সম্রাট শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন
মোগল সম্রাট শাহজাহান বিশ্বের সবচেয়ে জমকালো ও সূক্ষ্ম রুচিবোধসম্পন্ন নির্মাতা হিসেবে খ্যাত। তাঁর নির্মিত তাজমহল এখনো বিশ্বের সেরা স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। সেই সঙ্গে দিওয়ান-ই খাস, দিওয়ান-ই আম, চাঁদনি চক, মোতি মসজিদ, জামে মসজিদ ও দিল্লীর অদূরে শাহজাহানাবাদ নগরীসহ অসংখ্য স্থাপত্য শিল্পে ভরে তুলেছিলেন তিনি তাঁর সাম্রাজ্যে। এসব কারণে সারা বিশ্বে তিনি “স্থাপত্যকলার বিশ্ব-শাসক” হিসেবে পরিচিত।
Printed Edition

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
মোগল সম্রাট শাহজাহান বিশ্বের সবচেয়ে জমকালো ও সূক্ষ্ম রুচিবোধসম্পন্ন নির্মাতা হিসেবে খ্যাত। তাঁর নির্মিত তাজমহল এখনো বিশ্বের সেরা স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। সেই সঙ্গে দিওয়ান-ই খাস, দিওয়ান-ই আম, চাঁদনি চক, মোতি মসজিদ, জামে মসজিদ ও দিল্লীর অদূরে শাহজাহানাবাদ নগরীসহ অসংখ্য স্থাপত্য শিল্পে ভরে তুলেছিলেন তিনি তাঁর সাম্রাজ্যে। এসব কারণে সারা বিশ্বে তিনি “স্থাপত্যকলার বিশ্ব-শাসক” হিসেবে পরিচিত। এরকমই তাঁর আরেকটি সৃষ্টি ছিল “ময়ূর সিংহাসন”। একে বলা হতো “তখ্ত-ই তাউস” শব্দটি ফারসি। “তখ্ত” মানে সিংহাসন, ই’ হলো সংযোজন পদ এবং “তাউস” শব্দের অর্থ হলো ময়ূর। সর্বকালের সবচেয়ে দামি সিংহাসন। তবে সেটি এখন শুধু অতীত ইতিহাস। প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে ময়ূর সিংহাসন পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। তার খোঁজ আর শত চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
সম্রাট শাহজাহানের রতœময় সিংহাসনের সংখ্যা ছিল ৭টি। তবে এদের মধ্যে ময়ূর সিংহাসনই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও জমকালো। শিল্পের সমজদার বেবাদল খাঁর তত্ত্বাবধানে ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৮ বছর সময়ে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনি এটি নির্মাণ করেছিলেন। বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে, সে’ সময়ে আগ্রার তাজমহলের চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ ব্যয়ে সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করেছিলেন এই অপূর্ব ময়ূর সিংহাসনটি। এটি ছিল স্বর্ণ, হীরা ও দুর্লভ মরকত মণিখচিত। সিংহাসনের ৪টি পায়া নিরেট স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত ছিল এবং ১২টি মরকত মণির স্তম্ভের উপর চন্দ্রাতপ ছাদ আচ্ছাদন করা হয়েছিল। ছাদের চারদিকে মণি-মুক্তা বসানো ছিল। এর ভেতরের দিকটা সবটাই মহামূল্যবান চুনী ও পান্নার দ্বারা মুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রত্যেক স্তম্ভের মাথায় মণি-মাণিক্য খচিত একজোড়া ময়ূর মুখোমুখি বসানো হয়েছিল এবং প্রতিজোড়া ময়ূরের মধ্যস্থলে এক একটি মণি-মাণিক্য নির্মিত গাছ এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছিল যেন ময়ূর দুটি ঠোক্রে গাছের ফল খাচ্ছে এরূপ প্রতীয়মান হতো। পুরো সিংহাসনে অনেকগুলো স্বর্ণ দ্বারা নকশা করা এবং নকশার মাঝে ফাঁকা অংশটুকু কারুকার্য করা হয় ক্ষুদ্রাকৃতির মূল্যবান হীরা দিয়ে। হীরা-পান্না দ্বারা সুসজ্জিত তিনটি সিঁড়ির সাহায্যে উঠানামার ব্যবস্থা ছিল। সিংহাসনের উপরের চাঁদোয়ার চারকোণে বসানো হয়েছিল সারিবদ্ধ মুক্তা। চাঁদোয়াটির নিচেও ছিল হীরা আর মুক্তার বাহারি নকশা। রকমারি জহরত দিয়ে সাজানো ময়ূরগুলোর লেজ ছিল নীল রঙের মণি দিয়ে তৈরি। এক একটি বিরাট আকারের চুনি বসানো ছিল ময়ূরের বুকে। সেখান থেকে ৫০ ক্যারটের একটি হলুদ রঙের মুক্তা ঝুলে থাকতো। সিংহাসনটিতে ঠেস দিয়ে বসবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন দিকে অগণিত মণি-মুক্ত শোভা পেতো।
১৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে পারস্যের মহামান্য সম্রাট আব্বাস তৎকালীন ১ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি হীরা বাদশাহ জাহাঙ্গীর কে উপহার দেন। সম্রাট শাহজাহান এই হীরাটিকেও ময়ূর সিংহাসনে সংযোগ করেছিলেন। এই ময়ূর সিংহাসনের নির্মাণ ব্যয় নিয়ে দুটি তথ্য পাওয়া যায়।
সেকালে এটি নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ৮ কোটি টাকা। যা’ এই প্রবন্ধের গোড়াতেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে তৎকালীন ইউরোপীয় পর্যটক টাভেরনিয়া উল্লেখ করেছেন এই শিল্পম-িত বহুমূল্যের রতœখচিত সিংহাসনটি নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ৫ কোটি টাকার হীরা-মুক্তা-পান্না, ৯০ লক্ষ টাকার জহরত, ২০ লক্ষ টাকা মূল্যের ১ লক্ষ তোলা ওজনের স্বর্ণ। টাভেরনিয়ারের মতে সব মিলিয়ে সিংহাসনটির লম্বা ছিল ৪.৫ ফুট। চওড়া ছিল ৩.৫ ফুট। তবে বার্ণিয়ারের মতে তা’ ছিল ৬ ফুট। বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে টাভেরনিয়ারের মতকে সঠিক বলে মনে করেছেন। ২০ থেকে ২৫ ইঞ্চি উঁচুতে ছিল আসনটির বসার স্থান। মজার ব্যাপার হলো সম্রাট সিংহাসনে আরোহণ করার পরই মনে হতো, ময়ূর পেখম মেলে নাচতে শুরু করেছে। পেখমে বসানো রতœরাজি ভাগে ভাগে দেখা যেত। সিংহাসনের আশেপাশেই থাকতো একটি রাজদ-, তলোয়ার, একটি ঢাল, একটি ধনুক এবং কিছু তীর। প্রতিটি অস্ত্রই ছিল বহুমূল্যবান প্রস্তর দ্বারা নির্মিত। সিংহাসনের দুপাশে ছিল দুটি লাল ভেলভেটের ছাতা। ৮ থেকে ৯ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ছাতা দুটির ডাট ছিল হীরা ও মণিমুক্তা বসানো। এর ঝালরও ছিল মুক্তাখচিত। আরও একটি তথ্যে জানা যায় সিংহাসনটি লম্বায় ১০ ফুট, প্রস্থে ৭ ফুট এবং উচ্চতায় সর্বোচ্চ ১৫ ফুট ছিল। সম্রাট শাহজাহানের স্বর্ণনির্মিত ও নানা ধরনের মণি-মাণিক্য খচিত ময়ূর সিংহাসনে বিশ্বখ্যাত কোহিনূর হীরক খ-টি অপূর্ব দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য সম্রাট (বর্তমান ইরান) দুর্ধর্ষ নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন এবং নগরীর প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করে দিল্লির মোগলদের ধনভা-ার ও ময়ূর সিংহাসনসহ সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যান। কিন্তু নাদির শাহ পরবর্তীকালে দেখতে পান তার লুট করা সব ধন-সম্পদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত হীরক খ-টি অনুপস্থিত (কোহিনূর)। তৎক্ষণাৎ চারিদিকে তল্লাশি ও খোঁজাখুঁজির পর মোগল হেরেমের এক সুন্দরী রমনীর কাছে জানতে পারেন মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ তাঁর পাগড়ির ভেতরে কোহিনূর লুকিয়ে রেখেছেন। ধূর্ত নাদির শাহ এক জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মোহাম্মদ শাহকে দাওয়াত করেন এবং পরাজিত বাদশাহ হিসেবে তাঁকে তার পাগড়িটা বদল করতে বাধ্য করেন। মোগল বাদশাহ তাঁর পাগড়ি খোলার সঙ্গে সঙ্গে তৎক্ষণাৎ কোহিনূর বেরিয়ে এলে নাদির শাহ এটি দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে তার অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে কোহ-ই-নূর এই শব্দটি। এর প্রকৃত অর্থ হলো আলোর পাহাড়। সেই থেকে পরবর্তী কালে চোখ ধাঁধাঁনো এই রতœটির নাম হয় কোহিনূর।
ময়ূর সিংহাসনে সর্বমোট ১০৮টি বড় চুনি এবং ১২০টি মূল্যবান পান্না ছিল। অসংখ্য হীরা, মুক্তা, মোতিও ছিল। অত্যন্ত দক্ষতা ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছিল। স্বর্ণ কতটুকু ব্যবহার করা হয়েছিল, সে হিসাব কেউ আর রাখেনি। এতোসব দামি পাথরের উপস্থিতিতে স্বর্ণও হয়ে পড়তো নিষ্প্রভ।
ময়ূর সিংহাসনের যে সব তথ্য, বিবরণ এখন পাওয়া যায় তার সবই ইউরোপিয়ান বণিক, জহরত ব্যবসায়ীদের। মোগলরা তাদের এই অনবদ্য সৃষ্টির ছবি এঁকে রাখলেও কোনো লিখিত বিবরণ রেখে যায়নি। সম্রাট শাহজাহান নিজেও তাঁর পিতা জাহাঙ্গীর কিংবা পূর্বসূরী বাবরের মতো কোনো স্মৃতিকথা লিখে যাননি। সম্রাট আকবরের মতো তার দরবারে আবুল ফজলের মতো কোনো ইতিহাসবিদ ছিলেন না। ফলে তাঁর সৃষ্ট তাজমহল, ময়ূর সিংহাসন সহ অনেক শিল্পকর্ম সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।
ময়ূর সিংহাসনের শেষ পরিণয় অত্যন্ত রহস্যময়। দিল্লীর বাদশাহ আওরঙ্গজেব ১৭০৭ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হলে মোগলদের শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে এই মহামূল্যবান ময়ূর সিংহাসনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ভারতবর্ষ অভিযানকালে লুণ্ঠন করেন। দিল্লি থেকে ফিরে যাবার সময় তিনি বিখ্যাত কোহিনূর হীরা ও লুণ্ঠন করেন। এর অবর্ণনীয় সৌন্দর্যে পাগল-পারা হয়ে নাদির শাহ এটাকে নিয়ে যান নিজ দেশ পারস্যে। অনেকের মতে নাদির শাহ দিল্লিতে অবস্থানের সময় ময়ূর সিংহাসনের মতো আরেকটি সিংহাসন বানিয়েছিলেন। তবে যাওয়ার সময় তিনি দুটি সিংহাসনই নিয়ে যান নিজ দেশ পারস্যে। বলা হয়ে থাকে নাদির শাহ কোহিনূরকে নিজের কাছে অতি যতেœ রেখেছিলেন। পরবর্তীতে এই ময়ূর সিংহাসনও কোহিনূর হীরার জন্য তার প্রতিপক্ষের কাছে নিদারুণভাবে খুন হন তিনি। অনেক রাজার রাজত্বে হাত বদল হয়ে ময়ূর সিংহাসন কালের গর্ভে ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশ্বখ্যাত কোহিনূর হীরা ময়ূর সিংহাসনে বসানো ছিল। পরবর্তীতে বৃটিশের হাতে কোহিনূর হীরাটি চলে যায়। ইংরেজ আমলে মাঝে মাঝে গুজব উঠতো ময়ূর সিংহাসন টিকে আছে। লর্ড কার্জনের সময় প্রবল গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়, ইরানের শাহের খাজাঞ্চি খানায় ময়ূর সিংহাসন আজো অক্ষত অবস্থায় আছে। ইংরেজ শাসকদের তখন পৃথিবীতে দোর্দ- প্রতাপ। তারা খোঁজ লাগালো। কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেলোনা ময়ূর সিংহাসন। শেষে লর্ড কার্জন নিজে জানালেন, না’ এটি নেই। তবে গবেষকরা মনে করেন ময়ূর সিংহাসনের কোনো টুকরা থাকলে থাকতেও পারে।
ময়ূর সিংহাসন এখন আর নেই। তবে তার স্মৃতি এখনো জাগরুক। কবিতা, মহাকাব্য, গল্প, উপকথা ও গানে এখনো ময়ূর সিংহাসন একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এখনো রাজকীয়, জমকালো কোনো আসন কিংবা বড় মূল্যবান পদ বোঝাতে আমরা তখ্্ত্-ই-তাউস (ময়ূর সিংহাসন) বলে থাকি।
লেখক কলামিস্ট, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা