্রদায়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ তাদের ধর্মীয় বা পারিবারিক আইন অনুসারে কাজ করতে হবে।]
৩. দেওয়ানী আইন অধিকার: দেওয়ানী আইনেও মুসলমান ও অমুসলমান সমান। “তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো” আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এই উক্তির তাৎপর্য এই যে, মুসলমানের সম্পত্তি যেভাবে হিফাযত করা হয় অমুসলিমের সম্পত্তির হিফাযতও তদ্রূপ সাম্যের অনিবার্য দাবী অনুসারে দেওয়ানী আইনের আলোকে মুসলমানদের ওপর যেসব দায় দায়িত্ব অর্পিত হয় অমুসলিমের ওপরও তাই অর্পিত হবে।
ব্যবসায়ের যেসব পন্থা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ, তা তাদের জন্যও নিষিদ্ধ। তবে অমুসলিমরা শুধুমাত্র শূকরের বেচাকেনা, খাওয়া এবং মদ বানানো, পান ও কেনাবেচা করতে পারবে। [আল-মাসবূত, ১৩শ খণ্ড, পৃ. ৩৭-৩৮]
কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিমের মদ বা শূকরের ক্ষতি সাধন করলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। র্দুরে মুখতারে আছে “মুসলমান যদি মদ ও শূকরের ক্ষতি করে তবে তার মূল্য দিতে বাধ্য থাকবে।” [৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩]
৪. সম্মানের হিফাযত অধিকার: কোনো মুসলমানকে জিহবা বা হাত পা দিয়ে কষ্ট দেয়া, গালি দেয়া, মারপিট করা বা গীবত করা যেমন অবৈধ, তেমনি এসব কাজ অমুসলিমের বেলায়ও অবৈধ। র্দুরুল মুখতারে আছেঃ “তাকে কশঝট দেয়া থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব এবং তার গীবত করা মুসলমানের গীবত করার মতোই হারাম।” [৩য় খণ্ড, পৃঃ. ২৭৩-২৭৪]
৫. অমুসলিমদের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা অধিকার: ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। তাদের জীবন, সম্পত্তি এবং সম্মান সুরক্ষিত। অমুসলিমদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চুক্তি মুসলমানদের জন্য চিরস্থায়ীভাবে বাধ্যতামূলক অর্থাৎ এই চুক্তি করার পর তারা তা ভাঙতে পারে না। অপরদিকে অমুসলিমদের এখতিয়ার আছে যে, তারা যতোদিন খুশী তা বহাল রাখতে পারে এবং যখন ইচ্ছা ভেঙে দিতে পারে ‘বাদায়ে’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে “অমুসলিমদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দানের চুক্তি আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। মুসলমানরা কোনো অবস্থাতেই তা ভাঙতে পারে না। পক্ষান্তরে অমুসলিমদের পক্ষে তা বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ তারা যদি আমাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চায় তবে তা করতে পারে।” [র্দুরুল মুখতার, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১২]
অমুসলিম নাগরিক যতো বড় অপরাধই করুক, তাদের রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচ সম্বলিত নাগরিকত্ব বাতিল হয় না। এমনকি জিযিয়া বন্ধ করে দিলে, কোনো মুসলমানকে হত্যা করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বেয়াদবি করলে অথবা কোনো মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করলেও তার নিরাপত্তার গ্যারান্টিযুক্ত নাগরিকত্ব বাতিল হয় না। এসব কাজের জন্য তাকে অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু বিদ্রোহী আখ্যায়িত করে নাগরিকত্বহীন করা হবে না। এক যদি সে মুসলমানদের দেশ ছেড়ে গিয়ে শত্রুদের সাথে মিলিত হয়। দুই যদি সে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে অরাজকতার সৃষ্টি করে [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১১৩; ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৮১-৩৮২]
৬. পারিবারিক বিষয়াদি অধিকার: অমুসলিমদের পারিবারিক কর্মকাণ্ড তাদের নিজস্ব পারিবারিক আইন [চবৎংড়হধষ খধ]ি অনুসারে স্থির করা হবে। এক্ষেত্রে তাদের ওপর ইসলামী আইন কার্যকর হবে না। আমাদের ঘরোয়া জীবনে যেসব জিনিস অবৈধ, তা যদি তাদের ধর্মীয় ও জাতীয় আইনে বৈধ হয়, তাহলে ইসলামী আদালত তাদের আইন অনুসারেই ফয়সালা করবে। উদাহরণ স্বরূপ সাক্ষী ছাড়া বিয়ে, মুহ্র ছাড়া বিয়ে, ইদ্দতের মধ্যে পুনরায় বিয়ে অথবা ইসলামে যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ তাদের সাথে বিয়ে যদি তাদের আইনে বৈধ থেকে থাকে, তাহলে তাদের জন্য এসব কাজ বৈধ বলে মেনে নেয়া হবে। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং তাদের পরবর্তী সকল যুগে ইসলামী সরকারগুলো এই নীতিই অনুসরণ করেছে। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয এ ব্যাপারে হাসান বস্রীর কাছে নিম্নরূপ প্রশ্ন করেছিলেন:
“খোলাফায়ে রাশেদিন অমুসলিম নাগরিকদেরকে নিষিদ্ধ মেয়েদের সাথে বিয়ে, মদ ও শূকরের ব্যাপারে স্বাধীন ছেড়ে দিলেন কিভাবে?” জবাবে হযরত হাসান লিখেছেন “তারা জিযিয়া দিতে তো এজন্যই সম্মত হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের আকীদা-বিশ্বাস অনুসারে জীবন যাপন করার স্বাধীনতা দিতে হবে। আপনার কর্তব্য পূর্ববর্তীদের পদ্ধতি অনুসরণ করা, নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা নয়।”। তবে কোনো ক্ষেত্রে যদি বিবদমান উভয় পক্ষ স্বয়ং ইসলামী আদালতে আবেদন জানায় যে, ইসলামী শরীয়ত মুতাবিক তাদের বিবাদের ফায়সালা করা হোক, তবে আদালত তাদের ওপর শরীয়তের বিধান কার্যকর করবে। তাছাড়া পারিবারিক আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো বিবাদের যদি একপক্ষ মুসলমান হয়, তবে ইসলামী শরীয়ত মুতাবিক ফায়সালা হবে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন খৃষ্টান মহিলা কোনো মুসলমানের স্ত্রী ছিলো এবং তার স্বামী মারা গেলো। এমতাবস্থায় এই মহিলাকে শরীয়ত মুতাবিক স্বামীর মৃত্যুজনিত ইদ্দত পুরোপুরি পালন করতে হবে। ইদ্দতের ভেতরে সে বিয়ে করলে সে বিয়ে বাতিল হবে। [আল-মাবসূত, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮-৪১]
৭. ধর্মীয় অনুষ্ঠান অধিকার: ইসলামে মুক্তভাবে ধর্ম পালনের অধিকারকে সমর্থন করে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে যে, “ধর্মে কোনো জোরজবরদস্তি নেই” (আল বাক্বারা ২৫৬)। অমুসলিমদের ধর্মীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠানাদি প্রকাশ্যভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান এই যে, অমুসলিমরা তাদের নিজস্ব জনপদে এটা অবাধে করতে পারবে। তবে নির্ভেজাল ইসলামী জনপদ্গুলোতে ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার ইচ্ছা করলে তাদেরকে এ ব্যাপারে অবাধ স্বাধীনতাও দিতে পারবে, আবার কোনো ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করতে চাইলে তাও করতে পারবে। [নির্ভেজাল ইসলামী জনপদ শরীয়াতের পরিভাষায় “আমসারুল মুসলিমীন” (বিধিরুদ্ধ ইসলামী জনপদ) আখ্যায়িত অঞ্চলকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যেসব অঞ্চলের ভূসম্পত্তি মুসলমানদের মালিকানাভুক্ত এবং যেসব অঞ্চলকে মুসলমানরা ইসলামী অনুষ্ঠানাদি ও উদযাপনের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। বাদায়ে গ্রন্থে বলা হয়েছে “যেসব জনপদ বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদ নয়, সেখানে অমুসলিমদেরকে মদ ও শূকর বিক্রি, ক্রুশ বহন করা ও শঙ্খ ধ্বনি বাজানোতে বাধা দেয়া হবে না। চাই সেখানে মুসলিম অধিবাসীদের সংখ্যা যতোই বেশি হোক না কেনো। তবে বিধিবদ্ধ ইসলামী অঞ্চলে এসব কাজ পছন্দনীয় নয়। অর্থাৎ যেসব জনপদকে জুমুয়া, ঈদ ও ফৌজদারী দণ্ডবিধি প্রচলনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।ৃ তবে যে সমস্ত পাপ কাজকে তারাও নিষিদ্ধ মনে করে, যেমন ব্যভিচার ও অন্যান্য অশ্লীল কাজ, যা তাদের ধর্মেও নিষিদ্ধ সেসব কাজ প্রকাশ্যে করতে তাদেরকে সর্বাবস্থায় বাঁধা দেয়া হবে।
চাই সেটা মুসমানদের জনপদে হোক কিংবা তাদের জনপদে হোক।” [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১১৩] কিন্তু বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদগুলোতে তাদেরকে শুধুমাত্র ক্রুশ ও প্রতিমাবাহী শোভাযাত্রা বের করতে এবং প্রকাশ্যে ঢাকঢোল বাজাতে বাজাতে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে প্রাচীন উপাসনালয়গুলোর অভ্যন্তরে তারা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। ইসলামী রাষ্ট্রের সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করবে না। [র্শহু সিয়ারিল কবীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫১]
৮. উপাসনালয় সংক্রান্ত অধিকার : নির্ভেজাল মুসলিম জনপদ্গুলোতে অমুসলিমদের যেসব প্রাচীন উপাসনালয় থাকবে, তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। উপাসনালয় যদি ভেঙে যায়, তবে একই জায়গায় পুননির্মাণের অধিকারও তাদের আছে। [বাদায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৪; শরহু সিয়রিল কবীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫১] অমুসলিমদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণের অবাধ অনুমতি রয়েছে। অনুরূপভাবে যেসব এলাকা এখন আর বিধিবদ্ধ ইসলামী জনপদ নেই, সরকার যেখানে জুমুয়া, ঈদ ও ফৌজদারী দণ্ডবিধির প্রচলন বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানেও অমুসলিমদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণ নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অধিকার রয়েছে। [দায়ে, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৪; শরহু সিয়রিল কবীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৫৭]
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর ফতোয়া নিম্নরূপ “যেসব জনপদকে মুসলমানরা বাসযোগ্য বানিয়েছে, সেখানে অমুসলিমদের নতুন মন্দির, গীর্জা ও উপাসনালয় বানানো, বাদ্য বাজানো এবং প্রকাশ্যে শূকরের গোশত ও মদ বিক্রি করার অধিকার নেই। আর অনারবদের হাতে আবাদকৃত, পরে মুসলমানদের হাতে বিজিত এবং মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকারকারী জনপদে অমুসলিমদের অধিকার তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত অনুসারে চিহ্নিত হবে। মুসলমানরা তা মেনে চলতে বাধ্য থাকবে।
১০. বাণিজ্য কর অধিকার: মুসলিম ব্যবসায়ীদের মতো অমুসলিম ব্যবসায়ীদেরও বাণিজ্য পণ্যের ওপর কর আরোপ করা হবে যদি তাদের মূলধন ২০০ দিরহাম পর্যন্ত পৌঁছে অথবা তারা ২০ মিসকাল স্বর্ণের মালিক হয়ে যায়। [কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৭০। তবে আজও কর আরোপের জন্য অবিকল এই পরিমাণ নিসাব নির্ধারণ করা জরুরি নয়। এটা সেই সময়কার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হয়েছিল।] এ কথা সত্য যে, ফিকাহ শাস্ত্রকারকগণ অমুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর বাণিজ্যের শতকরা ৫ ভাগ এবং মুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর আড়াই ভাগ আরোপ করেছিলেন। তবে এ কাজটা কুরআন বা হাদীসের কোনো সুস্পষ্ট বাণীর আলোকে করা হয়নি। এটা তাদের ইজতিহাদ বা গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত ছিলো। এটা সমকালীন পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে করা হয়েছিল। সে সময় মুসলমানগণের অধিকাংশই দেশ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং সমস্ত ব্যবসায় বাণিজ্য অমুসলিমদের হাতে চলে গিয়েছিল। এজন্য মুসলিম ব্যবসায়ীদের উৎসাহ বৃদ্ধি এবং তাদের ব্যবসায়ের সংরক্ষণের জন্য তাদের ওপর কর কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
১১ . সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি: অমুসলিমগণ সামরিক দায়িত্বমুক্ত। শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এককভাবে শুধু মুসলমানদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। কারণ একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেবল তারাই উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে, যারা ঐ আদর্শকে সঠিক বলে মানে। তাছাড়া লড়াইতে নিজেদের আদর্শ ও মূলনীতি মেনে চলাও তাদের পক্ষেই সম্ভব। অন্যেরা দেশ রক্ষার জন্য লাড়াই করলে ভাড়াটে সৈন্যের মতো লড়বে এবং ইসলামের নির্ধারিত নৈতিক সীমা রক্ষা করে চলতে পারবে না। এজন্য ইসলাম অমুসলিমদের সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়েছে এবং কেবলমাত্র দেশ রক্ষার কাজের ব্যয় নির্বাহে নিজেদের অংশ প্রদানকে তাদের কর্তব্য বলে চিহ্নিত করেছে। এটাই শুধু যে আনুগত্যের প্রতীক তা নয় বরং সামরিক কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি লাভ ও দেশ রক্ষার বিনিময়ও বটে। এজন্য জিযিয়া শুধুমাত্র যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদের ওপরই আরোপ করা হয়। আর কখনো যদি মুসলমানরা অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষম হয়, তাহলে জিযিয়ার টাকা ফেরত দেয়া হয়। [এ বিষয়ে বিস্তারিত অধ্যায়নের জন্য দেখুন আল-মাবসূত, ১০খণ্ড, পৃ. ৭৮-৭৯: হিদায়া, কিতাবুল সিয়ার: ফাতহুল কাদীর, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩২৭-৩২৭ এবং ৩৬৯-৩৭০। কোনো বহিশত্রুর আক্রমণের সময় দেশের অমুসলিম নাগরিকরা যদি দেশ রক্ষার কাজে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে, তবে আমরা তাদেরকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে পারি। তবে সে ক্ষেত্রে তাদের জিযিয়া রহিত করতে হবে।
উল্লেখ যে, জিযিয়ার নাম শুনতেই অমুসলিমদের মনে যে আতংক জন্মে সেটা শুধু মাত্র ইসলামের শত্রুদের দীর্ঘকাল ব্যাপী অপপ্রচারের ফল। অন্যথায় এই আতংকের কোনো ভিত্তি নাই। জিযিয়া মূলত ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন যাপনের সুযোগ পায় তারই বিনিময়। শুধু মাত্র সক্ষম ও প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের কাছ থেকে এটা নেয়া হয়।
এটাকে যদি ইসলাম গ্রহণ না করার জরিমানা বলা হয়, তাহলে যাকাতকে কি বলা হবে? যাকাত তো শুধু প্রত্যেক সক্ষম পুরুষই নয় বরং সক্ষম নারীর কাছ থেকেও আদায় করা হয়। ওটা কি তাহলে ইসলাম গ্রহণের জরিমানা?] ইয়ামুকের যুদ্ধে যখন রোমকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশ ঘটালো এবং মুসলমানরা সিরিয়ার সকল বিজিত এলাকা পরিত্যেগ করে একটি কেন্দ্রে নিজেদের শক্তি কেন্দীভূত করতে বাধ্য হলো, তখন হযরত আবু উবাইদা নিজের অধীনস্থ সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা যে সব জিযিয়া ও খাজনা অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করেছিলে তা তাদের ফিরিয়ে দাও এবং বলো যে, “এখন আমরা তোমাদের রক্ষা করতে অক্ষম, তাই যে অর্থ তোমাদের রক্ষা করার বিনিময়ে আদায় করেছিলাম তা ফেরত দিচ্ছি“। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ১১১]
এই নির্দেশ মুতাবিক সকল সেনাপতি আদায় করা অর্থ ফেরত দিলেন। এ সময় অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ঐতিহাসিক বালাযুরী লিখেছেন, মুসলমান সেনাপতিগণ যখন সিরিয়ার হিমস নগরীতে জিযিয়ার অর্থ ফেরত দেন, তখন সেখানকার অধিবাসীবৃন্দ সমস্বরে বলে উঠে, “ইতিপূর্বে যে যুলুম অত্যাচারে আমরা নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম, তার তুলনায় তোমাদের শাসন ও ন্যায়বিচারকে আমরা বেশি পছন্দ করি। এখন আমরা যুদ্ধ করে পরাজিত হওয়া ছাড়া কোনো মতেই হিরাক্লিয়াসের কর্মচারীদেরকে আমাদের শহরে ঢুকতে দেবো না।” [ফুতূহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ১৩৭]
১২. সহনশীলতা ও সহাবস্থান: আধুনিক সমাজে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের মানুষের বসবাস। কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে, সহনশীলতা ও সদয় আচরণ সমাজে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক। আলোচনার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানোর আহ্বান করা হয়েছে। আধুনিক সমাজে বিভিন্ন মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিতে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। সুরা আল-নাহল:১২৫
১৩. মানবিক মূল্যবোধ: সদয় আচরণ এবং মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব সমাজে বিশ্বাস ও সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে। এটি সামাজিক সম্প্রীতি এবং সহযোগিতা বাড়ায়।
১৪. বৈচিত্র্যের মর্যাদা: বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক পরিচিতি ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করা। আধুনিক সমাজে বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করে তা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সহায়ক।
১৫. সমাজে সহাবস্থান ও মানবিক সম্পর্কের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি: অমুসলিমদের প্রতি সদয় আচরণ সমাজে একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে সবাই নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে।
“তুমি তোমার প্রভুর পথে প্রজ্ঞার সাথে এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে ডাকো। এবং তাদের সাথে সবচেয়ে উত্তমভাবে আলোচনা কর।” সুরা আল-নাহল:১২৫ “যারা একে অপরকে সত্য ও ধৈর্য সহকারে উৎসাহিত করে।” (এটি সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে সদয় আচরণের গুরুত্ব নির্দেশ করে।) সুরা আল-আসর:৩
১৬.অমুসলিমদের প্রতি সদয় আচরণের গুরুত্ব : অমুসলিমদের প্রতি সদয় আচরণের সম্পর্কিত কুরআনের কিছু উল্লেখযোগ্য আয়াত:
‘আল্লাহ তোমাদেরকে সেই সব লোকদের সাথে সদয় আচরণ করতে নিষেধ করেনি, যারা তোমাদের সাথে ধর্মের ব্যাপারে যুদ্ধ করে না এবং তোমাদের দেশ থেকে তোমাদের বের করে দেয় না।’ সুরা আল-মুমতাহিনা : ৮
‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে পূজা করে, তাদের সম্পর্কে সৎ কথা বল এবং তাদের সাথে সদয় আচরণ কর।’ সুরা আল-আনকাবুত:৪৬
“হে মানবজাতি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার।”- সুরা আল-হুজুরাত:১৩
উল্লেখিত আয়াতগুলো অমুসলিমদের প্রতি সদয় আচরণের নির্দেশ দেয় এবং তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গুরুত্বকে তুলে ধরে
১৭. ইসলামে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কিছু বিশেষ প্রস্তাব রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো:
ক. জিযিয়া ও কর আদায়ে সুবিধা দান: (ঔরুুধ): এটি একটি বিশেষ কর, যা ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। এই করের বদলে অমুসলিমরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সেবা পায়, এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকে। জিযিয়া ও কর আদায়ে অমুসলিম নাগরিকদের ওপর কঠোরতা প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ। তাদের সাথে নম্র ও কোমল ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। তারা বহন করতে পারে না এমন বোঝা তাদের ওপর চাপাতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত ওমরের নির্দেশ ছিলো, “যে পরিমাণ সম্পদ রাষ্ট্রকে প্রদান করা তাদের সামর্থের বাইরে তা দিতে তাদেরকে বাধ্য করা চলবে না।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮, ৮২] জিযিয়ার বদলায় তাদের ধন সম্পদ নিলামে চড়ানো যাবে না। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার জনৈক কর্মচারীকে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন যে, “কর খাজনা বাবদে তাদের গরু, গাধা কাপড় চোপড় বিক্রি করো না।” [ফাতহুল বায়ান, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৩]
অপর এক ঘটনায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু স্বীয় কর্মচারীকে পাঠানোর সময় বলে দেনঃ “তাদের শীত গ্রীষ্মের কাপড়, খাবারের উপকরণ ও কৃষি কাজের পশু খাজনা আদায়ের জন্য বিক্রি করবে না, প্রহার করবে না, দাঁড়িয়ে রেখে শাস্তি দেবে না এবং খাজনার বদলায় কোনো জিনিস নিলামে চড়াবে না। কেননা আমরা তাদের শাসক হয়েছি বলে নরম ব্যবহারের মাধ্যমে আদায় করাই আমাদের কাজ। তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে আল্লাহ্ আমার পরিবর্তে তোমাকে পাকড়াও করবেন। আর আমি যদি জানতে পারি যে, তুমি আমার আদেশের বিপরীত কাজ করেছো, তাহলে আমি তোমাকে পদচ্যুত করবো। [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৯] জিযিয়া আদায়ে যে কোনো ধরনের কঠোরতা প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গভর্নর হযরত আবু উবায়দাকে যে ফরমান পাঠিয়েছিলেন তাতে অমান্য নির্দেশের পাশাপাশি এ নির্দেশও ছিলো “মুসলমানদেরকে অমুসলিমদের ওপর যুলুম করা, কষ্ট দেয়া এবং অন্যায়ভাবে তাদের সম্পত্তি ভোগ দখন করা থেকে বিরত রাখো।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮২]
সিরিয়া সফরকালে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দেখলেন, সরকারী কর্মচারীরা জিযিয়া আদায় করার জন্য অমুসলিম নাগরিকদের শাস্তি দিচ্ছে। তিনি তাদের বললেন, “ওদের কষ্ট দিও না। তোমরা যদি ওদের কষ্ট দাও তবে আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তোমাদের শাস্তি দিবেন।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭১]
হিশাম ইবনে হাকাম দেখলেন, জনৈক সরকারী কর্মচারী জিযিয়া আদায় করার জন্য জনৈক কিবতীকে রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তিনি তাকে তিরস্কার করলেন এবং বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
“যারা দুনিয়ায় মানুষকে শাস্তি দেবে, আল্লাহ্ তাদেরকে শাস্তি দেবেন।” [আবু দাউদ]
মুসলিম ফিক্হ্ শাসকারগণ জিযিয়া দেয়া অস্বীকারকারীদের বড়জোর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়ার অনুমতি দিয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ বলেন, “তবে তাদের সাথে সদয় আচরণ করা হবে এবং প্রাপ্য জিযিয়া না দেয়া পর্যন্ত আটক করে রাখা হবে।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭০] যেসব অমুসলিম নাগরিক দারিদ্র্যের শিকার ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়, তাদের জিযিয়া তো মাফ করা হবেই, উপরন্তু ইসলামী কোষাগার থেকে তাদের জন্য নিয়মিত সাহায্যও বরাদ্দ করা হবে। হযরত খালিদ হীরাবাসীদের যে লিখিত নিরাপত্তা সনদ দিয়েছিলেন, তাতে একথাও লেখা ছিলো “আমি হীরাবাসী অমুসলিমদের জন্য এ অধিকারও সংরক্ষণ করলাম যে, তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বার্ধক্যের দরুন কর্মক্ষমতা হারিয়ে বসেছে, যার ওপর কোনো দুর্যোগ নেমে এসেছে অথবা যে পুর্বে ধনী ছিলো, পরে দরিদ্র হয়ে গেছে, ফলে তার স্বধর্মের লোকেরাই তাকে দান-দক্ষিণা দিতে শুরু করেছে, তার জিযিয়া মাফ করে দেয়া হবে এবং তাকে ও তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের বাইতুলমাল থেকে ভরণপোষণ করা হবে।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৮৫] একবার ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জনৈক বৃদ্ধ লোককে ভিক্ষা করতে দেখে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বললো, “কী আর করবো বাপু, জিযিয়া দেয়া জন্যে ভিক্ষে করছি।” এ কথা শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ তার জিযিয়া মাফ ও ভরণপোষণের মাসিক বৃত্তি নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি কোষাগারের কর্মকর্তাকে লিখলেন, “আল্লাহর কসম! এটা কখনো ইনসাফ নয় যে, আমরা যৌবনে তার দ্বারা উপকৃত হবো, আর বার্ধক্যে তাকে অপমান করবো।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭২; ফাতহুল কাদীর, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭৩] দামেস্ক সফরের সময়ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অক্ষম অমুসলিম নাগরিকদের জন্য বৃত্তি নির্ধারণ করার আদেশ জারী করেছিলেন। [বালাযুরী, ফুতূহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ১২৯] কোনো মুসলিম নাগরিক মারা গেলে তার কাছে প্রাপ্য বকেয়া জিযিয়া তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে থেকে আদায় করা হবে না এবং তার উত্তরাধিকারীদের ওপরও এর দায়ভার চাপানো হবে না। ইমাম আবু ইউসুফ বলেনঃ “কোনো অমুসলিম নাগরিক তার কাছে প্রাপ্য জিযিয়া পুরো অথবা আংশিক দেয়ার আগেই মারা গেলে তা তার উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে বা তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আদায় করা হবে না।” [কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৭০; আল-মাসবূত, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮১]
তিরমিজি, মুসলিম ও বুখারির হাদিস: যেখানে উল্লেখ আছে যে, নবী মুহাম্মদ (সা.) অমুসলিমদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেননি এবং তাদের প্রতি সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ফিকহ (Islamic Jurisprudence): বিভিন্ন ইসলামী আইনবিদদের মধ্যে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিভিন্ন মতামত রয়েছে, যা তাদের ধর্ম পালনের অধিকারকে সমর্থন করে।
খ. অর্থনৈতিক অধিকার: অমুসলিমদের ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার অধিকার রয়েছে। তাদের সম্পত্তি এবং ব্যবসা সুরক্ষিত। এই অধিকারগুলো একটি ইসলামী সমাজে শান্তি এবং সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক। তবে, বিভিন্ন দেশের বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এই অধিকারগুলোর বাস্তবায়ন ভিন্ন হতে পারে।
১৮. প্রাণের নিরাপত্তা: অমুসলিম নাগরিকদের রক্তের মূল্য মুসলমানদের রক্তের সমান। কোনো মুসলমান যদি অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, ঠিক যেমন মুসলমানকে হত্যা করলে হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলে অমুসলিম হত্যার জন্য মুসলমানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
১৯. দেওয়ানী আইন: দেওয়ানী আইনের ক্ষেত্রে মুসলমান ও অমুসলিমের অধিকার সমান। আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর মতে, অমুসলিমের সম্পত্তি মুসলমানের সম্পত্তির মতোই হিফাযত করা হবে।
২০. সম্মানের হিফাযত: অমুসলিমদের সম্মান রক্ষা করা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো মুসলমান যদি অমুসলিমকে গালি দেয় বা কষ্ট দেয়, তাহলে সেটি অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য ।
২১. নিরাপত্তার গ্যারান্টি: অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক। তাদের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ।
সমাপনী কথা: সংক্ষিপ্তভাবে মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের মৌলিক অধিকারসমূহ উল্লেখিত হলো। মূলত আলোচ্য অধিকারগুলো ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের জন্য একটি সুরক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করে, যেখানে তারা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পরিচালনা করতে পারে।
লেখক : ইসলামি স্কলার