হালাল ব্যবসা জান্নাতের পথ
ইসলামে ব্যবসা হচ্ছে উপার্জনের অন্যতম পবিত্র এক মাধ্যম। শুধু পবিত্রই নয়, নবীজি সা. বলেন, সর্বোত্তম। এবিষয়ে প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তা-ই সর্বোত্তম। মিশকাত, ২৭৮৩।
Printed Edition
![Sangram-Default Image](https://static.dailysangram.com/images/Sangram-Default_Image_hHflr46.original.jpg)
অয়েজুল হক
ইসলামে ব্যবসা হচ্ছে উপার্জনের অন্যতম পবিত্র এক মাধ্যম। শুধু পবিত্রই নয়, নবীজি সা. বলেন, সর্বোত্তম। এবিষয়ে প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তা-ই সর্বোত্তম। মিশকাত, ২৭৮৩। নবীজি (সা.) নিজেও ব্যবসা করেছেন। চিরন্তন শান্তি, মানব জীবনের সকল অধ্যায়ের মুক্তির বাণী নিয়ে যে কুরআন এসেছে আলোকবর্তিকা হয়ে। মহান রব মানুষের সম্পদ লুন্ঠন, জোরজবরদস্তি করে দখল ও ভক্ষণের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ব্যবসার ব্যাপারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সুরা নিসার ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ।
মাহান রবের এ বানী থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ হস্তগত করা, সে যে কোন উপায়েই হোক- হারাম। পাশাপাশি ইসলামী বিধান মেনে যে ব্যবসা পরিচালিত হয় তা হালাল। এটা ইবাদত। কেন ইবাদত? আল্লাহ তায়ালা সুরা জুমআর ১০ নম্বর আয়াতে বলে দিলেন, ‘যখন ছালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর। আল্লাহতায়ালা ও প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যে কাজ করতে বলেছেন সব ইবাদত। সকল মুসলমান এ কথা বিশ্বাস করেন-হারামে শাস্তি, হালালে শান্তি। ব্যবসা ঠিক ততক্ষণ হালাল উপার্জনের মাধ্যম থাকে, যতোক্ষণ মানুষ ব্যবসার ভেতর বাটপারি, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি না ঢোকায়। ব্যবসা যদি পরিচ্ছন্ন হয় তো তাদের জন্য পবিত্র জান্নাতের সুসংবাদ। নবীজি (সা.) বলেন, সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, ছিদ্দীক্ব এবং শহীদগণের সাথে থাকবে। তিরমিযী, ১২০৯; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১৭৮২। একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? ভালো কাজের প্রাপ্তি যেমন বড় বিপরীতে শাস্তিও তেমন বড়। রাসূলুলাহ (সা:) বললেন: কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসাবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত। তিরমিযী,১২১০; ইবনে মাজাহ, ২১৪৬।
কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দামে পণ্য বিক্রয় সম্পর্কে নবীজি (সা.)বলেন যে মজুদদারী করে সে পাপী। মুসলিম, ৪২০৬। আমাদের ব্যবসায়ীদের ভেতর এ কাজটি আমরা খুব বেশি দেখতে পাই। কখনো কোন পণ্যের সংকট তৈরি করা হচ্ছে। কখনো চাহিদা অনুযায়ী কয়েক গুন বেশি দামে মাল বিক্রি করা হচ্ছে। সেটা হোক ওষুধপত্র কিংবা অন্য কিছু। পেঁয়াজ, মরিচ, চাল, তেল, লবণ এমন কিছু নেই যে পণ্যটার চাহিদা দেখা মাত্র ব্যবসায়ীরা হু হু করে দাম বাড়াচ্ছে না। সারা বছর যে জিনিস সস্তায় পাওয়া যায় সংকটে তা পাওয়া যায় না। চিকিৎসা সেবার নামে মানুষের সাথে এই ব্যবসায়ী চক্র যে ধোঁকাবাজি করেছে তা আমাদের বিস্মিত করে। একদিকে মহামারি করোনা অন্যদিকে বন্যা এর ভেতর দিয়েও মানুষের পশুত্বের যেন শেষ নেই। বিশিষ্ট সাহাবী ওয়াসিলা ইবনুল আকওয়া (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের কাছে আসতেন এবং বলতেন: হে বণিক দল! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে। ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১৭৯৩।
কেউ কেউ এমন কথাও বলেন, মিথ্যা না বললে ব্যবসা হয়? নাউজুবিল্লাহ। আরে ভাই আপনি সুখের জন্যই তো সবকিছু করছেন। সুখের মালিক কে? জীবন কতদিনের? টাকা থাকলেই কী সুখী হওয়া যায়? বিবেকের কাছে প্রশ্নগুলো। আপন বিবেকের কাছে। টাকা আছে সুখ নেই। পেরেশানি আর দুশ্চিন্তা। টাকায় বরকত নেই; একপথে আসে অন্যপথে বেরিয়ে যায়। আবু কাতাদা (রা.) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ব্যবসার মধ্যে অধিক কসম খাওয়া হতে বিরত থাক। এর দ্বারা মাল বেশি বিক্রি হয়, কিন্তু বরকত বিনষ্ট হয়ে যায়। মুসলিম, ১৬০৭ মিশকাত,২৭৯৩।
কসম তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। সত্যের বিন্দুমাত্র বালাই নেই তার ওপর কসম চলছে। কসম করে বলা হয়, বিশ্বাস করেন আমার লস হয়েছে। এক টাকাও লাভ হয়নি। যাদের কাছে কসম করে বলা, তারা কী বোঝে না এসব ভাঁওতাবাজি, মিথ্যা? লস করে বিক্রি করলেন! ভেজাল নয় খাটি পণ্য নিশ্চয়তা দিলেন! বড়ই হাস্যকর। আসলে আমরা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এতটা অভ্যস্ত হয়েছি যে সংকটময় মুহূর্তেও আমরা বড়ই চাতুরতার সাথে ভেজাল, মিথ্যা আর প্রতারণার মাধ্যমে সহজ সরল মানুষের পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছি। প্রতারক ব্যবসায়ী ভাবছেন না, যার থেকে নিতান্ত দুর্বলতার সুযোগে ধোঁকাবাজির মাধ্যমে টাকা নিচ্ছেন তিনি পারিবারিকভাবে কতটা অসহায়। আপনি এ খবর রাখেন না আথবা রাখলেও তা আপনার অন্তরে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে না। আদালত দিবসে অসহায় মানুষগুলোর সাথে আপনার এ ব্যবসায়িক প্রতারণা জাহান্নামের কারণ হতে পারে। বুখারী ও মুসলিম শরিফের হাদিস, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: তোমরা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার লক্ষ্যে ক্রেতার মূল্যের উপর মূল্য বৃদ্ধি করে ক্রেতাকে ধোঁকা দিয়ো না।
এমনটা নয় যে প্রয়োজন বা দুর্ভোগের সময় মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য একদিনে ছয় গুন, দশগুণ বেশি দামে বিক্রি না করলে তার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। বরং সততার সাথে ব্যবসা করলে, দুনিয়াতেই আল্লাহ তায়ালা তার ব্যবসায় বরকত দান করবেন। রবের কাছেই একমাত্র কল্যাণ, রিজিক ও বরকতের ভান্ডার। শুধু দুনিয়া নয়, যে জন্য পৃথিবীতে আসা; সূরা মুলকের দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেন, আল্লাযি খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লিয়াবলুয়াকুম আইয়ুকুম আহসানু আমালা।
অর্থঃ আমি মৃত্যু এবং জীবনকে সৃষ্টি করেছি। যাতে দেখতে পারি, তোমাদের মধ্যে কে সর্বাধিক ভালো ও সুন্দর আমল নিয়ে আসতে পারে।
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহতায়ালা হায়াত এবং মউত সৃষ্টি করতেন না।
করেছেন এজন্যই যে, কে ভালো কাজ করে আর কে মন্দ কাজ করে সেটা পরীক্ষার জন্য। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় এবং নিজের খাহেশাতে নফসকে দমন করে তার ঠিকানা জান্নাত।
অসহায়ের বিপদে বাহ্যিক দৃষ্টিতে নিজের আখের গোছানো মানুষ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে না। তারাই আল্লাহ তায়ালার সামনে দাঁড়াতে ভয় পায় যারা নিজের নফছকে দমন করে। লোভ, লালসা ত্যাগ করে, বিপদগ্রস্ত মানুষের সাথে প্রতারণা করে না। এই ত্যাগটুকুই তার আখেরাতের অনন্তকালের জীবনে একটা সুন্দর জান্নতের কারণ হতে পারে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বুঝ দান করুন। ব্যবসা হোক আমাদের জান্নাতের পাথেয়।
লেখক: গল্পকার, ঔপন্যাসিক