২৪ বিপ্লবের আঁতুড়ঘর
এইতো কয়দিন আগের কথা। বিপ্লবী নাহিদ ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনের পিচঢালা চত্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিচ্ছে, আর কোন বৈষম্য সহ্য করা হবে না। সকল ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। এই গ্রন্থাগারের সামনের কালো পিচঢালা চত্বরে দাঁড়িয়ে দেওয়া বিপ্লবীদের ডাকে পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল রংপুরের শহীদ আবু সাঈদ, রাজধানীর উত্তরার রাজপথে ‘পানি লাগবে কার? পানি লাগবে পানি বলে বার বার আওয়াজ তুলেছিল মীর মুগ্ধ।
Printed Edition
ইবরাহীম খলিল
এইতো কয়দিন আগের কথা। বিপ্লবী নাহিদ ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনের পিচঢালা চত্বরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিচ্ছে, আর কোন বৈষম্য সহ্য করা হবে না। সকল ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। এই গ্রন্থাগারের সামনের কালো পিচঢালা চত্বরে দাঁড়িয়ে দেওয়া বিপ্লবীদের ডাকে পুলিশের বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল রংপুরের শহীদ আবু সাঈদ, রাজধানীর উত্তরার রাজপথে ‘পানি লাগবে কার? পানি লাগবে পানি বলে বার বার আওয়াজ তুলেছিল মীর মুগ্ধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে এই বিপ্লবীদের ডাকেই রাজপথে একত্রিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, সরকারী-বেসরকারী অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্টেশনের কুলি-মুজুর, রাজপথের হকার-ফেরিওয়ালা-ফুটপাতের-দোকানদার, আদালতের উকিল-মোক্তার, গলির মোড়ের মুচি-তালুকদার, পেশাজীবী-অপেশাজীবী, রাজপথে খেটেখাওয়া মানুষ, প্রেমিক-প্রেমিকা, দুষ্ট-ভদ্র, ছোটলোক-বড়লোক, শিশু-বৃদ্ধ, আবাল-জনতা। দেশজুড়ে রব ওঠে, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। সেদিন অভিভাবক, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, প্রতিরক্ষাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। সেদিন সেনাবাহিনীর চাকরিরত সদস্যরাও ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকার করে।
টিনএজ ঊর্ধ্ব কতিপয় তরুণের ডাকেই ২০২৪ সালের ৩৬জুলাই ঢাকা প্রবেশের পথ দখলে নিয়ে নেয় জনতা। দখল করতে চায় গণভবন, আন্দোলনের স্রোতে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায় স্বৈরাচার। ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে পরিচিত ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয় বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক গণঅভ্যুত্থান যা ২০২৪ সালের ৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অগণিত প্রাণ বিসর্জন দেয়ার মধ্য দিয়ে বিগত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। দেশ হয় স্বাধীন। দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচার বিতাড়নের ক্ষেত্রে এই চত্বর যে অবদান রেখেছে, জাতি সেকথা মনে রাখবেও অনেকদিন। ইতিহাসের পাতাকে ঋদ্ধ করবে। যুগ যুগ ধরে অধ্যয়ন, গবেষণা কিংবা জ্ঞান-পিপাসুর অনুষঙ্গ হয়ে থাকবে তাবৎ দুনিয়ার মানুষের কাছে। দিনে-রাতে প্রকাশ্যে-গোপনে নীরবে-নিভৃতে এখান থেকে কত যে সিদ্ধান্ত হয়েছে; তা কেবল নিকষ-কালো পিচঢালা চত্বর-ই জানে। এই পথের সিদ্ধান্ত হিসাবহীন মানুষের জীবনে এসেছে সফলতা। বহু মাকে সস্তান হারা করেছে। সবশেষ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে। স্বৈরাচার বিদায় করেছে।
এখানকার ইতিহাস কেবল জানে যেটুকুর ব্যাপারে সংবাদকর্মী খোঁজ পেয়েছে কিংবা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনে সম্প্রচার হয়েছে। বাকী ইতিহাসটুকু বুকে চেপে ধরে রেখে দিয়েছে এই বোবা পিচঢালা চত্বর। এই চত্বর মাড়িয়ে যেমন দেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর জন্ম হয়েছে; তেমনি বহু বিপ্লবী সৃষ্টি করেছে। যা হয়তো কোনদিন কারো কলমের আঁচড়ে প্রকাশিত হবে, হয়তো হবে না। রাস্তার এই কালো বুক কুয়াশায় শিশিরে ভিজে কর্দমাক্ত হবে, কিংবা মুষলধারে হওয়া বৃষ্টিতে ধুলো ময়লাগুলো সরে যাবে। নীরবে-নিভৃতে বুকে ধারণ করা ইতিহাস শিশির কিংবা বৃষ্টি মুছে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে না।
এই তো গেল কয়েকদিন আগে ২০২৪ ইং সালের জুনের ৫ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন জুন মাসে ক্যাম্পাসের ভেতর থাকলেও, ঈদের ছুটির পর জুলাই মাসের ২ তারিখ চলে আসে শাহবাগে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এর পরের গল্পগুলো যে কোনো রূপকথাকেও হার মানায়।
আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের বিপ্লব এবং বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত এবং মিছিল শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে। ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ প্রভৃতি স্লোগানগুলো সবার আগে উচ্চারিত হয়েছে এই কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকেই। এখান থেকেই যৌক্তিক আন্দোলনের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। এখান থেকেই কোটা সংস্কারের দাবিতে গণপদযাত্রা নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদানের জন্য বিরাট গণপদযাত্রা নিয়ে বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা।
সেই বিপ্লবের রং লেগে আছে ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে। ক্যালেন্ডারের পাতায় ২০২৪ শেষ হয়ে নতুন বছর চলে এসেছে। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনও থেমে আছে জুলাই মাসে। যে জুলাই হয়তো কোনোদিন শেষ হবে না।
সরকারি চাকরির নিয়োগ ব্যবস্থায় কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভের মধ্যে ২০১৮ সালে সরকার কর্তৃক জারি করা সার্কুলারকে অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। ঘোষণার পরপরই, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে এবং বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের জন্য ৫৬% চাকরি সংরক্ষণ করার সুবিধা দেয়ার কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
সরকার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেও শিক্ষার্থীরা ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে অস্বীকার করে এবং কোটা বাতিলের নতুন নির্বাহী আদেশের দাবি জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে। তবে ঈদুল আজহা উদযাপনের কারণে বিক্ষোভ শান্ত হলেও বিরতির পর তা আবার শুরু হয়।
জুলাইজুড়ে আন্দোলন হয়। ৩ জুলাই শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বর থেকে একটি মিছিল বের করে এবং শাহবাগে বিক্ষোভ মিছিল করে নগরীর অন্যতম ব্যস্ত মোড়টি দেড় ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। এছাড়া, ছাত্ররা অন্যান্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। এই মিছিল থেকে কর্মসূচি শুরু হয়। শেষ হয় স্বৈরাচার হাসিনার পতন দিয়ে।
৫ জুলাই সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রচারণা জোরদার করার জন্য, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ, সমাবেশ এবং সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে এবং ৭ জুলাই (রোববার) থেকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে দিনের কর্মসূচি শেষ করে। তারা এর পাশাপাশি ৬ জুলাই (শনিবার) প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবস্থান, বিক্ষোভ সমাবেশ ও রাস্তা অবরোধ করে। ৬ জুলাই বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির প্রথম দিনে রাজধানীর শাহবাগ, নীলক্ষেত, হেয়ার রোড, মিন্টো রোড, সায়েন্স ল্যাব, বাংলামোটর মোড় এবং ঢাকা-আরিচা ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ প্রধান প্রধান সড়কগুলো কয়েক ঘন্টার জন্য অবরোধ করে রাখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব মোড়ে, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত মোড়ে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ করে। দিনের কর্মসূচি শেষে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক কোটা বাতিলের ‘এক দফা’ দাবি নিয়ে অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
৭ জুলাই বাংলা অবরোধে শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা মহানগরী। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সারাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। ৮ জুলাই ঢাকার ১১টি স্থানে অবরোধ কর্মসূচি, নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, ছয়টি মহাসড়কসহ তিনটি স্পটে রেলপথ অবরোধ করে।
৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের সড়ক ও রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ভোর থেকে সন্ধ্যা অবরোধ ঘোষণা করে। এদিকে, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল করেন দুই শিক্ষার্থী। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের জন্য কোটার ওপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। সব গ্রেডে সরকারি নিয়োগে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।
১১ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটা আন্দোলনকারীরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে তাদের পেশীশক্তি ব্যবহার করছে, যা অযৌক্তিক ও বেআইনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনকারীরা ‘সীমা অতিক্রম করছে’। ১২ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে শিক্ষার্থীরা শাহবাগে জড়ো হয়ে এলাকা অবরোধ করে। এদিকে, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করতে গেলে ছাত্রলীগের একটি দল আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ভিডিও ধারণকারী এক শিক্ষার্থীকে একটি হলে নিয়ে গিয়ে মারধর করে ছাত্রলীগের সদস্যরা।
১৩ জুলাই সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকলেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল শেষে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। ১৪ জুলাই শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে অবস্থান বিক্ষোভ ও অবরোধসহ মিছিল বের করে এবং পরে তাদের দাবি জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি পেশ করে। সন্ধ্যায় গণভবনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকারের সন্তান বলে উল্লেখ করে বিতর্কিত মন্তব্য করেন, যা আন্দোলনকে আরও উসকে দেয়।
শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে পরোক্ষভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে কটাক্ষ করলে ১৪ জুলাই রাতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। রাতেই মিছিল বের হয় ক্যাম্পাসে। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগানে মুখরিত হয় পুরো ক্যাম্পাস। ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেন, দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ‘উচিত জবাব’ দেবে। ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালায় এবং নির্বিচারে তাদের পিটিয়ে অন্তত ৩০০ বিক্ষোভকারীকে আহত করে। হেলমেট পরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে জোর করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রড ও চাইনিজ কুড়াল নিয়ে প্রবেশ করে এবং পরে ঢামেক হাসপাতালের ভেতরে ও বাইরে আহত বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়।
১৬ জুলাই সারাদেশে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক বিক্ষোভ করে। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের লোকজন হামলা চালায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন নিহত হয়।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ফুটেজ ও ছবি এদিন ভাইরাল হওয়ায় রাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পাল্টা লড়াই করে ছাত্রলীগকে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেয়। ১৭ জুলাই সকালের দিকে আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তাড়িয়ে দেয় এবং ক্যাম্পাসকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করে। ছাত্ররা নিহতদের জন্য ‘গায়েবানা জানাজা’ আদায় করার চেষ্টা করে, কিন্তু পুলিশ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সমাবেশে হামলা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস বন্ধ করে ছাত্রদের ছাত্রাবাস খালি করার নির্দেশ দেয়। ১৮ জুলাই ‘সম্পূর্ণ শাটডাউন’ কর্মসূচির প্রেক্ষিতে ঢাকায় ও অন্যান্য ৪৭টি জেলায় ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী পরিবহন বন্ধ কার্যকর করার জন্য অন্যান্য বিভিন্ন গ্রুপের সাথে যোগ দেয়। পুলিশ ও অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বুলেট, শটগানের গুলি ও রাবার বুলেট দিয়ে তাদের উপর গুলি চালালে কমপক্ষে ২৯ জন শহীদ হওয়ার নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়। ১৯ জুলাই শেখ হাসিনা সরকার মধ্যরাতে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে এবং দিনব্যাপী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৬ জন নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। নরসিংদীর কারাগার, মেট্রোরেল স্টেশন ও বিআরটিএ অফিসসহ আরও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বাধা দেয়ার প্রয়াসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ জনসমাগম ও মিছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস দেশব্যাপী বন্ধ রাখা হয়। তবে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন সহিংসতা, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও মৃত্যুতে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকা।
২০ জুলাই সেনা মোতায়েনের মধ্যে কারফিউর প্রথম দিনে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়। যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুরে ছিল সংঘর্ষের মূল পয়েন্ট। মোহাম্মদপুরেও সংঘর্ষ হয়। কারফিউর প্রথম দিনেই অন্তত ২৬ জন নিহত হয়। সরকার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয় এবং দুই দিনের ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করে।
২১শে জুলাই সুপ্রিম কোর্ট কোটা মামলায় রায় প্রদান করে, সিভিল সার্ভিসের চাকরির বেশিরভাগ কোটা বিলুপ্ত করে এবং সিভিল সার্ভিসে ৯৩% শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে সাধারণ আবেদনকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য এক শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়।
এদিন, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ৫৬ জন সমন্বয়কের পক্ষ থেকে সংবাদকর্মীদের কাছে একটি যৌথ বিবৃতি পাঠানো হয় যাতে শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ আরও জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ৩০০ জনেরও বেশি ছাত্র ও মানুষ নিহত হয়েছে। শুধুমাত্র আদালতের আদেশ ব্যবহার করে সরকার হত্যার দায় এড়াতে পারে না।
২২শে জুলাই আগের দিনের সংঘর্ষে আহত অন্তত ছয়জন মারা যায়। ২৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকার কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সার্কুলার জারি করলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের চার সংগঠক তা প্রত্যাখ্যান করেন। ২৪ জুলাই আন্তঃজেলা বাস ও লঞ্চ চলাচল আংশিকভাবে চালু রাখে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা পুনরায় চালু করা হয়। ২৬ জুলাই পুলিশের গোয়েন্দা শাখা তিন সংগঠককে তুলে নেয়। সারা দেশে ‘ব্লক রেইড’ শুরু।
২৭ জুলাই বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ব্লক রেইড, বেশিরভাগ ছাত্র, অব্যাহত রয়েছে। ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা আরও দুই সমন্বয়কারী সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে হেফাজতে নেয়া হয়।
জুলাই ২৮ কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নেয় ডিবি। পরে রাত ৯টার দিকে ডিবি কার্যালয়ে রেকর্ড করা একটি ভিডিও গণমাধ্যমে পাঠানো হয় যেখানে আগে হেফাজতে নেওয়া ছয় সমন্বয়কারী সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে একটি লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান। তবে, তিন সমন্বয়কারী- মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের এবং আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেছেন যে, ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়কের ভিডিও বার্তাটি বিক্ষোভকারীদের আসল অবস্থান নয়। সমন্বয়কারীদের ডিবি কার্যালয়ে জিম্মি করা হয়েছিল এবং বার্তা পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল।
২৯ জুলাই সরকার ছাত্র নেতাদের মুক্তির আল্টিমেটাম উপেক্ষা করার পরে ছাত্র এবং জনগণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় আকারের বিক্ষোভ পুনরায় শুরু করে। ৩০ জুলাই ‘শোক দিবস’ পালন করে, কিন্তু ছাত্ররা দিনটিকে প্রত্যাখ্যান করে। ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকরা তাদের প্রত্যাখ্যান দেখানোর জন্য তাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল লাল করে দেয়। ৩১ জুলাই হত্যা, গণগ্রেফতার, হামলা, মামলা, জোরপূর্বক গুম এবং ছাত্র ও নাগরিকদের হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে ছাত্ররা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামে প্রতিবাদ করে।
৩২ জুলাই সরকার জামায়াতে ইসলামী দল এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের পাশাপাশি এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে নিষিদ্ধ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ৩৩ জুলাই বিক্ষোভকারীরা হত্যার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে; হাজার হাজার মানুষ বিচারের জন্য মিছিলে যোগ দেয়। বিক্ষোভকারীরা দেশব্যাপী বিক্ষোভ এবং ৪ আগস্ট থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় সংগঠক বলেন, ডিবি অফিস থেকে প্রত্যাহারের বিবৃতি স্বেচ্ছায় দেননি।
৩৪ জুলাই কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেন যে তাদের সরকারের সাথে আলোচনার কোন পরিকল্পনা নেই এবং হাসিনার পদত্যাগ এবং ‘সবার কাছে গ্রহণযোগ্য’ একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের দাবিতে লংমার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৩৫ জুলাই ঢাকা এবং দেশের অন্তত ২১টি জেলায় ব্যাপক সংঘর্ষের ফলে ১৪ পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ৯১ জন নিহত হওয়ার সাথে দিনটি বিক্ষোভের সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে ওঠে। নতুন করে বিক্ষোভের ফলে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে।
৩৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ কারফিউ অমান্য করে রাজধানীর কেন্দ্রে একত্রিত হয়। হাসিনার পতনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে আগ্রাসন প্রদর্শন করে। ‘মার্চ টু ঢাকা’ ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও দেশবাসী রাজধানী অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। দুপুর নাগাদ ভিড় করে হাসিনার সরকারি বাসভবনে। বিকেলে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছে তার পদত্যাগপত্র হস্তান্তর করেন হাসিনা। এরপর হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক বিমানে করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়।
লেখক: সাংবাদিক