ঐতিহ্য-চেতনা ও কবি ফররুখ আহমদ
বিরাট বৃক্ষকাণ্ডটি যেমন জমিনের ওপর টিকে থাকার প্রয়োজনে মাটির গভীরে শিকড় বিছিয়ে শুধুমাত্র মাটিকে আঁকড়িয়ে ধরে না, বরং দেহকে পুষ্ট ও নিজকে ফুলে ফলে সুশোভিত করার জন্য মাটির গভীর থেকে জীবন-রস সংগ্রহ করে।
Printed Edition

আহমদ মনসুর
বিরাট বৃক্ষকাণ্ডটি যেমন জমিনের ওপর টিকে থাকার প্রয়োজনে মাটির গভীরে শিকড় বিছিয়ে শুধুমাত্র মাটিকে আঁকড়িয়ে ধরে না, বরং দেহকে পুষ্ট ও নিজকে ফুলে ফলে সুশোভিত করার জন্য মাটির গভীর থেকে জীবন-রস সংগ্রহ করে। তেমনি সমাজ বৃক্ষও তার জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুগভীর তলদেশ থেকে জীবনীশক্তি আহরণ করে সমৃদ্ধশালী ও শক্তিমান হয়। কোন জাতি তার ঐতিহ্য চেতনা বিস্মৃত হলে ধীরে ধীরে স্বকীয় সত্তা ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে নিজ অস্তিত্ব লোপ করে বসে। জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা জাতির জাগরণ ও পুনর্গঠনের জন্য অপরিহার্য উপাদান। জাতীয় ঐতিহ্যের উপাদানসমূহকে যে সব কবি সাহিত্যিক তাঁদের সাহিত্যের সামগ্রী হিসেবে বেছে নেন তাদের সৃষ্টিকর্ম সুন্দর ও কালোত্তীর্ণ হয়। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চেতনা-নির্ভর সার্থক শিল্পী স্রষ্টাদের ইমাম বলতে কবি ফররুখ আহমদকে বুঝায়।
কবি ফররুখ ছিলেন কবি নজরুল ইসলামের উত্তরসূরি। নজরুল ইসলাম মুসলমানদের অতীতের গৌরবময় অধ্যায় থেকে নতুন যুগের অগ্রযাত্রার পাঠ নিয়ে আত্মসম্বিৎহারা জাতিকে নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছেন তাঁর কবিতা ও গানে। রাবীন্দ্রিক বলয় ভেদ করে ‘আয়রে আয় ধুমকেতু’ গান গেয়ে মুসলিম ঐতিহ্য, ইসলামী আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের কামনায় রচনা করেন দৃঢ় ভিত্তিভূমি। এই ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে মুসলিম ঐতিহ্যের রূপায়ণে যিনি সর্বাধিক সার্থকতা ও সফলতা অর্জন করেছেন তিনি ফররুখ আহমদ। কবি তাঁর ঐতিহ্য বোধ ও সৃজনী শক্তির সাথে গভীরতর বিশ্বাসের সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রগাঢ় ধর্মীয় চেতনাবোধ কবি হৃদয়কে উজ্জীবিত করেছিল বিধায় তাঁর সাহিত্যের মাঝে ধর্মীয় ঐতিহ্য চেতনা লীন হয়েছিল। কবি তাঁর কবিতার বক্তব্যে, ইতিহাসের ইঙ্গিতে, শব্দ চয়নে, উপমা ও চিত্রকল্পে রেখেছেন আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্যের নুরানী পরশ। যেমনঃ-
“ তোমরা এনেছো জ্যোছনা -ভেজানো স্বপ্ন-সবুজ শাখে
গভীর রাতের গূঢ় মোরাকাবা বন- ডাহুকীর ডাকে,
কোথা নলবনে চৌচির হয়ে বাঁশী যেতে চায় ফেটে,
কোথা জোলায়খা দেখায় মাশুক চাঁপার আঙ্গুল কেটে।
কোথা মজনুর বিরহী হৃদয়ে আকাশের নীরবতা
কোন ঝরোকায় শাহেরজাদীর ঘুম ভাঙ্গা রূপকতা,
নিশীত রাতের ঘনায়িত ব্যথা কোথা লাইলির প্রাণে,
মৌসুমী হাওয়া বলে গেছে বুঝি তোমাদের কানে কানে।
তোমাদের সুরে শুনেছি আমরা পথ চলবার বাঁশী
রুদ্ধ কপাটে যেখানে ঝঞ্ঝা বেজেছে সর্বনাশী।
ম্লান জড়তার জড়বাদ-বাঁধ ভাঙ্গে তোমাদের হাতে
গোলাব কলির ফুটবার খোঁজ দাও অমাবশ্যাতে
বন্ধু! তোমরা এনোছো দরদ উমরের বুক হতে
কল্পলোকের আকাশ ছেড়েও নেমেছো ধূলির স্রোতে।
দুর্গত জনগণের সঙ্গে বেঁটে নাও ব্যথা বিষ,
মরু ওয়েসিসে জাগাও তোমরা দোয়েলের মিঠে শিস্”
[ দল-বাঁধা বুলবুলি, মাসিক মোহাম্মদী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫০]
ফররুখের ইতিহাস চেতনা তাঁর কাব্যধারাকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। তুলনামূলক অতীত চেতনা ও আধুনিক ইতিহাস বোধ তাঁর রচনায় স্থায়ী কাব্যিক ও নান্দনিক সৌন্দর্য সঞ্চার করেছে। ইসলামের ধর্মীয় পুনর্জাগরণ এবং ঈমানের ভিত্তিতে মানব জীবনের পুনর্গঠনের আকাক্সক্ষা বিজড়িত সৌন্দর্যদীপ্ত সাধনা কবিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছে। কবির শিল্পে তাই হেরার রাজতোরণ উজ্জ্বল হয়ে চিত্রিত হয়ে মুসলিম ঐতিহ্য ও জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করার আহ্বান জানিয়েছে। কবি কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-
‘এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ -তোরণ,
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠেছে কেঁপে,
এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দু’চোখ ছেপে
তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ- তোরণ.. ,
কাঁকর বিছানো পথ,
কত বাধা, কত সমুদ্র পর্বত
মধ্যদিনের পিশাচের হামাগুড়ি
শকুনি ফেলেছে ছায়া আমাদের মাথার উপরে উড়ি,
ফেলেছি হারায়ে তৃণঘন বন, যত পুষ্পিত বন,’
তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ -তোরণ.. ,
(সাত সাগরের মাঝি।)
ইসলামী জীবনবোধের উপর গভীর বিশ্বাস, ধর্ম জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ, সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ, অনমনীয় ও অচঞ্চল ঐতিহ্য চেতনা কবিকে পৃথক মর্যাদা প্রদান করেছে। “কবি হিসাবে তিনিও বিশিষ্টতা ও খ্যাতি অর্জন করেছেন ইসলামের ইতিহাস চেতনা ও মুসলিম জীবনাদর্শ মূলক সাহিত্যের ঐতিহ্য প্রীতির জন্যে। তাঁর শব্দানুশীলন, বাক্য বিন্যাস ও ভাষা ব্যবহারের রীতিতে ইসলামের অতীত যুগের চিত্র ও আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। এ -যুগে মুসলিম জীবন ও মানসের অদর্শ বিচ্যুতির জন্য কবি বেদনা বোধ করেন। সংস্কারধর্মী মনের আশ্চর্য প্রতিফলন রয়েছে তাঁর শব্দ চয়ন ও কুশলতায়।” [মুহম্মদ আবদুল হাই, ভাষা ও সাহিত্য] যেমন-
তবু ভাঙলো কি ঘুম, ঘুম ভাঙলো কি,
ঘুম ভাঙলো এ- অন্ধদের?
আজ বিস্মৃতি তোলে যে আড়াল
তোমার দিনের এই দিনের।
এখানে যে ম্লান কদর্যতায় ছবি আর ক্ষুধা যায় কি সেথা,
গড়ায় বিপুল অজগর তার লেলিহান ক্ষুধা
বিপুল ব্যথা,
আকাশে আকাশে তারই বিষাক্ত
প্রশ্বাসে হেরি মূর্চ্ছাতুর
আলো বিহঙ্গ ভোলে হে সূর্য
তোমার শেখানো পথের সুর।
[ সিরাজাম মুনিরা]
কবি ফররুখ আহমদ মুসলিম ঐতিহ্যকে কাব্যায়বে রূপান্তরিত করতে গিয়ে পুঁথিসাহিত্যের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। কবি তাঁর অসামান্য প্রতিভা ও অসীম সৃজন ক্ষমতার বদৌলতে পুঁথি সাহিত্যকে কেন্দ্র করে শিল্প, সার্থক সাহিত্য রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ‘হাতেম তা’য়ী’ ও ‘নৌফেল ও হাতেম’ নতুন প্রতীক ও রূপকার্থ লাভ করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করেছে। কবির এ কাব্যদ্বয়ে মানুষের জীবনের সফলতার চাবিকাঠি কোথায় তার সন্ধান দিয়েছেন। তিনি এ কাব্য দুটিতে জীবন সমস্যার বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধান দিয়ে জানিয়ে গেলেন যে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রয়োজন আল্লাহর সাহায্য। যেমন-
‘এলাহির রেজামন্দি চেয়ে
যে হয় খিদমতগার মানুষের কিম্বা মখলুকের
হয় না সে কোন দিন খ্যাতির পূজারী। যে মুমিন
মুজাহিদ, বিশ্বাসী যে, হয় না সে আনত কখনো,
হয় না সে নত শির আল্লা ছাড়া অন্য কারো কাছে।
(নৌফেল ও হাতেম)
কে দরিদ্র? এ প্রশ্নের জওয়াব দিতে তিনি লিখেছেন-
যশের কাঙাল হয়ে কে পেয়েছে যশ পৃথিবীতে ?
যে ত্যাগী অথবা কর্মী খ্যাতি আসে তার পিছে পিছে
অচ্ছেদ্য ছায়ার মতো সাফল্যের সাথে। কিন্তু যার
নির্লজ্জ কাঙাল -পনা খ্যাতির দুয়ারে, - দরিদ্র সে
চিরকাল মরে শুধু মিসকিনের হালে। ’
(নৌফেল ও হাতেম)
জীবনের সফলতা অর্জনের পথের সন্ধান দিতে কবি লিখেছেন-
‘আশ্চর্য রহস্যময় মানুষের প্রথম যৌবন,
সামর্থ্যরে অধিকারী নেমে যেতে পারে সে সহজে
কামনার নি¤œাবর্তে পাশবিক প্রবৃত্তির ভোজে,
কিম্বা পারে উঠে যেতে ঊর্ধ্ব স্তরে, ঊর্ধ্বে ফেরেস্তার
সমস্ত সৃষ্টির মাঝে দীপ্ত যেন কুতুব তারার
রোশনি যে অমলিন। ’
(হাতেম তা‘য়ী)
কবি আর এক যায়গায় জীবনের সফলতা কোথায় প্রসঙ্গে হাতেমের মুখে বলেছেন-
‘হায়াত -মওত এ দু’য়ের মাঝে অন্তবিহীন পথ
জানি না কি ভয়ে সহসা এখানে নিভে যায় হিম্মৎ!
অগ্রবর্তী চলে গেছে যারা -সত্যের রাহাগির,
তাদের দেখানো পথে যেতে চাই জেহাদে জিন্দেগীর,
আর আমি চাই প্রতিজ্ঞা সেই শিলা -সুকঠোর পণ;
মৃত্যুর আগে যেন এই বুকে জেগে থাকে সারাক্ষণ।
চলেছি এ ভাবে প্রাণপণে করে খিদমত মানুষের,
ইনসানিয়ৎ চাই শুধু আমি -পূর্ণতা এ প্রাণের।
(হাতেম তা‘য়ী)
কবি ইসলামের মহান খলিফা ও কীর্তিমান পুরুষদের সংগ্রামী জীবন ও আদর্শ নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘সিরাজাম মুনিরা’ কাব্যগ্রন্থ। এর প্রতিটি শব্দে বেখেয়াল জাতির অচেতন হৃদয়পটে আঘাত হেনে নতুন উদ্দীপনায় জাগিয়ে তোলে।
কবি তাঁর জীবনাভূতির নির্যাস দিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘সাত সাগরের মাঝি।’ ফররুখ তাঁর জীবনাদর্শ ও ঐতিহ্যবোধের মিশ্রণে এমন এক বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটিয়েছেন যিনি ঘুমন্ত জাতিকে নতুন মূল্যবোধ ও জীবনাদর্শের মজবুত ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। কবি মুসলিম জাতিকে আবার আশ্বাসের বানী শুনিয়েছেন এ কাব্যে। তিনি লিখেছেন-
‘তুমি দেখছো না, এরা চলে কোন আলেয়ার পিছে পিছে
চলে ক্রমাগত পথ ছেড়ে আরো নীচে।
হে মাঝি! তোমার সেতারা নেভেনি এ -কথা জানো তো তুমি,
তোমার চাঁদনি রাতের স্বপ্ন দেখছে এ মরুভূমি,
দেখ জমা হ’ল লালা, রায়হান তোমার দিগন্তরে ;
তবু কেন তুমি ভয় পাও, কেন কাঁপো অজ্ঞাত ডরে।’
(সাত সাগরের মাঝি)
কবি ফররুখের জীবনে ধ্যান ধারণা এবং জীবন ও বিশ্বাসের সমন্বিত সার্থক রূপায়ন ঘটেছিল। ফলে তাঁর কবিতায় এল নতুন ছন্দ, ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে সৌন্দর্য মহিমা। এ ব্যাপারে কবি জীবনকে অধিক প্রভাবান্বিত করেছিল পশ্চিমে জাগা কবি ইকবাল। ফররুখ কবি ইকবালের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরই আচরিত মানবিক আদর্শের পরম প্রিয়কে। কবি ফররুখের কাব্যধারায় আশ্রয় পেয়েছিল নজরুলের আবেগ, ইকবালের দার্শনিক চিন্তা। এ দু’য়ের সাথে তাঁর নিজস্ব চিন্তা অনুভূতি ও ইসলামের মূল্যবোধ শিল্পের অনুরাগে মিশ্রিত হয়ে তাঁর রচনাকে করেছে পবিত্র ও সৌরভময়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক