গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠন পরিকল্পনা
পতিত সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করছে। ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের প্রকাশের পর বিগত পনের বছরের অর্থনৈতিক লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র আরো স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। যেখানে প্রায় ২৮টি পদ্ধতিতে দেশ থেকে মোট ২৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
Printed Edition
![saddafs](https://static.dailysangram.com/images/saddafs.original.jpg)
ড. মুহাম্মদ মোস্তফা হোসাইন (শাহীন)
ড. এম. কবির হাসান
পতিত সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করছে। ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের প্রকাশের পর বিগত পনের বছরের অর্থনৈতিক লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র আরো স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। যেখানে প্রায় ২৮টি পদ্ধতিতে দেশ থেকে মোট ২৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং, অবকাঠামো, জ্বালানি এবং তথ্য প্রযুক্তির খাত দুর্নীতির শীর্ষস্থান দখল করে। শ্বেতপত্রে আরো উল্লেখ করা হয় যে, বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন আকারের প্রকল্পের খরচ গড়ে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকল্পগুলো শেষ করতে গড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগেছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার (১.৬১ থেকে ২.৮০ লাখ কোটি টাকা) রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুস এবং বাজেট বাড়ানোর মতো বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে। এতে বলা হয় রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীর করেছে। বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত। অন্যদিকে শুধু অভিবাসন খাতের মাধ্যমেই পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় তের লাখ কোটি টাকা, যা বর্তমান মেট্রোরেল নির্মাণ খরচের প্রায় চারগুন। এসব প্রধানতম অনিয়মের পাশাপাশি আরো নানামুখী অনিয়মের ফলে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। যা পুরুদ্ধার করা যেকোনো সরকারের জন্যই দুরূহ ও চ্যালেঞ্জিং।
তবে ধসে পড়া এই অর্থনীতি পুনবিনির্মাণে সম্ভাব্য সবধরনের অর্থনৈতিক পদক্ষেপকে কাজে লাগানো সময়ের অনিবার্য দাবি। ইসলামী অর্থনীতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেহেতু মূলধারার অর্থনীতি বিনির্মাণে পরীক্ষিত মাধ্যম, সেহেতু ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশেও এর যথাযথ সংযোজন এবং সে আলোকে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা গেলে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। সে আলোকে এই পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে ।
ইসলামী অর্থনীতির আলোকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচনে সম্ভাব্য নীতিমালা
ব্যক্তিগত পদক্ষেপ নীতিমালা (Individual Initiative Policy, IIP) : শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-সবল প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে ইসলাম নিজস্ব উদ্যোগে জীবিকা অন্বেষণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলেও রাসূলুল্লাহ সা.সহ অন্য নবী-রাসূলদের মেষ চরানোসহ কৃষি, বাণিজ্য ও অন্যান্য কর্মসম্পৃক্ততার ঘটনাসমূহ থেকেও নিজস্ব জীবিকা অন্বেষণের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত ও দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলামী অর্থনীতির প্রাথমিক নীতি হলো ‘ব্যক্তিগত পদক্ষেপ নীতিমালা’। এ নীতিমালা মূলত বিগত সময়ে বিভিন্ন বৈষম্য কিংবা অন্যান্য আনুষঙ্গিক অসুবিধার কারণে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়াদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার জন্য সম্ভাব্য যেকোনো অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও সুযোগ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে।
সামাজিক পদক্ষেপ নীতিমালা (Societal Initiative Policy, SIP): কখনো কখনো প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ সংকটের কারণে ব্যক্তি এককভাবে তার জীবিকা নির্বাহ অসম্ভব হয়ে উঠে, এ ক্ষেত্রে সমাজের বিত্তশালী অংশ কর্তৃক সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্ভাব্য যেকোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সামাজিক দায়িত্ববোধের মধ্যে পড়ে। ভিক্ষুক ব্যক্তিকে রাসূল সা. কর্তৃক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ঘটনা থেকে এ নীতির শরঈ প্রমাণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে রাসূল সা.-কে খাদিজা রা. কর্তৃক নিজের ব্যবসার অংশীদার নিয়োগ দেওয়া কিংবা ব্যবসা দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়াও মূলত ‘সামাজিক পদক্ষেপ নীতিমালা’র মধ্যেই পড়ে। সুতরাং এই নীতির অংশ হিসেবে দরিদ্র কৃষকদের মাঝে সরকারি কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন চাষযোগ্য অলস জমি শর্তসাপেক্ষে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে, বাণিজ্যিক কিংবা সহযোগিতার ভিত্তিতে দান এবং খাত ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অন্যান্য অলস সম্পদও উপযুক্ত ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যেতে পারে। ভিক্ষাবৃত্তি নিবৃতকরণ কিংবা নানাবিধ কারণে খাদ্যের যোগান দিতে অক্ষমদের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় এ নীতিমালার অধীনে মসজিদ কিংবা সরকারি গুদামঘর ভিত্তিক বিনামূল্যে ব্যাপক ‘বয়স্ক রেশন’ এবং ‘জরুরি রেশন বিতরণ প্রকল্প’ পরিচালনা করা যেতে পারে। ‘সাসপেনশান মিল’ বা অতিরিক্ত খাবার প্রকল্প ও এই ক্ষেত্রে নিয়ামক সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। একজন ক্রেতা তার প্রয়োজনাতিরিক্তি কিছু পণ্য ক্রয় করে সেগুলো দোকানির কাছে রেখে আসবে এই শর্তে যে, দোকানি এই পণ্যগুলো ‘চাহিদা’-ভিত্তিক নীতিতে অসহায় মানুষদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করবে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রভাব মোকাবেলায় কাঁচা-বাজার, রেস্টুরেন্ট, যাতায়াতসহ সব ক্ষেত্রেই এই নীতির চর্চা অর্থনৈতিক সংকট দূরীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
তাআউন বা সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নীতিমালা ( (Cooperational Initiatiave Policy, CIP) : বিগত বছরসমূহে বিভিন্ন কারণে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে কর্মসংস্থান হারানো কিংবা স্থায়ী বেকার জীবনযাপন করছে, তাদের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সরকার এবং সমাজের বিত্তশালীরা তাদেরকে পুনর্বাসনের ভিত্তিতে কর্মসংস্থান ও স্বাভাবিক জীবন নির্বাহের পর্যাপ্ত মৌলিক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিবে। এ ক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশনার আলোকে পারস্পরিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দ্বি-পাক্ষিক ও বিনিময়চুক্তির আলোকে সম্পদশালী দেশ কিংবা অঞ্চলসমূহের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে মানবসম্পদ উন্নয়নের অংশ হিসেবে কর্মসংস্থানের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়। মদীনায় মুহাজিরদের প্রতি আনসারদের ঐতিহাসিক সহযোগিতা ও ত্যাগকে ‘সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নীতিমালা’র ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
বন্ধুত্বপরায়ণ পদক্ষেপ নীতিমালা (Friendly Ini-tiative Policy, FIP) :: সমাজের ভাগ্যাহত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদেরকে অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ দিতে এটি খুবই কার্যকরী পদক্ষেপ। মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, বিধবা, ইয়াতিম, কাজ করতে অক্ষম বয়স্ক পুরুষ বা মহিলা অথবা সাম্প্রতিককালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষদের এই নীতির অধীনে পুনর্বাসনের আওতায় নিয়ে আসা। তাদেরকে একটি সুখময় স্বাভাবিক জীবন গড়ে দেওয়ার অংশ হিসেবে আশপাশের দানশীল ব্যক্তিবর্গ, রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিবেশী এবং নিকটাত্মীয়দের উপর এর দায়িত্ব বর্তাবে।
প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নীতিমালা (Institutional Initiative Policy, InIP) : এ নীতিমালার অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, সার্বজনীন জীবিকা নিশ্চিতকরণ এবং যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে :
১. জরুরি দুর্যোগ মোকাবেলা তহবিল (Emergency Crisis Response Fund, ECRF) সাম্প্রতিককালীন বন্যার মতো জরুরি দুর্যোগ মোকাবেলায় যাকাত ও নগদ আওক্বাফের সমন্বয়ে গঠিত একটি নিয়মিত তহবিলের মাধ্যমে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে দেশব্যাপী বিনামূল্যে খাবার-ব্যাংক স্থাপন, কোল্ড-স্টোরেজ ও মাল-গুদাম তৈরিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে স্থায়ীভাবেও পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে এই তহবিল থেকে উপযুক্তদের মধ্যে খাবার বিতরণ ও প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ প্রদান, পাবলিক ইউটিলিটি যেমন, পানি, বিদ্যুৎ ও গণপরিবহনের জ্বালানি ব্যয়ভার বহন (সাবসিডাইজ) করা যেতে পারে। পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে এই তহবিল থেকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে দেশব্যাপী অবৈতনিক বহুমুখী শিক্ষা সেবা, গবেষণা প্রকল্পসহ শিক্ষা উন্নয়নে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। কৃষি অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষকদেরকে এই তহবিল থেকে বিনামূল্যে সার, বীজ, জমি চাষের ট্রাক্টর, কৃষিদক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ, অন্যান্য হালকা কৃষি সরঞ্জামাদি এবং টেকসই কৃষি ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য উন্নততর কৃষি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। শর্তসাপেক্ষে অন্যান্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নে এ খাত সুদমুক্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
২. ‘সম্মিলিত ইসলামিক কম্যুনিটি ব্যাংক (Combined Islamic Community Bank, CICB): যেকোনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ‘সম্মিলিত ইসলামিক কম্যুনিটি ব্যাংক’-এর ধারণা ব্যপক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে। ইসলামী শরীয়ার সবগুলো সামাজিক তহবিল যেমন, যাকাত, আওক্বাফ, করজে হাসানা, এককালীন দান, হেবা ও সামাজিক জবাবদিহিমূলক বাণিজ্যিক তহবিল (সিএসআর)-সহ অন্যান্য তহবিল এমন ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে যেকোনো দেশ সুদভিত্তিক ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি, অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও বাজেট ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
৩. সামাজিক শিল্প (Social Industries, SI) : বেকারত্ব দূরীকরণে সামাজিক শিল্প ব্যাপক আশার আলো দেখাতে পারে। যাকাত ও আওক্বাফ তহবিলের সমন্বয়ে ফিকহুল আওলাউইয়্যাত (অগ্রাধিকার ব্যবস্থাপনা) এবং ফিকহুল ওয়াকে’ (পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা)-এর আলোকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অতিব প্রয়োজনীয়, এমন পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে এ শিল্প অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি বেকারত্ব দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে ।
৪. সাময়িক কর্মসংস্থান কর্মসূচি (Temporary Public Work Program, TPWP) ফিকহুল ওয়াকে’র (পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা) আলোকে, ‘সাময়িক কর্মসংস্থান কর্মসূচি’ একটি অনুকরণীয় পদক্ষেপ হতে পারে। প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের অভাবে যারা নানাবিধ মানসিক ও আর্থিক দুঃশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে, তাদের জন্য এ প্রকল্পটি হতে পারে নতুন আশাসঞ্চারী। এ প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা অনুযায়ী খণ্ডকালীন কর্মসৃষ্টি করে বেকারত্ব দূরীকরণে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।
৫. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব তহবিল (Pri-vate-Public Partnership Fund, PPPF): বিশেষায়িত ব্যবস্থাপনার (A special purpose vehicle, SPV) অধীনে রাষ্ট্রীয় তহবিল যোগানে এটি একটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অংশীদারত্ব কাঠামোর উপর ভিত্তি করে গৃহীত এই তহবিলে দেশের বড় বড় সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও, অনুদান ও ত্রাণসংস্থা মূল দাতার ভূমিকা পালন করবে। এই তহবিল দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতাল, কম্যুনিটি ক্লিনিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, কৃষি ও স্বাস্থ্যসহ জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক গবেষণা কাজ পরিচালনা করাসহ নানাবিধ খাতে এই তহবিল থেকে অর্থায়ন করা যেতে পারে ।
৬. ব্যাংকিং বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা : যেকোনো আর্থিক দুর্দশা মোকাবেলা ও ব্যাপক অর্থনীতি বিনির্মাণে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইনান্স খাতের ব্যাপক ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির (সিএসআর) পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ও বিস্তৃত পরিসরে কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দেশের মূল ধারার অর্থনীতিতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশেই প্রমাণিত। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশব্যাপী তাদের শাখাসমূহ ও জনবল সংযুক্তির মাধ্যমে প্রান্তিক জনপদে অর্থনৈতিক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে অর্থ ব্যবস্থাপনার কলাকৌশলসহ অন্যান্য সেবা ও সচেতনামূলক সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক সুদবিহীন সুকুক’ অবমুক্ত করে রাষ্ট্রের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ আহরণ সহজ হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। ব্যক্তি, সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই এ সুকুকের মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতির ‘তাআউন’ কাঠামোর আলোকে রাষ্ট্রকে সুদমুক্ত অর্থ আহরণে সহযোগিতার নিমিত্তে ব্যক্তি, আর্থিক, বাণিজ্যিক ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সুকুক ক্রয়ে এগিয়ে আসতে পারে।
৭. ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা : প্রান্তিক পর্যায়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের শিল্প উদ্যোগকে (এসএমই) এগিয়ে নেয়ার লক্ষে সুদবিহিন নানাবিধ বিনিয়োগ স্কিম ও ‘বিস্তৃত করজে হাসানা প্রকল্প’ (Comprehensive Qard al Hasanah Scheme, CQHS) নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রান্তিক জনপদে দারিদ্রের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের মাঝে প্রকল্পের অধীনে রিকশা, অটোরিকশা, ছোট পরিসরের মৎস্য, দুগ্ধ ও পোল্ট্রি খামারের প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামোগত সহযোগিতা, সেলাই মেশিন ও হস্ত শিল্প প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ কর্মসংস্থানমূলক কাজে এই প্রকল্প থেকে অর্থায়ন করা যেতে পারে।
৮. ইসলামিক বীমা ও তাকাফুল নীতি : উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি নিম্নবিত্তদের অবস্থাভেদে বিভিন্ন বীমানীতির অধীনে নিয়ে আসা সময়ের দাবি। বায়ু, খাদ্যদূষণ ও প্রান্তিক জনপদে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ইসলামী বীমানীতি নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্যও বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প, নির্মাণ খাত, রেস্টুরেন্ট, গণপরিবহন শ্রমিক, স্বাস্থ্যকর্মী, বস্তিতে বসবাসকারী মানুষদের জন্য সম্ভব হলে তায়াউন ও বন্ধুত্বপরায়ণ নীতিমালার আলোকে নামমাত্র মূল্যে জরুরি বীমানীতি (পলিসি) প্রণয়ন করা যেতে পারে।
৯. মধ্যমপন্থী জীবনযাপন নীতি (Cost-effective Livelihood Policy) : জীবনযাত্রার এ সচেতনাবোধ যেকোনো অর্থনৈতিক ধকল থেকে মানুষদেরকে পরিত্রাণ দিতে পারে। ইসলাম সাদাসিধে মধ্যমপন্থী জীবনযাপনকে বিভিন্ন আঙ্গিকে উৎসাহিত করে থাকে। অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ইউসুফ আ.-এর গৃহীত নীতি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় ও আবেগের বশবর্তী কিংবা প্রভাবশালীদেরকে অবৈধ সুবিধা দেয়ার জন্য ঋণ গ্রহণ প্রবণতা বন্ধ করে দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও অতিরিক্তি ভোগবান্ধব জীবনযাপন থেকে বিরত থাকার মাধ্যমেই মধ্যমপন্থী জীবনে অভ্যস্ত হওয়া সহজ হতে পারে। তার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের সরকারি ও বেসরকারি প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও সামাজিক গণমাধ্যমের সহযোগিতায় দেশব্যাপী স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে ‘জরুরি ও প্রয়োজননির্ভর জীবনযাপন’কে মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে পরিচিত করা দরকার। রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যেও এই নীতির ব্যাপক অনুশীলন অতীব প্রয়োজনীয়। এটি যেকোনো অর্থনৈতিক বিপদ মোকাবেলায় সহায়ক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম সৌন্দর্য ও ইতিবাচক দিক হলো এটি ব্যক্তিগত (মাইক্রো) ও সামষ্টিক (মেক্রো) প্রয়োজনকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সবার উপযোগী সমাধান উপস্থাপন করে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় উল্লেখিত চালিকা শক্তিসমূহ আলাদা হলেও প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রত্যেকটিই স্বাতন্ত্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী অর্থনীতিকে প্রাসঙ্গিক করার ক্ষেত্রে একটি অন্যটির পরিপূরক। ইসলামিক অর্থনৈতিক কাঠামোর আলোকে উপযুক্ত চালিকা শক্তিসমূহ রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধান ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশসমূহ অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে উন্নত দেশের কাতারে যাওয়ার পথ উন্মোচিত হবে বলে আশা করা যায়। পূর্ববর্তী ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ মূলত এসব অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অর্থের জোগান দিত, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটেও কোন অংশেই অপ্রাসঙ্গিক নয়।
লেখক : ড. মুহাম্মদ মোস্তফা হোসাইন (শাহীন),
পিএইচডি, ইউনিভার্সিটি অব মালায়া, মালয়েশিয়া,
এডজান্ট ফ্যাকাল্টি ও শরীয়া কন্সালটেন্ট ।
লেখক : ড. এম. কবির হাসান,
আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিন্স, যুক্তরাষ্ট্র।