দাওয়াত ইলাল্লাহর সম্প্রসারণ ও বর্তমান মুসলিম উম্মাহ
হে মানব সম্প্রদায়, তোমরা সেই আল্লাহর ইবাদাত বা আনুগত্য করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী মানুষদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা আল্লাহভীরুতার গুণাবলি অর্জন করতে পারো। —সূরা আল বাকারা-২১
Printed Edition

প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ
রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজটি ছিল সার্বজনী, কল্যাণমুখী। মানবতার দো জাহানের মুক্তির জন্য তিনি ও তাঁর সাহাবিগণ দ্বীনী দাওয়াতী মিশনটি আজীবন জারী রেখেছেন। দাওয়াত ইলাল্লাহর ভিত্তিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থায় রূপ দিয়েছেন মদিনায় একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যেখানে সব ধর্মের মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার সার্বিক নিরাপত্তা পেয়েছিলো। নবুয়্যত পাওয়ার পর আল্লাহ তা’আলার নির্দেশনা অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতী কাজের সূচনা করেন।
আল্লাহ তাআলার ঘোষণা :
“হে নবী! ডাকো মানুষদেরকে তোমার রব আল্লাহ তাআলার পথে প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও উপদেশপূর্ণ ভাষার মাধ্যমে ।” —সূরা আন নাহল-১২৫
আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব শ্রেণির মানুষকে আল্লাহর দ্বীন আল ইসলাম তথা আলকুরআনের হেদায়াতের দিকে উদাত্ত আহ্বান জানান দৃঢ় বিশ্বাস ও আন্তরিক সদোপদেশপূর্ণ মানসিকতায়।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহর নির্দেশের দিকে দাওয়াত প্রদান করেন। আলকুরআনের ভাষাায় তিনি বলেন :
হে মানব সম্প্রদায়, তোমরা সেই আল্লাহর ইবাদাত বা আনুগত্য করো যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী মানুষদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা আল্লাহভীরুতার গুণাবলি অর্জন করতে পারো। —সূরা আল বাকারা-২১
তোমরা আল্লাহর সাথে কেমন করে কুফরি বা অস্বীকারকারীর মতো আচরণ করো? তোমরা তো ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদের জীবন দান করেছেন। কিছুকাল পর তোমাদের মৃত করবেন। আবার কবর থেকে জীবিত করবেন। এমনিভাবে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে বিচার দিবসে। -সূরা আল বাকারা-২৮
এভাবে রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সার্বজনীনভাবে দাওয়াত ইলাল্লাহর ভিত্তিতে দীনী দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর নবুয়্যতি জীবনের প্রথমেই গণদাওয়াতের ভাষা ছিল :
হে দেশবাসী, একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব, আনুগত্য করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ বা হুকুমদাতা নেই। —সূরা আরাফ-৫৯
হাদিস সহীহ মুসলিমে উল্লেখ আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে মানবজাতি! তোমরা ঘোষণা করো, আল্লাহ ছাড়া সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী আর কেউ নেই। তাহলে তোমরা উভয় জগতে সফলকাম হবে।
তাগুতি বা আল্লাহদ্রোহী শক্তিকে অস্বীকার করে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে বলেন, বলে দিন হে মুহাম্মাদ, এটাই একমাত্র পথ যে পথে আমি আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাই। -সূরা ইউসুফ-১০৮
দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজকে আল্লাহ তা’আলা সর্বোত্তম কাজ বলে ঘোষণা করেছেন :
তার কথার চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহ্বান করে, নিজে সৎ কর্ম করে এবং বলে আমি মুসলিম বা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী। -সূরা-হা-মীম-আসসাজদাহ্-৩৩
দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজকে আল্লাহ তাআলা দলবদ্ধভাবে আনজাম দেওয়ার জন্য অবশ্য কর্তব্য হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন :
তোমাদের মধ্যে অবশ্যই এমন একটি উম্মাহবা দল থাকতে হবে, যারা সদা উত্তম কাজের দিকে সমগ্র মানবতাকে আহ্বান জানাবে এবং সুকর্মের আদেশ দেবে আর মন্দ কাজের বাধা প্রদান করবে। তারাই হবে দুনিয়া- আখিরাতে সফলকাম। -সূরা আলে ইমরান-১০৪
সমস্ত নবী রাসূলের দাওয়াতের মূল সুর একই ছিল, আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করে তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করো!
সমাজে আল্লাহর আইন, রাসূলের অনুসরণ ও সৎ লোকদের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে মানুষ মানুষের দাসত্বে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হয়। নবী রাসূলগণের দাওয়াতী কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানব রচিত আইনের সমাজব্যবস্থার মূল উৎপাটন করে আল্লাহর আইন ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার বিপ্লব সাধন করা। শেষ নবী রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় কুরআানি আইনের ভিত্তিতে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বাস্তব নজির প্রদর্শন করেন। সব শ্রেণির মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেন। রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদিকে যেমন পরিচয় ছিল দাঈ ইলাল্লাহ, আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহ্বানকারী, তেমনি আর এক পরিচয় ছিল সত্যের জীবন্ত সাক্ষ্যরূপে। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা :
আমি তোমাদের প্রতি রাসূল পাঠিয়েছি সত্যের সাক্ষ্য রূপে, যেমন সত্যের সাক্ষ্যরূপে রাসূল পাঠিয়েছিলাম ফির’আউনের প্রতি। -সূরা- আল মুযযামমিল-১৫
বিদায় হজ্জের ভাষণে লক্ষাধিক মুসলিম সাহাবির উপস্থিতিতেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হে ঈমানদার, মুসলিমগণ-সম্বোধন না করে ইয়া আয়্যুহান নাস- হে সমবেত মানবতা বা হে মানবসম্প্রদায় বলে সাত বার সম্বোধন করছেন। যা ছিল সার্বজনীন কল্যাণকামী দাওয়াতের চেতনা। তাঁর বিদায়ী ভাষণের মূল লক্ষ্য ও টার্গেট ছিল বর্তমান ও অনাগত কালের সমস্ত মানবতার মুক্তির নির্দেশনা। আজকের বিপর্যস্ত পৃথিবীকে শান্তি ও নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য রাসূলের সেই সার্বজনীন কল্যাণের ভাষণকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে। তিনি সমস্ত বর্ণবাদকে অস্বীকার করে এক আল্লাহর নির্দেশকে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে বাস্তবায়নের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ তা’আলা রাব্বুল আলামীন-সমগ্র সৃষ্টিকুলের পালনকর্তা। আল্লাহর আনুগত্য করলে সমগ্র সৃষ্টি জগতের সব প্রাণী নিরাপদে খেয়ে-পরে জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে। রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন রহমাতুল্লিল আলামীন-সমগ্র জাহানের সমগ্র সৃষ্টির জন্য রাহমাত বা কল্যাণকামী নবী বা পথপ্রদর্শক। আর আল্লাহ প্রদত্ত আলকুরআন হলো, হুদাললিননাস-সমগ্র মানবজাতির জন্য মুক্তির পথ-নির্দেশিকা, গাইড লাইন।
* মানবরচিত আইনের অসারতা :
মানবরচিত আইন মানুষ সমস্যার সমাধান দিতে পারে না।
কার্লমাক্স, লেনিনের মতবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ -সব অপরিণামদর্শী মতবাদ মানুষের ইহকাল-পরকালের কল্যাণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে খাইরে উম্মাহ, উম্মাতে ওাসাত—উত্তম জাতি ও মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করে মানবকল্যাণে নিবেদিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ আল্লাহর নির্দেশ পালনে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু আজকের মুসলিম উম্মাহ কী সে দায়িত্ব সঠিকভাবে আনজাম দিচ্ছে! সেটাই আমাদের পর্যালোচনার বিষয়।
* রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ইলাল্লাহ সম্প্রসারণ পদ্ধতি :
আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ও মদিনায় ভিন্নতর পদ্ধতিতে আনজাম দিয়েছেন। দাওয়াতে দীনের ভাষা, প্রকাশভঙ্গি, কৌশল পদ্ধতিতে স্থান, কাল বিষয়ে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। মক্কায় তিনি গোপনে তিন বছর তাঁর পরিবার-পরিজন, বন্ধু-স্বজনকে দীনে ইলাহির দাওয়াত প্রদান করেন। পুরুষদের মধ্যে প্রথম দিকে হযরত আবু বকর, আলী রা. দীন ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেন। মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদিজা ও ফাতিমা রা. ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে হযরত আবু বকর রা. এর দাওয়াতী প্রচেষ্টায় হযরত উসামা, যোবায়ের, আবদুর রহমান বিন আওফ, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, তালহা বিন আবদুল্লাহ, হযরত বেলাল, আবু উবায়দা, আবু সালামা, আরকাম বিন আবুল আরকাম, উসমান বিন মাযঊন, উবায়দা বিন হারিস, খাব্বাব বিন আরত, আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. প্রমুখ ৪০ জন দীনে ইলাহি কবুল করেন। নব মুসলিমদের প্রতি রাসূলর নির্দেশ ছিল গোপনে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজ করা। গোপনে তিন বছর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঈমানদার সাহাবিগণ দলবদ্ধ ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক পরামর্শ ও কৌশলগত সহযোগিতায় দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটান।
* প্রকাশ্যে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজ :
তিন বছর পর আল্লাহ তা’আলা সূরা শুয়ারার-২১৪ নং আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রকাশ্যে দাওয়াতে ইলাহির কাজে নিবেদিত হওয়ার নির্দেশ দেন : হে নবী! আপনি প্রকাশ্যে আপনার আত্মীয়দের আল্লাহকে অমান্য করার ভয়াবহ পরণতির ভয় দেখিয়ে সতর্ক করুন!
-সূরা শুয়ারা-২১৪
প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজের নির্দেশ পাওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হাশিমের আবু লাহাব, আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান প্রমুখসহ ৪৫ জনকে নিয়ে সমাবেশ করেন। সমাবেশ সফল না হওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে উঠে প্রকাশ্যে কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’র দাওয়াত প্রদান করেন। সাথে সাথে তাঁর চাচা আবু লাহাবের পক্ষ থেকে প্রচ- বাধা ও গালি-গালাজ উচ্চারিত হয়। সাথে যুক্ত হয় মক্কার কাফিরশ্রেণি। সেদিন তারা বুঝেছিল, কালিমার দাওয়াত সম্প্রসারিত হলে সমাজে আল্লাহর আইন ও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের মনগড়া আইন ও নেতৃত্ব ধ্বংস হবে। তাই তারা বিভিন্ন নির্যাতনের প্রক্রিয়ায়, এমনকি রাসূলকে দুনিয়া থেকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। আল্লাহর রাসূলকে দাওয়াতী কাজে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে তারা তাঁকে জ্যোতিষী, গণক, জাদুকর, পাগল, কবি ইত্যাদি অপবাদে অপমানিত ও বিতর্কিত করার প্রচেষ্টা চালায়।
প্রতিপক্ষ আল্লাহদ্রোহীদের বিদ্রূপ ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় আল্লাহ তাআলা রাসূলকে তাঁর পরিচয় ও দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেন এভাবে : হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে দা’ঈরূপে ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে প্রেরণ করেছি। -সূরা আহযাব-৪৫-৪৬
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতী কাজে প্রতিপক্ষকে কাছে টানার জন্য এবং সংশোধনের জন্য কখনো কোমলতা, কখনো কঠোরতার পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজে বিরোধিতা :
সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বিধান আলকুরআনের বাণী তৎকালীন ব্যক্তি ও সমাজে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হাজারো বাধা-বিপত্তি, নির্যাতন-নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন। জন্মভূমি মক্কার যে মানুষগুলো রাসূলের চরিত্র-মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে আল আমীন, আস সাদিক অভিধায় বিভূষিত করেছিলেন, তারাই কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র দাওয়াত শোনার পরই নানা ধরনের অপপ্রচার, অমানবিক আচরণ, নির্যাতন ও সামাজিক বয়কটের মতো হিংস্র ষড়যন্ত্রে নিমগ্ন হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ভিত্তিহীন অপবাদের পাশাপাশি তারা আল্লাহর কিতাব আলকুরআনকেও মুহাম্মাদ সা. রচিত এক কল্পকাহিনি বলে অপপ্রচার করে।
উমাইয়া বিন খালফ রাসূলকে দেখলেই অকথ্য ভাষায় নিন্দা ও কটূক্তি করতো, এমনকি ইতরের মতো তাঁর পবিত্র দেহে থুথু নিক্ষেপ করতো। ( লানাতাহুল্লাহ )
আবু জাহেল মাকামে ইবরাহীমে রাসূলকে সালাতরত অবস্থায় ঘাড় মটকাতে গিয়ে অদৃশ্য ভয়ে ফিরে আসে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাগণকে শেবে আবু তালিবে তিন বছর নির্বাসিত করে অভুক্ত অবস্থায় নির্যাতিত করে। তায়েফে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্মমভাবে আঘাতের পর আঘাত করে। নবুয়্যতের পঞ্চম বছরে নির্যাতনের মাত্রা অসহনীয় হলে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন।
* প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিকভাবে দাওয়াত ইলাল্লাহর সম্প্রসারণ :
হিজরতের পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে মদিনা সনদের ভিত্তিতে সর্বজনীন ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে দাওয়াত ইলাল্লাহর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটান। আরব সাম্রাজ্যের বাইরে সপ্তম হিজরিতে রাসূল মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা-বাদশাহদের কাছে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত সম্বলিত পত্রাদি মুসলিম রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রেরণ করেন। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে প্রখ্যাত সাহাবি হযরত দিহইয়া আল কালবি রা., পারস্য সম্রাট কিসরার কাছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হুযাইফা আসসাহামি রা. এবং মিসরের সম্রাট মাকুকাসের কাছে হযরত হাতিব ইবনে বালতায়াকে পাঠান। হাবশায় হিজরতে পাঠানো সাহাবিদের নেতা হযরত আলী রা. এঁর ভাই হযরত জাফর রা.কে পাঠান সে দেশের খ্রিস্টান বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে। তাঁর হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠে কুরআনের তিলাওয়াত শুনে এবং খ্রিস্টান ধর্মের সাথে তার মিল দেখে অভিভূত বাদশাহ নাজ্জাশি কাফির কুরাইশ প্রতিনিধিদের অপপ্রচার সত্ত্বেও মুসলিম মুহাজিরগণকে আশ্রয় প্রদান করেন। ফলে দাওয়াত ইলাল্লাহ আরব সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নতুন একটি মহাদেশে প্রবেশের দার উন্মোচন করে। হাবশার বেশ কিছু নারী-পুরুষ ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করে। এভাবে পর্যায়ক্রমে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ইলাল্লাহর আওয়াজ দেশ থেকে দেশান্তরে পৌঁছে যায়।
মক্কা বিজয়ের পর রাসূল মুহাম্মাূ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমগ্র কাফিরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও ইসলামের সার্বজনীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
* বর্তমান মুসলিম উম্মাহর উদাসীনতা :
বর্তমান মুসলিম উম্মাহ দাওয়াত ইলাল্লাহর তৎপরতা থেকে দূরে সরে গিয়ে কাফির পরাশক্তিগুলোর লেজুড়বৃত্তি করছে। বিশ্বে ১৬০ কোটি মুসলমান থাকা সত্ত্বেও তারা পৃথিবীর দেশে দেশে বিশেষ করে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মির, বার্মায় মুসলিম নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মূল কারণ ইসলামি আদর্শ থেকে বিচ্যুতি ও অনৈক্য। আল্লাহ তাআলা আলকুরআনে ঘোষণা করেছেন : তোমরা আল্লাহর রজ্জু আলকুরআনকে মজবুত ও ঐক্যবদ্ধভাবে ধারণ করো, সাবধান বিচ্ছিন্ন হয়ো না। —আলে ইমরান-১০৩
আর গাফলতি, উদাসীনতা নয়, এখনই মুসলিম উম্মাহকে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজে নিবেদিত হয়ে আদর্শ, চরিত্রবান বিশ্বমুসলিমকে ঐক্যের বন্ধনে এনে ইসলামি পুনর্জাগরণে দীক্ষিত করে তুলতে হবে। মুসলমানরা কুরআন-সুন্নাহকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। বিপদ-আপদ, বিপর্যয়, আঘাত, হামলার পেছনেই রয়েছে মুক্তির সূর্য। আল্লাহ তাআলা ঈমানদার মুসলিমদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন : তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, তোমরাই হবে বিজয়ী, যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে মুমিন হিসেবে টিকে থাকো।” —সূরা আলে ইমরান-১৩৯
মুসলিম বিশ্বের নতুন প্রজন্ম যদি রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত দাওয়াতের পদ্ধতিতে কুরআনি আইন বাস্তবায়নে জীবন ও সম্পদকে আল্লাহর রাস্তায় উজাড় করে দিতে পারে, তাহলে মানবতা পাবে ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি।
তথ্যসূত্র :
১. আলকুরআন
২. আল হাদিস
৩. তাফহীমুল কুরআন : সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী
৪. ফী যিলালিল কুরআন : সাইয়েদ কুতুব শহীদ
৪. সীরাতে ইবনে হিশাম : আবূ মুহাম্মদ আবদুল মালিক ইবনে হিশাম মুআফিরী
৫. আর রাহিকুল মাখতূম : আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী
৬. মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সা. : নঈম সিদ্দিকী
৭. রাসূলুল্লাহ সা. এর বিপ্লবী জীবন : আবু সলিম
আবদুল হাই
লেখক : অধ্যাপক, গবেষক, কবি, গীতিকার।