DailySangram-Logo

জীবনবোধ প্রসঙ্গে

জীবন সম্পর্কিত আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই ‘জীবনবোধ’ শব্দটা উচ্চারণ করে থাকি। জীবনবোধ, মানবিকমূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা আমাদের কতটা প্রয়োজন? সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান তত উৎকর্ষ লাভ করছে।

Printed Edition
Sangram-Default Image

আবু মহি মুসা

জীবন সম্পর্কিত আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই ‘জীবনবোধ’ শব্দটা উচ্চারণ করে থাকি। জীবনবোধ, মানবিকমূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা আমাদের কতটা প্রয়োজন? সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান তত উৎকর্ষ লাভ করছে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু একই সাথে মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জীবনের গতি পাল্টে যাচ্ছে। জীবন হয়ে পড়ছে দুর্বিষহ। কাজেই এ বিষয়গুলো সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন, প্রয়োজন শুধু জানার জন্যই নয়, জীবনকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার জন্যও। প্রশ্ন হচ্ছে জীবনবোধ কী? আমরা এটা বুঝতে পারি যে, জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বহুল উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে ‘প্রেম-ভালোবাসা’, এ সম্পর্কেও আমাদের সঠিক কোনো ধারণা নেই । বাস্তবজীবনে এভাবে আমরা অনেক শব্দ প্রয়োগ করে থাকি, কিন্তু তার মর্মার্থ জানি না। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনবোধ শব্দটা অত্যন্ত কঠিন একটি বিষয়। কঠিন বলেই এ বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা দেখা যায়নি।

জীবনবোধ সম্পর্কে জানতে হলে, আগে জানতে হবে জীবন কাকে বলে? দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে যে, মহাবিশ্ব মৌলিকভাবে দুভাগে বিভক্ত। একটি বস্তুজগৎ, অন্যটি ভাবজগৎ। মানুষের ক্ষেত্রেও এরকম দুটি ভাগ রয়েছে। এখানে একটি আকৃতিগত, অন্যটি নিরাকার। আকৃতিগত বলতে দেহ যা দৃশ্যমান, অর্থাৎ এটাই বস্তুগত। আর নিরাকার বা ভাবগত হচ্ছে তার আত্মা। দেহ এবং আত্মার সমন্বয়ে হচ্ছে জীবন। সেই সাথে মনকে বাদ দিলেও চলবে না। মন হচ্ছে দেহের পরিচালক। দেহ আছে, কিন্তু আত্মা নেই, তাকে জীবন বলা যাবে না। দেহ এবং আত্ম দুটোই আছে, কিন্তু মন নেই। মনের একটি প্রধান অংশ হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞান না থাকলে সে তো অজ্ঞান বা সেন্সলেস। এখানে জীবন বলতে আমরা কখনো প্রাণকে বুঝি। বলা হয়ে থাকে যে প্রাণটা এখন ওষ্ঠাগত। অর্থাৎ প্রণটা বের হয়ে যাচ্ছে। তার অর্থ আত্মাটা বের হয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রাণটাকে জীবন বলা যাবে না। দেহ, আত্মা এবং মন নিয়েই জীবন। দেহ থেকে আত্মা যখন বের হয়ে যায়, তখন আমরা বলি প্রাণ নেই। কাজেই আমরা বলতে পারি, প্রাণের যে ধারক সেই হচ্ছে প্রাণী। প্রয়োগের ক্ষেত্রে জীবন, প্রাণ এর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। জীবনকে আবার কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে আলোচনার ক্ষেত্রে। যেমন, শৈশব জীবন, কৈশোর জীবন, যৌবন, বৃদ্ধ জীবন, সামাজিক জীবন ইত্যাদি।

মানুষের জীবনের সাথে কোন কোন বিষয়গুলো সম্পৃক্ত তা দেখতে হবে। যদিও বলা হয়ে থাকে মানুষের মৌলিক চাহিদা পাঁচটি, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের মৌলিক চাহিদ হচ্ছে দুটি। একটি খাদ্য এবং অন্যটি জৈবিক। শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্ম, ইত্যাদি বিষয়গুলো হচ্ছে দ্বিতীয় স্তরের মৌলিক চাহিদা। বাঁচার জন্য অনেক জিনিসের প্রয়োজন। মূলত জীবন ও জীবনের প্রয়োজন সম্পর্কিত একটি চেতনা ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ একটি বোধের সৃষ্টি হয়। এই বোধগমতা ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, সাংগঠনিক ও জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত পরিব্যপ্ত হতে পারে।

জীবনের জন্য সব প্রয়োজনকে আমরা দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি প্রয়োজন জীবনের জন্য অপরিহার্য, যা না হলেই নয়। যে প্রয়োজনের সাথে জীবনের অস্তিত্বের প্রশ্নটি জড়িত। যেমন, খাদ্য, জৈবিক এবং জীবনকে সুস্থ রাখার জন্য ঔষধ ইত্যাদি। অন্যগুলো হচ্ছে শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থান। এরপর আসছে বিলাসদ্রব্য। বাড়ি, গাড়ীরও প্রয়োজন, যাদের অর্থ সম্পদ আছে। যে যেখানে বাস করুক না কেন, বস্তিতে অথবা দালানে, তার প্রয়োজনে যখন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পাওয়া না যায় তখন জীবন সম্পর্কে একটি বোধ সৃষ্টি হয়। সে সময় এর পেছনে আবেগ কাজ করে। এই আবেগ অনুভূতির ওপর অঘাত করে। আবেগর এই আঘাতের ফলে চিত্ত চাঞ্চল্য বেড়ে যায়। এটাকেই আমরা জীবনবোধ বলতে পারি। আমরা কখন জীবনকে উপলব্ধি করতে পারি? সুখের সংজ্ঞা অনুযায়ী মানুষ সুখের মধ্যে জীবনকে উপলব্ধি করতে পারে না। সুখ বলতে এখানে বলা হয়েছে, জৈবিক মিলনের মধ্যে যে উপলব্ধি। এই সুখ নিজের অস্তিত্বকে পর্যন্ত ভুলিয়ে রাখতে পারে। জীবনের উপলব্ধি আসে দুঃখের মধ্য দিয়ে। যেমন, আমি শুয়ে আছি, হঠাৎ দালানের একটি ইট খসে পড়লো আমার গায়ের ওপর, আমি তখন প্রচন্ড আঘাত পাবো। ঠিক তখনই আমি উপলব্ধি করবো আমার জীবন, আমার অস্তিত্বকে। ইট ঘসে পড়ার কারণে আমি ব্যথা পাবো। এটা শারীরিক ব্যাপার। কিন্তু এ ছাড়া মনোকষ্ট হতে পারে বিভিন্ন কারণে। কেউ মানসিকভাবে আঘাত দিয়েছে। এরকম আঘাতে অনেকে হার্টফেল করতে পারে এবং মারা যেতে পারে। এ সময়ও সে জীবনের অস্তিত্বকে অনুভব করে থাকে। এ জন্যই বলা হয়েছে জীবন মানেই দুঃখ। দুঃখ ছাড়া জীবনের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এই দুঃখের মাধ্যমে জীবনের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করাই হচ্ছে জীবনবোধ। আমরা জীবনবোধের সংজ্ঞা এভাবে দিতে পারি, ‘ দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, অর্থাৎ যার মাধ্যমে জীবনের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, সেই অনুভবকেই বলা যায় জীবনবোধ।’ এ কথা আগেও বলা হয়েছে যে, বস্তু তার নামে পরিচিত। বস্তুর কোনো সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ভাবের বিষয়ের ক্ষেত্রে শুধু নাম দিয়ে বিষয়টিকে বুঝা যাবে না। এ জন্য সংজ্ঞার প্রয়োজন। কিন্তু অনেক বিষয় আছে তার যথার্থ সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব হতে পারে। এবং অনেক বিষয় আছে যার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। জীবনবোধ সম্পর্কে যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, এটা পরিপূর্ণ বা সর্বজনগৃহীত সংজ্ঞা কিনা এটা আলোচকরাই বলতে পারবেন।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক