DailySangram-Logo

নারী বিপ্লবীর স্মৃতিকথা

জুলাই বিপ্লবের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বর্তমানে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নির্বাহী সদস্য সিনথিয়া জাহীন আয়শা। দৈনিক সংগ্রামের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংখ্যায় তিনি বলেছেন, আন্দোলনকালীন সময়ের স্মৃতিকথা।

Printed Edition
fdgdfgf

ভিসি চত্বরে হামলা : আমরা যেটা দেখেছি ২৪ জুলাই বিপ্লবের ঘটনা যা ইতিমধ্যে প্রায় ছয়মাস হতে চললো। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় আমি ও আমার সাথে যারা সহযোদ্ধা ছিল তাদের কাছে স্মৃতিচারণ করতে গেলে মনে হয়, ছয়দিন বা ছয় সপ্তাহ আগের ঘটনা। স্মৃতিগুলো এতোই অমলিন এতোটাই জীবন্ত যে, খুব সহজেই পুরনো হওয়ার মতো না। ছয় বছর পরও এই স্মৃতির ওপর কোনরকম আস্তরণ পরার সুযোগ নেই। আমি সেই দিনের কথা বলতে চাই যেদিন ভিসি চত্বরে প্রথম শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ হয়। ১৫ জুলাই একটা হামলা হয়েছিল, আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন। সেদিন রাজু ভাষ্কর্য্যে সারাদিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করার পর যখন মিছিল নিয়ে হলপাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম; তখন হলপাড়ার ওই দিকে বড় র‌্যালি নিয়ে আমরা এগুচ্ছিলাম। এগুতে এগুতে একটা পর্যায়ে আমরা ঘুরে মল চত্বরের সামনের রোড দিয়ে ঘুরে বের হবো। ওইখানে থাকা অবস্থায় আমরা স্লোগান দিচ্ছিলাম। পাশাপাশি অন্য যারা ছিল তারা পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে দাড়িয়েছিল। আবার ঘুরে রাজু ভাষ্কর্য্যের দিকে আসবো এরকম একটা ইচ্ছা আমাদের ছিল।

আমরা তখন একটা আভাস পাচ্ছিলাম যে আশপাশে একটা হট্টগোল হচ্ছে বা হতে পারে বা আমাদের ওপর আক্রমণ হতে পারে। কিন্তু আমাদের এরকম হবে তা চিন্তার মধ্যে ছিল না। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থী খালি হাতে আন্দোলন করতে এসেছি, আমাদের ওপর কেন হামলা হবে। সেই পর্যায়ে আমি স্লোগান দেওয়ার জন্য হাতে মাইক নিয়েছিলাম। সামনে আমি মিছিলের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো এবং হাতে মাইক নিয়ে স্লোগান দিবো। সামনে ছিলেন নাহিদভাই উমামা আপাসহ আরও অনেকেই। তারা মিছিলের সম্মুখ সারির দিকে। হুট করে খেয়াল করলাম নাহিদ ভাই এবং উমামা আপারা পিছনের দিকে যাচ্ছে। মিছিল নিয়ে সামনে যাওয়ার কথা কিন্তু দেখছি তারা পিছাচ্ছে। কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। একটা পর্যায়ে পেছনের দিকে তাকালাম যে কি হচ্ছে। দেখি শেখ হাসিনার পোষা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ভাড়া করা গুন্ডারা হেলমেট পরে হাতে লাঠি, রড আদলা ইট নিক্ষেপ করতে করতে আমাদের দিকে অর্থাৎ মিছিলের দিকে এগোচ্ছিল। তাদের যখন এভাবে এগুতে দেখি তখনতো আমরা খালি হাত। তাদের সামনে আমরা আসলে কি নিয়ে দাঁড়াবো। তারা যথেষ্ট হি্রংভাবে আমাদের দিকে এগোচ্ছিল। একটা পর্যায়ে নাহিদ ভাই আর উমামা আপারা যখন পিছনের দিকে এগুচ্ছে তাদের সাথে সাথে আমিও পিছনের দিকে এগোলাম। আমরা তখন পিছন দিক দিয়ে হলপাড়ার দিকে চলে গেলাম মল চত্বরের রোড থেকে একদম ভেতরের দিকে। হলপাড়ার এদম সামনের জায়গাতে অবস্থান নিলাম। তখন ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার কারণে মিছিল কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। একটা পর্যায়ে আমরা নাহিদ ভাইদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাই। সেসময় দেখি একটা মেয়ে ঘটনাটার লাইভ করছে। আসলে সময়টা এমন ছিল যে, তখনকার সময়ে কে আমাদের শত্রু কে আমাদের মিত্র সহজেই চেনা যেত। মানে যারা শত্রু ছিল তাদের হাতে অস্ত্র ছিল, লাঠি ছিল। আমাদের মাথায় পতাকা বাঁধা. আর হাতে কোন প্ল্যাকার্ড কিংবা কোন লেখা। তখন আমি এক শিক্ষার্থীকে দেখলাম, ছত্রভঙ্গ অবস্থায় তাকে পাই। তখন আমরা দুজন হাত ধরে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। তখনো বিভিন্ন দিক থেকে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছিল তখনও। একটা পর্যায়ে আমরা ভিসি চত্বরের সামনে এসে দাঁড়াই। আমার সাথে যে সহযোদ্ধাটা ছিল তার নাম হচ্ছে ফারহানা। আমি এবং ফারহানার মধ্যে হাত ধরা। আর ফারহানা এক হাত দিয়ে ফেসবুকে তখনো লাইভ করছে। বেশ কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়ানোর পরও বিচ্ছিন্নভাবে সবাই স্লোগান দিচ্ছিল। হুট করে মল চত্বরের সামনের রোড থেকে আবার সেই পোষা লীগরা অস্ত্রশস্ত্রসহ আমাদের দিকে ধাবিত হয়।

তারা আমাদের ওপর রড আদলা ইট দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। একটা পর্যায়ে আমরা নিজেদের সেইফ করার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করি। ওই সময় দৌড়াতে গিয়ে ফারহানার হাত আমার হাত থেকে ছুটে যায়। তখন থেকে ফারহানা আর আমি আলাদা হয়ে যাই। ভিসি চত্বরের মধ্যখান থেকে আমরা যখন ছুটাছুটি করছি সবাই, একটা পর্যায়ে ভিসি চত্বরের সাইটে যে ঢাকা ভার্সিটির বাসগুলো রাখা থাকে. ওই জায়গায় বাসের চাকার ভেতরে আমরা আটকে যাই মানে আশ্রয় নেই। তখন দুই দিক থেকেই ভাড়া করা গুন্ডারা আক্রমণ শুরু করে। তারা ১০ মিনিটের মতো সময় জিনিসগুলো আমাদের ফেইস করতে হয়েছে। আমার জীবনে এরকম নির্মম পরিস্থিতি করুন দৃশ্য আন্দোলনের আগে আর কোনদিন দেখিনি। পরবর্তীতে আগস্টের ৩.৪ ও ৫ তারিখ এর চেয়ে নির্মম ভয়াবগ ঘটনা দেখেছি, ফেস করেছি। কিন্তু সেদিনকার ঘটনা জীবনে প্রথম। ১৫ জুলাইয়ে যে ঘটনা টা সেখানে যখন আমরা আটকা পরি. তো ছাত্রলীগের যারা ছিল তাদের হাতের লাঠি রড এগুলো দিয়ে যাকে পেয়েছে তাকেই বেধরক মারধর করেছে। কোথায় লাগছে সেটা দেখেনি। টার্গেট করে করে মাথার দিকে আঘাত করেছে। একটা পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কাকুতি মিনতে করা শুরু করে। আমাদের কেন মারছেন। আমরা আমাদের দাবি নিয়ে এসেছি। আমরাতো অযৌক্তিক কোন কথা বলিনি। কেন আমাদের ওপর এমন হামলা করা হচ্ছে। ঠিক ওই মুহুর্তের ১০ টা মিনিট কিভাবে কেটেছে তা আমার জীবনে মনে হয়েছে সেখান থেকে আদৌও বেঁচে ফিরতে পারবো কি-না জানি না। বাট. বেঁচে ফিরলে এদের শেষ দেখতে হবে। এরা মেয়েদের গায়েও হাত তুলতে দ্বিধাবোধ করেনি। এবং বিভিন্নভাবে মলেশ থেকে শুরু করে নানাভাবে হ্যারেজমেন্ট অত্যাচার নির্যাতনের নিন্মপর্যায়ে যতদূর যাওয়া সে পর্যন্ত পৌছে গেছে। ওইখানে থাকা অবসথায় বাম পায়ে ডান হাতে মাথায় মোট কথা সারাগায়েই এরা আঘাত করেছে। ভোবে পেরেছে সেভাবেই মেরেছে আমাকে। আমাকে সহ আমরা যারা ছিলাম সবাইকে মেরেছে।

ঢাকা মেডিকেলে হামলা : মারধরের সময় যখন আমার মাথায় আঘাত লাগে তখন আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার চোখে চশমা ছিল। চশমায় আঘাত লাগার কারণে আমার চশমা ভেঙ্গে পড়েছিল। পরবর্তীতে দুটি ভাঙ্গা চশমার ছবি মিডিয়াতে আসে। সেই চশমার একটি ছিল আমার। যখন তারা মারছিল তখন একটা পর্যায়ে মনে হয়েছিল যে মারধরের সময় যদি পড়ে যাই; বাজে যদি কিছু হয় তাহলে যে তারা আমার সাথে কি করতো তাতো আমার জানা নাই। তখন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের দেশব্যাপী একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ ছিল সমন্বয় সারাদেশ নামে। মারধরের কারণে তখন আমার অবস্থা এমন হয়েছে যে কোন সময় আমি পরে যাবো। তাই তাৎক্ষণিক আমার মনে হলো পরে গেলে এরা আমার সাথে কি করবে আমি জানি না। এজন্য ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে একটা ভয়েস দিলাম এই বলে যে আমি এই অবস্থায় আছি আশপাশে যদি কেউ থাকেন, আমাকে সেইফ করেন। আমি আর কতক্ষণ সজ্ঞানে থাকবো আমি জানি না। এরপর আশপাশে কয়েকটা ভাই এসে আমাকে একটা রিকশায় তুলে দেয়। এরপর আমার কি হয়েছে আমার মনে নেই। দীর্ঘক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম। পরবর্তীতে যখন আমি শুনি যে সেখান থেকে আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছিল। আমি তখনো অজ্ঞান ছিলাম। শেষ বিকেলের দিকে ঢামেকে যখন অল্প জ্ঞান আসলো তখন তখন দেখি বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক বিশেষ করে রিফাত রশিদ, প্রীতম সোহাগ ভাইসহ আরও যারা যারা ছিল, তাদের অনেকেই সেখানে উপস্থিত হতে দেখেছি। সেখানে আমার ক্যাম্পাসের এক বড় আপা ওনার নাম সুলতানা খানম জান্নাত উনিসহ হলে আরও যারা ছিল তারা উপস্থিত হয়েছিল। সেদিন তারা এতো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আহত করেছে যে, সবাই মাথা ফাটা। মাথা থেকে রক্ত বের হয়েছে অবস্থা। সন্ধ্যার দিকে যখন আমাকে সিটি স্ক্যান রুমে নেওয়া হয় তখন আমার একটু একটু জ্ঞান ফিরছে বলে মনে হয়। একথা একদম প্রচলিত যে, মাঠে যারা একবার আক্রমণের শিকার হয়, দ্বিতীয়বার তারা হাসপাতালে হামলার শিকার হয়।

তখন বড়ভাইরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, অন্যকোনখানে আমাকে সরিয়ে ফেলতে হবে। নয়তো আবার হামলার শিকার হতে হবে। তখন আমাকে ঢামেক থেকে সরিয়ে সিএনজিতে করে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমি যতটুকু জেনেছি, যে আমাকে যখন সিএনজিতে ওঠি তখন ওরা দেখতে পায়নি যে আমি সিএনজিতে। ওই সময়টাতেই ঢাকা মেডিকেলে আবার হামলা হয়। যারা আহত ছিল তাদের ওপর আরও এক দফা আক্রমণ হয়। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ১৬ জুলাই পর্যন্ত থাকি। ১৬ তারিখ যখন সারাদেশে বিভৎসতার দৃশ্য টেলিভিশনে দেখি তখন সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ভাবলাম যে এখান থেকে যদি বাসায় আম্মা আব্বার কাছে ফিরে যাই তাহলে তারা কোন না কোন ভাবে আমাকে বাধা দিতে পারে। পরবর্তী দিন গুলোতে যাতে আন্দোলনে না যেতে পারি। আমি এক সিনিয়র আপাকে ফোন করলাম যে আমাকে তার বাসায় রাখা যাবে কি-না। আমি আমার বাসায় না গিয়ে লালবাগে সেই আপার বাসায় চলে যাই।

পলাশী মোড়ে অবস্থান এবং পুলিশের হামলা : বাসায় রেস্ট না নিয়ে ১৮ তারিখ সকাল বেলা আবার বের হই। সেখানে বুরহান উদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের নিরব ভাইসহ আরও যারা যারা আছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করি যে আমরা কোথায় অবস্থান করবো। আমরা আলোচনা করে আজীমপুরের কলোনির সামনে যে মোড় আছে সেখানে অবস্থানের কথা জানায়। আমি যখন ওখানে পৌঁছাই তখন আমার কাধে একটা ব্যাগ ছিল, একটা জামা পরা আমি আর আমার হাতে একটা ফোন। আমি সেখানে গিয়ে দুই একবার ঘুরছিলাম। কারণ আশপাশে তখনো কেউ জমা হয়নি। দুএকজন ছিলেন আলাদা আলাদা। পুলিশ বার বার পাহারা দিচ্ছে। আমি একদম নীলখেত মোড়ের দিকে যখন এগুচ্ছি তখন একজন মুরুব্বী জিজ্ঞেস করলেন তুমি কি স্টুডেন্ট ? আমি বললাম হ্যাঁ। তখন ওনি বলেন যে তুমি এখান থেকে চলে যাও। আজ এখানে আর অবস্থান করতে এসো না। আমাকে এক প্রকাশ তাড়িয়ে দিতো। ওখান থেকে আবার আমরা সামনের দিকে এলাম। এরপর স্টুডেন্টরা আস্তে আস্তে জড়ো হয় এবং আমরা অবস্থান কর্মসুচী করি। এক পর্যায়ে ভিকারুন্নেসার শিক্ষার্থীরা আমাদের সাথে সংহতি জানায়। সারাদিন তারা আমাদের সাথে অবস্থান করে। সেদিন বিকেলের দিকে আমাদের কাছে মনে হয়েছে পলাশির দিক থেকে পুলিশ কিংবা ছাত্রলীগ আক্রমণ করতে পারে। তখন আমার কাছে মনে হলো স্কুলের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ আমাদের একটি শক্তি একটা অনুপ্রেরণা। এখানে যদি পুলিশ বা ছাত্রলীগ যদি আক্রমণ করে তাহলে সবাই বিভিন্ন ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন ওরা আহত হবে।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাই যে আমরা যারা বড়রা আছি তারা অবস্থান করবো। স্কুলের যারা আছে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দেবো। কারণ এখানে তাদের রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তখনো আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর পাচ্ছিলাম যে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করছে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের বাসায় পাঠিয়ে দেই। দেখা গেল কি, কিছুক্ষণ পরই পলাশির মোড় থেকে পুলিশ গুলি করতে করতে আমাদের দিকে আসা শুরু করছে। অন্যদিক থেকে ছাত্রলীগ লাঠিছোটা নিয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকে। পুলিশ তখন টিয়ারসেল সাউন্ড গ্র্যানেডও নিক্ষেপ করতে থাকে। তখন আমরা বের হওয়ার রাস্তা না পেয়ে কলোনির ভেতর চলে আসি। আজিমপুর কলোনির ভেতরে ঢুকে পরি। আমাদের কাছে মনে হয়েছিল যে কলোনির ভেতর হয়তো বা ছাত্রলীগ বা পুলিশ ঢুকবে না। একটা পর্যায়ে দেখি কলোনির ভেতরে ছাত্রলীগ ঢুকে গেছে। পুলিশ বাইরে থেকে সাউন্ড গ্র্যানেড দিচ্ছে। তখন সেখান থেকে সরে একটি ভবনে আশ্রয় নেই। আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে একজনের গায়ে ১৭টা রাবার বুলেট গায়ে লেগেছে। অনেকে টিয়ার সেলের গ্যাস খেয়ে অবস্থা গুরুতর ছিল। এরপরও পুলিশ সাউন্ড গ্র্যানেড দিচ্ছে আর বাইরে হেলমেট পরে যাকে পাচ্ছে পেটাচ্ছে। আমার কাছে মনে হতো যে ৭১ এ জন্মালে হয়তো যুদ্ধ করতাম। কিন্তু ২৪ জুলাই আন্দোলনের পর আমার কাছে মনে হয় যে, আমার পরবর্তী প্রজন্ম যেন যুদ্ধ দেখার আশা পোষন যেন না করে। কারণ যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি।

কারফিউর দিনগুলো : ১৮ জুলাই রাত ৮টার পর আমরা ওই ভবন থেকে বের হই। ওই ভবনে যারা ছিলম, আমাদের বের হতে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। তারা আমাদের খবর দিয়েছে যে ছাত্রলীগের কারা কোথায় আছে। এরপর থেকে কারফিউ শুরু হয়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। ইন্টারনেটের অবস্থা পুরেপুরি অচল করে দেওয়া হয়। তখন আমরা ফোনে যোগাযোগ করতান যে কোন সময় কোনখানে অবস্থান করতে হবে। তখন অনেক স্থানেই মিছিলমিটিংগুলো বিচ্ছিন্নভাবেই হতো। এখানে পুলিশ ব্ল্যাকআউট করে যে নির্মমতাটা চালিয়েছে তা আপনারা ভালভাবেই জানেন। এগুলো প্রত্যেকটাই আমাদের জন্য আলাদা আলাদা জার্নি ছিল। তখন আসলে আন্দোলনটা ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক ছিল না। সারাদেশে ছড়িয়ে যায়।

১৮ তারিখের পর থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। আমাদের আইডি হ্যাক করা হয়। তখন আমরা ছোট ছোট গ্রুপ করে করে রাস্তায় নেমে যেতাম। যেমন লিফলেট বিতরণ গণসংযোগ এরকম কর্মসূচিগুলো পালন করতাম। যাতে কারফিউর মধ্যে আমাদের আন্দোলনটা যেন ঢিলে ঢালা না হয়ে যায়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আমরা এরকম করতাম।

লাল প্রতিবাদ : আগস্টের আগে আমরা তখন সবাই একধরণের বন্দী অবস্থা। তখন ৩০ জুলাই তারিখের দিকে যখন স্বৈরাচার সরকার শোকের মাসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কালো ব্যাচ ধারণের প্রস্তুতি চলছিল । তখন আমাদের কাছে মনে হলো— জুলাই মাসে আমাদের ভাইদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদের রক্ত ঝরানো হয়েছে, আমাদের এই রক্ত সংগ্রাম এবং যুদ্ধের রক্তকে শোক হিসেবে দেখবো আরও পরে। ঝরানো রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার পরে। আন্দোলনের রেজাল্ট আসার পরে। তখন আমাদের একটা সিদ্ধান্ত হলো যে লাল করে এর প্রতিবাদ জানাবো। ও হো মনে পড়েছে ৩০ তারিখ রাত থেকে আমরা ফেসবুক লাল করে প্রতিবাদ শুরু করি। তখন সারা বাংলাদেশের মানুষ ফেসবুল লাল করে প্রতিবাদ জানায়। আমরা দেখলাম বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে এর একটা ভাল প্রভাব পড়েছে। এরমধ্যে আন্দোলন দমানের হন্য সমন্বয়কদের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নিয়েছে, প্রথমে আমরা যখন দাবি নিয়ে আন্দোলনে ছিলাম তখন একটা পর্যায় ছিল। এরপর যখন আমার ভাইদের বুকের ওপর গুলি চলে, আমাদের ভাইরা নিহত হয়; তখন বিষয়টা অন্যরকম হয়ে দাঁড়ায়। এই আন্দোলনটা কিন্তু কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে করা হয়নি। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়ে যায় নাহিদ ইসলাম কিংবা আসিফ ভাইকে ধরে নিয়ে আন্দোলন থামানো যেত না।

আগস্ট মাসের কথা : আগস্টের ১ তারিখে আমরা বুঝতে ছিলাম বাংলাদেশের মানুষের সাথে যেটা হয়ে এসেছে এবং জুলাই মাসে এটা চরম পর্যায়ে চলে গেছে। মানুষের জনমনের আকাক্সক্ষটা এখন এক দফা। ইতিমধ্যে অবশ্য কাদের ভাই ৯ দফা দিয়ে দিয়েছেন। তখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে সরকার এই ৯ দফা গ্রহণ করবে না। তা না মেনে সরকার আমাদের ওপর নিপীড়ণটা চালিয়ে যাচ্ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে যে এক দফা দাড়াবে সেটা আমাদের কাছে ১ তারিখ ২ তারিখের দিকে স্পষ্ট হয়ে যায়। আমি যখন বুঝতে পারলাম লালবাগে থাকাটা ঠিক হবে না। কারণ নানাভাবে আমাকে ট্রেসিং করা হচ্ছে। শিক্ষকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছে। বাসা পর্যন্ত আইডেনন্টিফাই করেছে। তখন আমি যাত্রাবাড়ীতে রায়েরবাগে আমার বান্ধবীর বাসায় চলে আসি। আত্বীয় স্বজনের বাসায় যেতে পারছিলাম না এই কারণে যে সেখানে আমাকে খুঁজবে।

৩ আগস্ট তারিখে আমরা যখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে রওয়ান হই, তখন স্কুলের রাস্তাগুলোও আটকে রাখা হয়। আমি যখন পরিচয় দিলাম আমি সমন্বয়ক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাবো; তখন দেখলাম সুন্দর করে আমার সিএনজি ছেড়ে রাস্তা পরিষ্কার করে এগিয়ে দিলো। এককথায় তাদেরকে যে বোঝানো গেছে এই ঐক্যটা আমাদের কাম্য এখনো। শহীদ মিনারে এসে দেখলাম হাজার হাজার লাখো লাখো মানুষ। দেখলাম সবার চোখে মুখে একটাই দাবি একদফা। নাহিদ ভাইয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ের আগেই মানুষ স্লোগান দিচ্ছিল হ- হাসিনা হ-তে হত্যাকারী। এক দফা এক দাবি হাসিনা তুই কবে যাবি। এরকম স্লোগান দিচ্ছিল। আমরা তখন ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে। বিষয়টা এমন যে ২০৪০-২০৫০ সালে গিয়েও বলতে পারবো আমিও ইতিহাসের অংশ ছিলাম। সেদিন হাজার হাজার না লাখ লাখ মানুষ যখন এক আঙ্গুল জাগিয়ে এক দফার ঘোষণাটা দিচ্ছিল। তখন আসলে সব সমন্বয়ক ছিল না। কারণ সেখানে আমাদের ওপর স্নাইপার অ্যাটাক থেকে শুরু করে যেকোন কিছু হওয়ার ভয় ছিল। সেখান থেকে তুলে নেওয়ার ভয়ও ছিল। আমরা অবশ্য আন্দোলনের লিডিং এর সেকেন্ড লেয়ার রাখা। নাহিদ ভাই আসিফ ভাই এদের তুলে নিয়ে গেলে আন্দোলন যেন থেমে না যায়। আমাদের মধ্যেই স্নাইপার অ্যাটাকের শঙ্কা ছিল একারণে যে কারফিউর দিনগুলোতে স্নাইপার অ্যাটাক হয়েছে। একারণে অনেক সহযোদ্ধা মারা গেছে।

যাত্রাবাড়ীতে যা দেখলাম : আগস্টের ৪ এবং ৫ তারিখে যাত্রাবাড়িতে ছিলাম। ৩ তারিখের পর থেকে কিন্তু ফেসবুকে নানা গুজব চলছিল। যে ৭ মিনিটে ক্লিয়ার করে দিবে। আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ এগুলো ছড়াচ্ছিল। এজন্য ৪ তারিখ থমথমে ছিল। তখনো আমাদের লংমার্চ টু ঢাকা ঘোষণা করা হয়েছে। ৪ তারিখে ঘোষণা করা হলো যে ৬ তারিখে লং মার্চ টু ঢাকা। ৪ তারিখেই শহীদ মিনারে একটা ম্যাসাকার হয়। পরবতীতে দেখা গেল যে, জনগনের যে আকাক্সক্ষা, ফোর্স দিয়ে যেভাবে সরকার মানুষকে হত্যা করছে। তখন মনে হলো যে এখন আসলে অপেক্ষা করে তাদের হত্যাকান্ডের সময়টাকে না বাড়িয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে যেতে হবে। ৪ তারিখে সারারাত আমার ঘুম হয়নি। ফজর নামাজের পর একটু শুয়েছি। অন্ধকারে রাস্তায় নামা যাচ্ছিল না। আন্দোলনে বের হওয়ার সময় বাসার দরজার দিকে একবার তাকাতাম। এই দরজাটা আবার দেখবো কি-না।

৫ তারিখের ঘটনাটা এমন ছিল যে, সকালে যখন আমি যাত্রাবাড়ীর দিকে। প্রথম দিকে মানুষ একটু কম ছিল। লোকজন বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থায ছিল। আমি তখন ফ্লাইওভারের নিচে ছিলাম। দেখলাম একটা মিছিল আসছে। এই মিছিলে আস্তে আস্তে যুক্ত হতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি পুরো রাস্তা ভরে যায়। সেখানে লাখ লাখ মানুষ এসে উপস্থিত হয়। আমরা যখন যাত্রাবাড়ী থানার দিক থেকে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম. পুলিশ এলোপাথারি দিদ্বিদিক যেভাবে গুলি করছিল; আমার সামনের একজন স্পট ডেড হয়ে যায়। সে সামনে না থাকলে গুলিটা আমার গায়ে লাগতো।

অনুলিখন : ইবরাহীম খলিল