৩টি অণুগল্প
ভাগ করে দেওয়ার পর তারা যদি আমাদের কোনো দায়িত্ব না নেয় ? যদি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে? যদি বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে দেয়? রাহেলা বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদে।
Printed Edition

আবু নেসার শাহীন
নিয়ম
মাঝরাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফুরফুরে বাতাস বইছে। একটানা ঝিঝি ডাকছে। উঠোনে মোড়ার ওপর পাশাপাশি বসে আছে সুজা ইসলাম আর রাহেলা বেগম। সুজা ইসলাম হাই তুলতে তুলতে বলল, কি সিদ্ধান্ত নিলে?
দেখ সম্পত্তি তোমার, আমার সিদ্ধান্তে কি এসে যায়। তবে তোমার কথা শুনে খুব ভয় হচ্ছে। দিনকাল ভালো না। চারদিকে যা ঘটছে।
কিন্তু একদিন না একদিন তো ছেলে মেয়েদের সব ভাগ করে দিতে হবে।
ভাগ করে দেওয়ার পর তারা যদি আমাদের কোনো দায়িত্ব না নেয় ? যদি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে? যদি বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে দেয়? রাহেলা বেগম ফুঁপিয়ে কাঁদে।
কেঁদো না। আল্লাহ ভরসা। সুজা ইসলাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
দক্ষিণ পাড়ার সানু ভূঁইয়া ছেলে মেয়েদের সব ভাগ করে দেওয়ার পর এখন আর কেউ খবর নেয় না। শেষে বাধ্য হয়ে কনকাপৈত স্কুলে দফতরির কাজ নেয়। কিন্তু রাহেলা ব্যতিক্রম, ও তো আছে। সেটা ও একবার বল?
তোমার কথাও সত্য আমার কথাও সত্য। দেখ কি করবে? ভবিষ্যত আল্লাহ্র হাতে। কত কষ্ট করে তিল তিল করে সব কিছু গড়ে তুলেছি।
কিন্তু এরাতো তোমারই ছেলে মেয়ে।
হুঁ ঠিক বলেছো। একটা ছেলে বিদেশ থাকে ত্রিশ বছর। একটা ছেলে সারাদিন ঘরে থাকে। কোনো কাজ করে না। আরেক একটা ছেলে টুকটাক কাজ করে। আচ্ছা ওরা সম্পদ পেয়ে যদি সব বিক্রি করে দেয়।
দিলে দিবে। মন শক্ত কর। মনে পড়ে এক জোছনা রাতে উঠোনে বৈঠক বসে। তার বাবা গ্রাম শুদ্ধ লোকের সামনে ছেলে মেয়েদের সব ভাগ করে দেয়। বিদুৎ চমকায়। ঠান্ডা বাতাস বইছে।
চল ঘরে চল। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। তারও কিছুক্ষণ পর মুষল ধারে বৃষ্টি নামে। বাজ পড়ে। সুজা ইসলাম আর আর রাহেলা বেগম খাটের উপর চুপচাপ বসে থাকে। কারও মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ রাহেলা বেগম ডুকরে কেঁদে ওঠে।
বাস্তবতা মেনে নিতে শিখ। বয়স হয়েছে না ? হা হা হা ।
হাসছো কেন? রাহেলা বেগম চোখ মুছে। সে খুব অবাক হয়।
এই ভেবে হাসছি, এই ছেলের ঘরে পনেরো দিন আর ঐ ছেলের ঘরে পনের দিন খেতে হবে। খাওয়ার সময় হলে ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে কখন ডাকবে।
সব সহ্য করতে হবে সব। তাহলে কি সিদ্ধান্ত নিলে ?
আর একটু ভাবতে দাও। এখন ঘুমাও।
সুজা ইসলাম শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। নাক ডাকে। কিন্তু রাহেলা বেগমের ঘুম আসে না।
উত্তরাধিকার
গভীর রাত। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। রেখা চুলোয় ভাত বসিয়েছে। চুলোর অপর পাশে বসে আছে নিরু ও হিরা। হিরা নিরুর কানে কানে বলল, দেশি মুরগীর মাংস। সবে কপাল বুঝলি?
হুঁ। কিন্তু সেদ্ধ হতে এতো দেরি হচ্ছে কেন?
বুড়ো মুরগীর মাংস। হা হা হা।
হাসছিস যে।
মনে আছে —-। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয় নিরু। কাল মতি লালের বাগানে আম পাড়তে যাবি?
হুঁ যাবো। তোর মুরগীর মাংস খেতে কেমন লাগে?
ভালো। এ সময় তাদের পালা কুকুরটা আসে। খানিক দূরে পা গুটিয়ে বসে। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। রেখা বললেন, যা তোরা কলপাড়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আয়।
নিরু হিরা কল পাড়ের দিকে যায়।
সবাই খেতে বসে। এক পর্যায়ে নিরু কুকুরটাকে একটা হাড্ডি ছুঁড়ে দেয়। হিরা বলল, মা আব্বারে একটা ফোন দাও।
এখন তোর আব্বা কথা বলতে পারবো? এখন ট্রাক থেকে মাল নামাচ্ছে। ঠিক এ সময় মোবাইল বাজে। রেখা ওঠে মোবাইল রিসিভ করে, ভাবি মোকলেস ভাই এক্সিডেন্ট করছে। চাউলের বস্তা টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায়। ঘাড়ে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে।
ভাই এখন সে কোথায় আছে?
রেখা চিৎকার করে কাঁদে।
- এখন সে পঙ্গু হাসপাতালে আছে।
- আচ্ছা আমরা আসছি। নিরু ও হিরা কোন রকম খাওয়া শেষ করে। তারা দ্রুত হাসপাতালে এসে সবাই একসাথে কাঁদে।
- এখন কি হবে? কাজ না করলে খাব কী? মোকলেসের গলায় একরাশ হতাশা।
- তোমার জায়গায় আমি কাজ করবো। নিরু চোখ মুছতে মুছতে বলল।
- না না তোর লেখা পড়া আছে না। দরকার হলে আমি মানুষের বাসায় কাজ করবো। রেখা আর্তনাদ করে ওঠে।
- কাউরে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি এখন বড় হয়েছি মা।
- নিরু ঔষধ কিনতে বাইরে আসে। রাত শেষ হয়ে আসছে। একটু পর আযান পড়বে। এগারো ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। আর কি? বাকি জীবন বাবার মতো তার ও বস্তা টানতে হবে।
সেদিন আর এইদিন
লোকটার পোশাক আশাক দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। কদম আলী ব্যাপারী! তাও এই পোশাকে? সে কদম আলী ব্যাপারীর পথ আগলে দাঁড়ায়। কদম আলী তাকে এক নজর দেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে বলল, কদম ভাই আমি জহির। আমাকে চিনতে পারছেন?
- কদম আলী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। সে বলল, তো আপনার এই অবস্থা হল কী করে? আপনিতো প্লেনে চড়ে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন? অথচ আজ আপনার এ অবস্থা?
- সবই আমার কপাল। সমস্ত সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে চুটিয়ে ব্যবসা করছিলাম। কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেল। এক পর্যায়ে ব্যবসায় লস খেলাম। সমস্ত সম্পত্তি নিলামে তুলল ব্যাংক। অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই আমি রাস্তায় নেমে এলাম।
- আহা!
- আহা! বাংলাদেশে সকালে নাস্তা করি আর দুপুরের খাবার খাই ব্যাংককে গিয়ে। সব শেষ ।
- আপনার বৌ ছেলে মেয়েরা কোথায়?
- জানি না। কেউ আমার খোঁজ নেয় না। আমিও তাদের কোনো খবর রাখি না।
- তো চলে কি করে?
- মানুষের কাছে হাত পেতে খাই।
- ও! কদম আলী তাকে পাশ কেটে সামনে এগুতে থাকে। সেও দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটে।