DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

আল মাহমুদের ছোটগল্পে মুসলমানদের জীবনযাত্রা ও সমকালীন সমাজ

আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান ছোট গল্পকার। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যেই তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন। এজন্য তাঁর ছোটগল্পে আবহমান বাংলার রূপ-রস-গন্ধ ও গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে। গ্রাম বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি, নদ-নদী, পাখ-পাখালি আর নর-নারীর প্রাত্যহিক মনোজগত থেকে শুরু করে মানবজীবনের নিগূঢ় রহস্যের অনুসন্ধানে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্পে সমাজ ও জীবনের রূপায়ণ, ব্যক্তির অন্তর্বেদনা, নর-নারীর প্রেম-ভালবাসা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ ও প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবন চাঞ্চল্যকে তিনি ছোটগল্পে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

Printed Edition
Al-mamuad

ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান

আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান ছোট গল্পকার। গ্রামীণ মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যেই তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন। এজন্য তাঁর ছোটগল্পে আবহমান বাংলার রূপ-রস-গন্ধ ও গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে। গ্রাম বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি, নদ-নদী, পাখ-পাখালি আর নর-নারীর প্রাত্যহিক মনোজগত থেকে শুরু করে মানবজীবনের নিগূঢ় রহস্যের অনুসন্ধানে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্পে সমাজ ও জীবনের রূপায়ণ, ব্যক্তির অন্তর্বেদনা, নর-নারীর প্রেম-ভালবাসা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ ও প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবন চাঞ্চল্যকে তিনি ছোটগল্পে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর ছোটগল্পে গ্রামীণ সমাজের চিত্র যেমন নিখুঁত তেমনি মানুষের মনোজাগতিক ভাবনায়ও রয়েছে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। তিনি ছোটগল্পে যেভাবে বিষয় ও প্রকরণশৈলীর নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তাতে কখনো কখনো তাঁর কবি খ্যাতিকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাকরে। আল মাহমুদের ছোটগল্প সম্পর্কে প্রখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদ্ যথার্থই বলেছেন- ‘বাংলাদেশে আল মাহমুদের সমতুল্য অন্য কোনো কবির হাত থেকে এত কয়টা ভাল গল্প বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটা তাঁর সাহিত্যিক গুরুত্বে এক ঈর্ষণীয় মাত্রা যোগ করবে বলে আমার বিশ্বাস।’

বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারায় বক্তব্য পরিবেশন ও প্রকরণশৈলীর নান্দনিকতায় আল মাহমুদের গল্প স্বতন্ত্র। তাঁর ছোটগল্পে মানব জীবন অত্যন্ত নিখুঁত ও শৈল্পিকভাবেই বিকাশ লাভ করেছে। ‘মানব সত্তার অন্তঃবিশ্লেষণের বাইরে বাংলাদেশের জীবন ও পারিপার্শ্বকে তীক্ষè ও সূক্ষ্মভাবে আল মাহমুদ তাঁর ছোটগল্পে তুলে ধরেছেন।’ নর-নারীর যৌন জীবনের নানামাত্রিক বর্ণনা আল মাহমুদের ছোটগল্পে বিশেষভাবে ব্যঞ্জিত হয়েছে। তিনি ছোটগল্পে প্রধানত চলমান জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, লোভ-লালসা, নানা ঘটনা ও বিষয়ের উপস্থাপনায় আধুনিক বাস্তববাদী শিল্পচেতনাকে আশ্রয় করেছেন।

আল মাহমুদের সাহিত্য-জীবন সুদীর্ঘ ষাট বছরের। জীবনের উত্থান-পতন, রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, আদর্শিক চেতনা ইত্যাদি বিষয়ের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্য মানস। ‘মানব জাতির ইতিহাস, প্রেম ও স্বজাত্যবোধ, মাটি ও মানুষের নিবিড়তা, সত্য-মিথ্যার মোড়ক, চাতুরি ও স্পষ্টতা বিশেষ প্রহরে আল মাহমুদের কথাশিল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। আর কাঠামোতে থাকে পর্যবেক্ষণ-পরিবর্তন প্রবণতা এবং প্রাতিস্বিকতা প্রতিষ্ঠার বলয়।’ আল মাহমুদের দুটি গল্পসমগ্রে মোট ৬৭ টি গল্প রয়েছে প্রতিটি গল্পেই গল্পকার কাহিনি বিন্যাস ও চরিত্র চিত্রণে মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তবে এর মধ্যে যে গল্পগুলো অত্যাধিক খ্যাতি অর্জন করেছে সেগুলো- ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘কালোনৌকা’, ‘রোকনের স্বপ্নদোলা’, ‘জলবেশ্যা’, ‘বুনোবৃষ্টির প্ররোচনা’, মাংসের তোরণ, ‘একটি চুম্বনের জন্য প্রার্থনা’, ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’, ‘ময়ূরীর মুখ’, ‘ভেজা কাফন’, ‘মীরবাড়ির কুরসিনামা’, ‘নফস’ প্রভৃতি। আল মাহমুদের ‘কালোনৌকা’ গল্পটি ‘এশিয়া ওশেনিয়া’ নামের একটি বিদেশী সংকলনে অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার গল্পকারদের মধ্যে একমাত্র আল মাহমুদের গল্প এ সংকলনে গৃহীত হয়েছে ফলে তিনি কথা সাহিত্যজগতে বেশ প্রশংসিত হন। আল মাহমুদের গদ্যভঙ্গির প্রশংসা করে পল্লী কবি জসীমউদ্দীন এক চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন- ‘একটি কথা তোমাকে বলবো, তোমার গদ্য লেখার বেশ ভালো ক্ষমতা। এদিকটা যদি আরও অনেকখানি প্রসারিত কর...।’

আল মাহমুদ এ পর্যন্ত অনেক সার্থক গল্প রচনা করেছেন। বিষয়-বৈচিত্র্য, ভাষাশৈলী এবং চরিত্র চিত্রণের দিক থেকে তাঁর গল্প অনন্য। একজন যথার্থ কথাশিল্পীর যাবতীয় বৈশিষ্ট্য আল মাহমুদের মধ্যে বিরাজমান। ‘তার গল্পের বিষয় ফাঁকা ফানুসের উপর গড়ে ওঠেনি। তিনি তাঁর গল্পের জন্য এমন কোনো বিষয় নির্বাচন করেননি যার স্থায়িত্ব কম। তাঁর গল্পে শুধু আধুনিক নর-নারীর এক ধরনের জলোপানসে হৃদয় দৌর্বল্যের বার্তা বহন করে না। তিনি মানব জীবনের সমস্যা ও তাঁর গূঢ় রহস্যকে তাঁর গল্পে বলিষ্ঠভাবে রূপায়ণ করেছেন।’৫ যখন তিনি গল্প লেখেন তখন এক বাক্যে এদেশের রসজ্ঞ পাঠকগণ তাঁর কলাকৌশলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আবার তাঁর কাব্যের পাঠকগণ নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন, তিনিই আমাদের সবচেয়ে মৌলিক কবি। তাঁর প্রতিটি গল্পই পাঠককে মানসিক পরিতৃপ্তির যোগান দেয়। তাঁর গল্পে জীবনের লাবণ্য ও নিষ্ঠুরতা, নর-নারীর প্রেম, যৌনতা অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। ‘নদী, প্রান্তর, পর্বত, মরুভূমি যেখানেই এই কবি কথাশিল্পীর পদচারণা ঘটেছে সেখান থেকেই তিনি তুলে এনেছেন বন্ধুত্ব ও মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতার কাহিনি।’৬ তিনি শুধু নর-নারীকেই তাঁর গল্পে কেন্দ্রীভূত করেননি, মানব জীবনের বহুবিধ সমস্যা, ক্রিয়াকলাপ ও তার গূঢ় রহস্যকে শৈল্পিক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেছেন। আর এ জন্যই বাংলা ছোটগল্পের ধারায় আল মাহমুদের অবস্থান সুদৃঢ়।

আল মাহমুদের লেখায় প্রথম জীবনে মাক্র্সবাদী চেতনার বিকাশ ঘটলেও পরবর্তীকালে তিনি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ইসলামি জীবনধারা বা মুসলমানের জীবন-যাত্রা ও বিশ্বাসকেন্দ্রিক চিন্তাধারা তাঁর গল্পের মধ্যে পরিস্ফুটিত হতে দেখা যায়। ইসলাম তথা মুসলমানদের জীবন-যাত্রা ও বিশ্বাস কেন্দ্রিক গল্পের মধ্যে অন্যতম- ‘একটি চুম্বনের জন্য প্রার্থনা’ ও ‘নফ্স’।

‘একটি চুম্বনের জন্য প্রার্থনা’ গল্পে বর্ণিত হয়েছে অধ্যাত্মচেতনাতাড়িত একটি স্বপ্নলোকের কথা। মানুষ কি চায় তা সে নিজেই জানে? সমস্ত জীবন জুড়ে উন্মাদ ভোগ বাসনা, ফূর্তি, মদ, নারী লালসা; অথচ তার মাঝখানে বাস করে এক নিঃসঙ্গতা। ‘আবে জমজমের উৎপত্তি, সাফা মারওয়ার প্রাণান্ত দৌড়, তারপর মুহূর্তের জন্য আর্ত পিপাসার্ত আত্মার মগ্নতায় অপ্রাপ্য অসম্ভব এক সুন্দর চুম্বন হাজরে আসওয়াদে।’ সেখানে বাংলাদেশের একজন কবি পবিত্র কাবাগৃহে প্রোথিত একটি কৃষ্ণবর্ণ (হাজরে আস্ওয়াদ) পাথরের স্পর্শ লাভের আশায় উদগ্রীব হয়েছেন :

... তাওয়াফকারী মানুষের ¯্রােত ঘুরছে। প্রদক্ষিণের বেগ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। আমার মনে সেই সুপ্ত বাসনা, যে বাসনা পূরণ করার জন্য আমি, আমার এখানে উপস্থিতির প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত এই পবিত্র গৃহের আশে পাশে ঘোরাফেরা করছি, প্রবলভাবে জেগে উঠলো। ইচ্ছাটি আর কিছু নয়। কাবার এককোণে দেয়ালের গায়ে বসানো হাজরে আসওয়াদ নামের কালো পাথরটিকে একটি মাত্র চুম্বন আমার কম্পিত ঠোঁটের একটু স্পর্শ দেয়া। হযরত ইব্রাহীমের (আ.) স্মৃতি বিজড়িত এই পাথর। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর হাতের স্পর্শের ও চুম্বনের কাহিনীতে আপ্লুত এই পাথর। আর যুগ যুগ ধরে কত অযুত পুণ্যবান মানুষের চুম্বনস্পর্শে ধন্য এই প্রস্তরখ-ে আমি কি একমুহূর্তের জন্য একবার ঠোঁট ছোঁয়াতে পারব না?

‘একটি চুম্বনের জন্য প্রার্থনা’ গল্পটি মূলত কোনো ধর্মীয় বিবৃতি নয়। অসাধারণ একটি বিষয় নিয়ে লেখা আন্তর্জাতিক আবহ তৈরি করার জন্য গল্পটি দিক থেকে দিগন্তে চলে যাচ্ছে। গল্পটিতে ব্যবসা বাণিজ্যের কথাও উঠে এসেছে। সব মিলিয়ে গল্পটিতে একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। এটা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে নতুন ধরনের গল্প। গল্পের মধ্যে গল্পকার অনেক ধর্মীয় ভাবনাও তুলে ধরেছেন। মূলত এ গল্পে কবির অধ্যাত্মতৃষ্ণার আত্মিক পরিতৃপ্তি ও আবেগকম্পিত অন্তরবাসনা পূর্ণতা পেয়েছে, ফলে গল্পটি হয়েছে শিল্পসফল।

‘নফ্স’ আল মাহমুদের সেরা গল্পের একটি। এ গল্পে পির-ফকিরদের জীবন চিত্র যেমন এসেছে তেমনি আধ্যাত্মিক চেতনার আলোকে মানব প্রেমের বিষয়টিও অত্যন্ত নিপুণভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। ‘নফ্স’ গল্পটির শুরুটা সাধারণ হলেও ভেতরে রয়েছে লোমহর্ষক এক কাহিনি, যার ভেতরে রয়েছে রহস্য উদ্ঘাটনের তীব্র আকাক্সক্ষা। পির ফকিরদের ওপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে রচিত এ গল্পটি। গল্পে হঠাৎ করে আবির্ভাব হয় এক কামেল পিরের। এ ধরণের কামেল পিরের ওপর অগাধ বিশ্বাসের কারণে দরবেশ বাড়ির আলী মিয়া-জোবেদা দম্পতির মাঝে জন্ম এক ধরনের উৎকণ্ঠা। পিরের থাকা-খাওয়া-পরা নিয়ে ব্যস্ততা লক্ষ করা যায় এখানে। তাদের বিশ্বাসকে আরও জোরালো করে তাদের সন্তানহীনতা। দরবেশের দোয়াতে তাদের কোল জুড়িয়ে আসে গুলবদন। এই গুলবদনের মাঝে অসম্ভব এক আকর্ষণ বোধ করে আদম আলী নামের এক মুরীদ। স্বপ্নের মাঝে আদম আলী গুলবদন রূপী আতশী পরীর খপ্পরে পড়ে বিপদে পড়ে। আর গল্পের সার্থকতা এখানেই পরিলক্ষিত হয়। আদম আলীর বিপদই তার ভাল লাগার প্রচ- আবেগ উগরে দেয় গুলবদনের সম্মুখে।

‘‘নফ্স’ একটি ‘ইসলামিক টার্ম। যার দু’রকম অর্থ করা যায়- আত্মা, অহং অথবা ভোগ বাসনা। গল্পের কাহিনিটি দু’রকম অর্থের ব্যঞ্জনাই বহন করে।’ একদিকে সিদ্ধিপ্রাপ্ত ফকিরের অহংদীপ্ত আমিত্বের প্রকাশ, সাধনায় যিনি আলী মিয়ার নিঃসন্তান স্ত্রী জোবেদার গর্ভে গুলবদনের জন্ম সম্ভব করেন অন্যদিকে সেই ফকিরের ওরশ উপলক্ষে তার মাজার জিয়ারত করতে এসে দেখা গেল :

এক বৈষ্ণবী হয়ত এমন এক তরুণ ফকিরের মারফতী শুনে মজে যায় যে অনায়াস ভঙ্গিতে গায়কের বিশ্রাম বা সিদ্ধি টানার এক ফাঁকে কাছে এগিয়ে গিয়ে গা ঘেঁষে বসে। বলে, এমন এক দরাজ গলায় আমারে কয়েকদিন ঝুলাইবার পারো না ফকিরের পো? তোমার মুর্শিদের দোহাই।

তরুণ ফকিরের প্রতি বৈষ্ণবীর দেহ মনের এই যে আকর্ষণ তাকে বলা যায় কামনা বা ভোগাকাক্সক্ষা। আল মাহমুদ এ গল্পের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি শিল্পপ্রেরণার সহায়ক লিবিডো প্রবৃত্তিকে মানব জীবনের মধ্য দিয়ে কাহিনির গল্পরূপ দিয়েছেন। ‘নফ্স’ আল মাহমুদের তথা বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম ব্যতিক্রমধর্মী গল্প। বাস্তবতা ও অতিবাস্তবতার মিশ্রণে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম গল্প খুবই কম চোখে পড়ে। ‘নফ্স’ গল্প সম্পর্কে গল্পকার নিজেই বলেছেন :

‘নফ্স’ আমার একটা খুব জটিল গল্প, সহসাই এখানে অবাস্তব চরিত্র টেনে এনেছি বলেই নয়। ... আমি জানি না এ ধরনের গল্প আর বাংলা সাহিত্যে আছে কিনা। হয়তো থাকতে পারে। তবে আমি এখনো দেখিনি। এই ধরনের গল্প লেখার অনুপ্রেরণা পাই কাঁদো নদী কাঁদো-র শ্রদ্ধেয় লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কাছ থেকে। ... ‘নফ্স’ আমার শুধু ভালো গল্পই না, আমাদের দেশের লিখিত গদ্যসাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে জটিলতম গল্প, এটা আমি মনে করি। আরেকবার চেষ্টা করলেও আমি এই ধরনের গল্প লিখতে পারব কিনা সন্দেহ।

আল মাহমুদ সমাজ জীবনের অন্যতম রূপকার। সমাজ জীবনের নিত্য-নৈমিত্তিক সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সামাজিক অসঙ্গতি তাঁর গল্পে একটা বিরাট জায়গা দখল করে আছে। মানব জীবনের প্রাত্যহিক সমস্যাগুলোকে তিনি গল্পের ক্যানভাসে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যা আমাদের নিজস্ব পরিবার কাঠামোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। তিনি সমাজ জীবনের টুকরো টুকরো অসঙ্গতিগুলোকে শিল্পরূপ দিয়েছেন সার্থকভাবে। তাঁর সমাজ সমস্যামূলক ছোটগল্পগুলো হলোÑ ‘নীল নাকফুল’, ‘পশর নদী গাঙচিল’, ‘রুহানীর রুদ্ধশ্বাস’, ‘একপলক’ ‘মৃগয়া’, ‘নেশাগ্রস্ত নদীর সতীন’, ‘রাগ যন্ত্রণা’, ‘নিশিন্দা নারী’ ও ‘তৃতীয় এক নদী’।

‘নীল নাকফুল’ গল্পে দিনমজুর ওসমানের দীর্ঘনিঃশ্বাসের ইতিকথার প্রতিচ্ছবি মূর্ত হয়েছে। হতদরিদ্র ওসমান অন্যের আশ্রয়ে আশ্রিত। সমাজের জোতদার, মাতবর শ্রেণি তার আশা-আকাক্সক্ষা এবং স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দেয়। সে কাবিনবিহীন বিয়ে সম্পন্ন করেছিল। নিজের সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত নিচু হওয়ায় ওসমান নিজের বিয়ের কথা সমাজের কাছে স্বীকার করতে পারেনি। সে ছিল শক্তিশালী ও কর্মঠ পুরুষ। সে দিনমজুরদের সর্দার। লেখক তাঁর পরিচয় প্রসঙ্গে বলেন :

পড়ন্ত সূর্যের অন্ধকার মিশ্রিত লাল আভায় ওসমানের দৈহিক দৈর্ঘ্যকে আমার কাছে বেশি দীর্ঘকার বলে মনে হতে লাগল। পেছনের ভেজা বালুময় বিস্তৃত তীরভূমির ওপর তার পায়ের ছাপ এমনভাবে আঁকা হয়ে যাচ্ছে, দেখলে মনে হয় একজন ভারী মানুষকে বহন করার চিহ্ন রাখার জন্য ধরণী যেন বেশ একটু নমনীয় হয়েই আছে।

গত মৌসুমে ওসমান খাটিঙ্গা গ্রামের বানেছা নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে। বানেছা খাটিঙ্গার জমিদার হাশেম আলীর বাড়িতে কিষাণীর কাজ করতো। সেই পরিচয়েই ওসমানের সঙ্গে বানেছার ঘনিষ্ঠতা এবং বিয়ে। কিন্তু তাদের বিয়ের কথা কেউ জানত না। বানেছা দরিদ্র হলেও যথেষ্ট সুন্দরী ছিল। এ মৌসুমে ওসমান যখন খাটিঙ্গায় ধানের কাজ করতে আসে তখন বানেছার জন্য একটি সুন্দর নীল নাকফুল নিয়ে আসে। তার ইচ্ছা ছিলো এবার বানেছাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আশুগঞ্জে নিয়ে আসবে। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি- সে এখন জোতদার হাশেম খানের দ্বিতীয় স্ত্রী।

‘নীল নাকফুল’ গল্পে লেখক জমিদার হাশেম খানের লিবিডো রূপ তুলে ধরেছেন। বানেছা আজ ওসমানের সামনে থাকার পরও সে সমাজের কাছে নিজের বিয়ের কথা স্বীকার করতে পারে না। শুধু তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস। লেখকের ভাষায়- ‘কোন জোতদার পরিবারের গৃহবধূর দিকে সোজাসুজি দৃষ্টিতে তাকাতে পারা সোজা কথা নয় কোনো ভূমিহীন চাষির।।’ ‘নীল নাকফুল’ গল্পে লেখক ওসমানের যন্ত্রণালব্ধ জীবনের মধ্যে দিয়ে সমাজের নিষ্পোষিত, অসহায় দারিদ্র্যক্লিষ্ট- ভূমিহীন দিনমজুরদের অন্তরের ব্যথা-বেদনাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন। ভাব-ভাষা এবং উপমার যথাযথ প্রয়োগে ‘নীল নাকফুল’ গল্পটি হয়েছে শিল্পসফল। উল্লেখ্য, ‘নীল রঙ’ শোক বা বেদনার প্রতীক। ‘নীল নাকফুল’ ছোটগল্পে নায়কের বেদনায় প্রকটিত হয়েছে।

‘পশর নদী গাঙচিল’ গল্পে গল্পকার সুন্দরবন সংলগ্ন পশর নদীর কোল ঘেষে বেড়ে ওঠা চৌদ্দ বছরের কিশোরী কর্পূর ও পনেরো-ষোল বছরের রতনের জীবন-জীবিকার নিদারুণ এক বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছেন। লেখক সুন্দরবনের বিচিত্র রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :

নদীর ওপারেই সুন্দরবন। মংলা থেকে নদী বেয়ে একটু এগুলেই শুরু হয়েছে গাছ-পাছালি আর শিকড়-বাকড়ের রাজত্ব। ঢেউয়ের শব্দ আর অসংখ্য পাখির কোলাহলের মধ্যে জেগে উঠছে সেই আবছা অন্ধকারের অরণ্য। হরিণগুলোর বিদঘুটে ডাক, হাওয়া সুন্দরী গাছ আর কেওড়া ঝোপের সরসরাণিতে মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত চাপা গোঙানিতে পরিণত হচ্ছে। এর ওপর দিয়ে বইছে পশর নদীর নোনা হাওয়া। সম্ভবত এই বাতাস গাঙচিলগুলোর সুন্দর গোল-গোল চোখেও জ্বালা ধরায়।

লেখক এই বিচিত্র অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। জীবিকার প্রয়োজনে দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে ছন্নছাড়া জীবন অতিবাহিত করে কর্পূর এবং রতন। গল্পে দেখা যায় গাঙ পাহারাওয়ালা আর বাদাবনের মনুষ্যরূপী

আল মাহমুদের ছোটগল্পে মুসলমানদের জীবন-যাত্রা ও সমকালীন সমাজ

জানোয়ারের হিংস্র চরিত্র। তারা জাহাজ ভিরিয়ে কর্পূরের ছাগল তুলে নিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে চায় না। তখন কর্পূর ক্ষিপ্ত হয়ে যায় তার মাঝে আশ্রয় নেয় চৌর্যবৃত্তি। কর্পূর জাহাজে ওঠে ছাগলের দাম বাবদ প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা ছয়টি নতুন কম্বল নিয়ে নেমে আসে। গল্পকার এখানে জীবন ধারণের এক নিদারুণ বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন কর্পূর চরিত্রের মাধ্যমে। কর্পূরের জাহাজে উঠানামা নিয়ে লেখক যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বাস্তব প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত শৈল্পিক :

রতন দড়ি ছেড়ে বৈঠায় ঠেলা দিয়ে টালাই ভাসিয়ে দিল। টালাইটা একবার পাক খেয়েই দ্রুতগতিতে জাহাজের পাশ থেকে নদীর ঢেউয়ের ওপর লাফিয়ে উঠে চলতে শুরু করেছে। রতন দেখল কর্পূরের গায়ে কাপড় নেই। বুক দুটি রক্তবর্ণ ফলের মতো কাঁপছে। এতক্ষণে তার সাহস ফিরে এসেছে, ‘তুই বাদার বাঘিনী কর্পূরী বু’। তোর সাথে আর কাজ করতে আসব না। মারা পড়ব।

লেখক এ গল্পে চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীর জীবন ধারণের নিদারুণ বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। ‘রুহানীর রুদ্ধশ্বাস’ গল্পে লেখক রুহানীর সংগ্রামী জীবনের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। রুহানীর জীবনের কয়েকটি প্রতিকূল দিকের বর্ণনা লেখক ‘রুহানীর রুদ্ধশ্বাস’ গল্পে সমান্তরালভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, যার দরুণ লেখক গল্পের আঙ্গিক বিন্যাসে শিল্পসংহতি রক্ষায় পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। রুহানী একট মফস্বল কলেজের বাংলা শিক্ষিকা। মেধা ও যোগ্যতায় অনন্য রুহানী আধুনিক জীবনের সমস্যার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সংগ্রামী জীবনের বলয়ে। কলেজের এক নিরূপায় ছাত্রীকে রুহানী রাতে তার বাসায় আশ্রয় দিলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ছাত্রী জমিলা যে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দলের সদস্য তা রুহানীর জানা ছিল না। ফলে রুহানীর তিন মাসের জেল হয়। জেল থেকে ছাড়া পেলে রুহানীর একমাত্র অভিভাবক মামা রুহানীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তখন রুহানী মামাকে তার পছন্দের পাত্র রাহাতের কথা বলে। রাহাত বেকার হওয়ায় তার বিয়েটা পিছিয়ে যায়। জেল থেকে বের হয়ে রুহানী নিজেকে কর্মব্যস্ত রাখার চেষ্টা শুরু করে। একদিন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকুরি পেয়ে যায়। সংস্থার মালিক রুহানীকে ইন্টরভিউয়ের কথা বলে তাকে ভোগ করতে উদ্যত হলে রুহানী কৌশলে সেই নরপশুর হাত থেকে রক্ষা পায়। নরপশুর হাত থেকে রুহানী নিজেকে, নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় সমর্থ হলেও তার ভালবাসার মানুষ রাহাত পত্রিকায় এ সংবাদ জেনে মা-বাবার অনিহার অজুহাতে রুহানীকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। গল্পের শেষে জেলমুক্ত রুহানীর প্রতি পুলিশ অফিসার মাহবুবের অতি সদয় আচরণ এবং পূর্ব প্রেমিক রাহাতের সঙ্গে রুহানীর বিয়ের আয়োজন অতি আবেগময় ঘটনাচালিত হয়ে উঠেছে, ফলে গল্পের পরিণতি নাটকীয় ও আবেগতাড়িত হয়।

লেখক এ গল্পে তিনটি বিষয়বস্তুকে গল্পের কাহিনিতে নিয়ে এসেছেন। এক- অপরাজনীতির করাল গ্রাসে মেধাবী তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা কীভাবে নিজের সুন্দর জীবনটাকে নষ্ট করে দেয়। দুই- সহজ-সরল নারীদের চাকরির লোভ দেখিয়ে কিভাবে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিন- সমাজে পুলিশ শ্রেণিকে হেয় করে দেখার যে প্রবণতা এখানে লেখকের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান। সমাজে পুলিশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সাধারণত বাঁকা চোখে দেখা হয়। কিন্তু পুলিশের ভিতরেও যে চরিত্রবান, আদর্শবান লোক আছে লেখক ‘রুহানীর রুদ্ধশ্বাস’ গল্পে তা তুলে ধরেছেন।

একাধিক বিষয়কে লেখক কাহিনির মধ্যে প্রাধান্য দেওয়ায় শেষ দিকে গল্পের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হয়ে যায়। তবুও রুহানীর সংগ্রামশীল জীবনের যে আলেখ্য গল্পকার তুলে ধরেছেন তাতে রুহানীকে একজন সাহসী, আদর্শবান ও তেজোদ্দীপ্ত নারী বলেই মনে হয়।

‘এক পলক’ গল্পে লেখক দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছেন। বর্তমান ফিল্ম মেকাররা অত্যন্ত স্বল্প বাজেটে বৃহৎ চলচ্চিত্রের স্বপ্ন দেখেন। অর্থাৎ তাদের কাজ অত্যন্ত ছোট কিন্তু প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে দর্শকের মনোযোগ পেতে চায়; ফলে তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। নি¤œ বাজেটে স্বল্প সময়ে ভালো ছবি নির্মাণ করা যায় না। তারা দর্শক চাহিদা পূরণ করার জন্য যৌনতা, নগ্নতা, বেহায়াপনা সম্পৃক্ত ছবিগুলো প্রদর্শন করে। কিন্তু এগুলো মানুষের ধারাবাহিক স্মৃতির মধ্যে ক্ষণিকের জন্য স্থান করে নিতে পারে। লেখক ‘একপলক’ গল্পে চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বার্থান্বেষী, অর্থলিপ্সু শিল্পী ও কলাকৌশলীদের বাস্তব অবস্থান দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরেছেন।

‘মৃগয়া’ গল্পে লেখক সমাজের অপহরণকারীদের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছেন। এ গল্পের প্রধান নারী চরিত্র নিলুফা। কিডন্যাপাররা নিলুফাকে অপহরণ করে তার স্বামীর কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। কিন্তু নিলুফা জানে তার স্বামী তাকে কোটি টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনতে পারবে না। কেননা এত টাকা জোগাড় করা স্বামী হিশাম সাহেবের পক্ষে অসম্ভব। স্বামী-স্ত্রীর সব সম্পদ বিক্রি করেও ক্যাশ এক কোটি টাকা বের করা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় এখন হিশাম কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। পুলিশের কাছে গিয়েও কোন সুফল হচ্ছে না। তাই নিলুফা মনে করে অপহরণকারীদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র অবলম্বন নিজের কৌশল। নিলুফা অপহরণকারীদের বোঝাতে সক্ষম হয় সে এতটা ভীতু নারী নয়। সে নিজেকে বাঁচানোর যাবতীয় কৌশল রপ্ত করতে থাকে। ডাকাতরা নিলুফার কথাবার্তার ঢঙ দেখে বিস্মিত এবং ভীত হয়। পরিশেষে হিশাম পুলিশ ইন্সপেক্টরের সহযোগিতায় গুপ্তদলের ডাকাত সদস্যদের পরাজিত করে নিজের স্ত্রীকে উদ্ধার করে। লেখক ‘মৃগয়া’ গল্পে তৎকালীন সমাজের ডাকাত, খুনি ও অপহরণকারীদের পাশবিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন।

‘নেশাগ্রস্ত নদীর সতীন’ গল্পে লেখক শহরের উচ্ছৃঙ্খল মেয়েদের জীবন যাপনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। এ গল্পে বিত্তশালী বাবার দুই মেয়ে আইরিন ও ইয়াসমিন ছোটকাল থেকেই তারা শহরের যান্ত্রিক পরিবেশে অভ্যস্ত। ঢাকা শহরের সংস্কৃতি তাদেরকে অন্ধকারের অতলগর্ভে গ্রাস করে ফেলেছে। সমাজের ন্যায়-অন্যায়, সঙ্গতি-অসঙ্গতি তাদের বিবেচনায় সমান। মদ, তাস নিয়ে চলে তাদের বেখেয়ালি জীবন। বন্ধু বা প্রেমিকের সাথে অবাধ মেলার ফলে তারা বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত হয়। মা-বাবারা শত চেষ্টা করেও তাদের আলোর পথে নিয়ে আসতে পারে না। মফস্বল থেকে আসা ফাহমিদা মামাত বোনদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ফাহমিদার মনে হয় শহরের আধুনিকতা তাদের নেশাগ্রস্ত করে ফেলেছে সমাজ গর্হিত পথে। লেখক এ গল্পে ঢাকা শহরের তরুণ তরুণীদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনের সুষ্ঠু পরিবেশকে বর্ণনা করেছেন।

‘রাগ যন্ত্রণা’ গল্পে লেখক সংগীত জগতের একজন অজ্ঞ বিচারকের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপণকে তুলে ধরেছেন। মোস্তফা সাহেব পুরোপুরি সঙ্গীতের লোক নয়। শুধুমাত্র একবার দেশের একটি প্রখ্যাত সঙ্গীতগোষ্ঠীর আগ্রহে দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি প্রতিযোগিতামূলক সম্মেলনের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যন্ত্র বা কণ্ঠসঙ্গীতের ব্যাপারে মোস্তফা সাহেবের মোটামুটি ধারণা ছিল কিন্তু একজন শিল্পীর বাদন বা গায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে চুলচেরা বিচারের মতো যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা তার ছিল না। অনুষ্ঠান আয়োজকদের ধারণা ছিলো যে মোস্তফা সাহেব দেশীয় সঙ্গীতের একজন অভিজ্ঞ বিচারক। মোস্তফা আয়োজকদের তার ভেতরের অজ্ঞতা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত তাকেই প্রধান বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। মোস্তফা সাহেব তখন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। কেননা যারা অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন তারা তিনজনেই অভিজ্ঞ ও নামকরা শিল্পী। তাই এদের প্রতিভা বিবেচনা করা মোস্তফার পক্ষে অসম্ভব। অনুষ্ঠানে তিনজন শিল্পীর পারফর্ম মোস্তফাকে মুগ্ধ করে। তাদের মধ্যে মেধা তালিকায় কাকে প্রথম স্থান দেয়া যায় এ নিয়ে মোস্তফা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। ফলে তিনি তিনজন বিচারকের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করলেন। মোস্তফার ধারণা ছিল বাকি দুজন বিচারক যে রায় দিবেন তিনি সেই রায়কেই সাধুবাদ জানাবেন। ঠিক এমন সময়ে এক নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয় :

আমি দরজা পেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখলাম, দিল আফরোজ ওস্তাদ আমীর খানের ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজায় খিল এঁটে দিল। আমি বেশ অবাক হলাম। বারান্দায় অন্য কারও আনাগোনা নেই। দারুণ কৌতূহলের প্ররোচনায় আমি ওস্তাদখানের দোয়ারের সামনে মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালাম। কিন্তু এখান থেকে ভেতরে শিল্পীদের মধ্যে কি ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই। আমি এগিয়ে গিয়ে জানালার ছিদ্র দিয়ে যেটুকু আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছিল সেখানে উবু হয়ে ভেতরের দিকটা দেখার চেষ্টা করলাম। আমার ভাগ্য ভালই বলতে হবে। আমি স্পষ্ট দেখতে পারলাম দিল আফরোজ ওস্তাদ আমীর খানকে তিরস্কার করে কি যেন বলছে।... আপনি জালিয়াতি করেছেন। যে রাগ বাজাবার কথা তা না বাজিয়ে উল্টাপাল্টা বাজনা বাজিয়ে গেছেন।

এ কথা জানার পর মোস্তফা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। এখন আর প্রকৃত শিল্পীর সম্মান দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই তিনি দিল আফরোজকে প্রথম মালবিকাকে দ্বিতীয় এবং ওস্তাদ আমীর খাঁকে ডিসকোয়ালিফাইড লিখে রেজাল্ট প্রকাশ করলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যায়। মোস্তফা সাহেব অনুষ্ঠানে সবার কাছে বিজ্ঞ বিচারকের সম্মান পেলেন।

মোস্তফা সাহেব নিজের চাতুরীর কাছে নিজেই হেরে যান এবং নিজের মূর্খতা সম্বন্ধে মনে মনে অনুশোচনা করতে থাকনে। তবু সান্তানা এইটুকু যে, সে নিজেই সঙ্গীত সম্পর্কে অজ্ঞ ও মূর্খ হলেও যে কোনো কারণেই হোক সে প্রকৃত শিল্পীর মর্যাদা দিতে পেরেছে। লেখক ‘রাগযন্ত্রণা’ গল্পে মোস্তফা চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের মূর্খ অজ্ঞ ও পক্ষপাতিত্ব বিচারকের প্রকৃত মুখোশ উন্মোচন করেছেন।

আল মাহমুদের অতি সাম্প্রতিক কালে রচিত যে গল্পগুলো পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘নিশিন্দা নারী’। নিশিন্দা নারী মানে তিক্ত নারী। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করা এক দুঃসাহসী যুবতীর জীবন সংগ্রামের ইঙ্গিত। সাহস ও প্রেম একটি নারীকে কিভাবে বিরূপ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষায় সক্ষম ও মহিমান্বিত করে নিশিন্দা নারী’ এরই এক মর্মস্পর্শী দলিল। নিশিন্দা নি¤œবিত্ত পরিবারের শ্রমিক নেতা আব্দুল্লাহর স্ত্রী। শ্রমিক নেতা ও কমুনিষ্ট পার্টির আন্ডার গ্রাউন্ড শাখার প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহ্র সঙ্গে বলা যায় প্রেম করেই তার পরিণয় সম্পন্ন হয়। পার্টির স্বার্থবাদী গ্রুপের হাতে আব্দুল্লাহ্কে প্রাণ দিতে হয়। নিহত হওয়ার পনের দিন পূর্ব থেকেই আব্দুল্লাহ পুলিশের হয়রানি ও মামলার ভয়ে বাড়ি থেকে ফেরারি হয়েছে। পনের দিন পর ক্ষুধার্ত নিশিন্দা রাতে স্বপ্নে দেখে যে, খলার সব গরুগুলো তার উঠানে এসে হাজির হয়েছে। নিশি স্বপ্নের ঘোরেই অবলা গরুর সঙ্গে কথোপকথন শুরু করেছে :

একপাল ক্ষুধার্ত গাইগরু মুহূর্তের মধ্যে হাম্বা রব তুলে যেন দশটা হাতির জোড় নিয়ে নিশিন্দার দুয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ে খিল ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কোথায় পালাবে নিশিন্দা এখন? নিশিন্দা দেখল অসংখ্য বাঁকা শিংয়ের চূড়ায় মানুষের রক্ত শুকিয়ে আছে আর শিংয়ের ছুরির ফলার মতো এলোমেলোভাবে নেমে আসছে তার দুর্দিনের উপোসে শুকিয়ে থাকা নাভীর ওপর।

লেখক নিশিন্দার জীবনের গভীর মর্মমূলে লুকিয়ে থাকা ব্যাথা বেদনাকে শিল্পিত রূপ দিয়েছেন। ক্ষুধা ও ঘুম একসাথে থাকলে মানুষের স্বপ্ন চটে যায় না। আজ পনের দিন ধরে আব্দুল্লাহ নিঁেখাজ। বেঁচে থাকার সুতীব্র ইচ্ছায় ক্ষুধার কাছে পরাজিত হয়ে নিশিন্দাকে বাথানের গাভীর দুধ চুরি করতে হয়। লেখক নিশিন্দাকে সাহসী নারী হিসেবে চিত্রিত করেছেন। দুধ চুরির সময় ধরা পড়লে সাহসের কারণে নিশিন্দা ছাড়া পায়। আব্দুল্লাহর অনুপস্থিতে অনন্যপায় নিশিন্দা ক্ষুধার তাড়নায় চিন্তিত হলেও ভেঙ্গে পড়েনি :

নিশিন্দার মনে হল সে একটা ক্ষুধার্ত বাঘিনী। যে করেই হোক তার বেঁচে থেকে দুনিয়ার ওপর প্রতিশোধ নিতে হবে। প্রতিশোধ হত্যা এবং নিজের ক্ষুধার্ত পেটের। বেড়ায় ঝোলানো কনুই জালটার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। এই তো এখনও বেঁচে থাকার কিছু উপকরণ তার ঘরে আছে।... তবু হার মানবে না সে। হার মানবে না আব্দুল্লাহর খুনী শহরের জোতদার, ইট ভাটার মালিক আর গুপ্ত পার্টির ছদ্মবেশধারী রাজনৈতিক ডাকাতদের কাছে।

নিশিন্দা আল মাহমুদের সমগ্র ছোটগল্পের মধ্যে অন্যতম প্রতিবাদী চরিত্র। সে স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত শান্ত হয়নি। স্বামীর প্রতি অগাধ ভালবাসা ও বেঁচে থাকার যাবতীয় কৌশল নিশিন্দা অবলম্বন করে নিজের সতীত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। ইটখোলার মালিক, বাথানের মালিক, ঘুষখোর পুলিশ অফিসারে লিবিডো দৃষ্টি থেকে সে সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করেছে। ইটভাটার ম্যানেজারের লোভী আঙুল ক’টি নিশিন্দা রামদা দিয়ে কেটে ফেলেও সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। নিশিন্দার এই শক্তি বা সাহসের উৎস ছিল আব্দুল্লাহ্র ব্যবহৃত রাম দা। এ গল্পে লেখক ঘুষখোর পুলিশ অফিসারদের সত্যিকার মুখোশ উন্মোচন করেছেন তারা যেন সামন্ত শ্রেণির কেনা গোলাম। খলার ম্যানেজার তার ইজ্জতের ওপর হামলা করলে তার পাঁচটি আঙুল নিশিন্দা রামদা দিয়ে কেটে ফেলে। রমিজ দারোগা খলার ম্যানেজারের পক্ষ নিলে নিশিন্দার মাঝে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে :

আমি নিশিন্দা নারী, খলার ম্যানেজার আমার ইজ্জতের ওপর হামলা করেছিল বলে আমি তার পাপী আঙুলগুলো কেটে ছাইয়ের গাঁদায় পুঁতে রেখেছি। তোমরা সাক্ষী থেকো। রমিজ দারোগা ফোর্স নিয়ে এলে তোমরাও হাজার হাজার চামার নর-নারী তোমাদের যার ঘরে যা আছে দা, কুড়াল, ঝাঁটা, লাঠি নিয়ে আমার পক্ষে থেকো। ওরা আব্দুল্লাহর নাম নদীর এপার থেকে মুছে দিতে চায় আমি এ নাম মুছতে দেব না।

‘নিশিন্দা নারী’ গল্প আল মাহমুদের অভিনব সৃষ্টি। লেখক নিশিন্দার সংগ্রামী জীবনের পাশাপাশি তৎকালীন সমাজের উচ্চবিত্তের শাসন-শোষণ, জুলুম, নির্যাতন ও পাশবিকতার প্রকৃত ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। নারী নিজেকে কীভাবে সাহস ও প্রেমের বলে বলীয়ান হয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে তারই জীবনালেখ্য ‘নিশিন্দা নারী’ ছোটগল্প। প্রতিকূল পরিবেশে নিশিন্দা তার সমস্বর শক্তি নিয়ে স্বামী প্রেমে অটল থেকে সমাজের জোতদার শ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। মূলত শ্রেণি চেতনাই এই গল্পের প্রধান বিষয়বস্তু। শ্রেণি চেতনাকে রূপ দিতে গিয়ে লেখক স্বপ্ন ও প্রেমের প্রসঙ্গ এনেছেন।

‘তৃতীয় এক নদী’ গল্পে লেখক লিবিডোতাড়িত প্রেমের উর্ধ্বে এক শাশ্বত নারীর সম্ভ্রম রক্ষার যাবতীয় কৌশলের পাশাপাশি জীবন ধারণের এক কৌশলী পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। ইদু মাঝির অসুস্থতার কারণে তার দ্বিতীয় বউ নদী পারাপারের কাজ করে জীবন নির্বাহ করে। কিন্তু এই ভোরবেলায় সে একা একটি যুবক মানুষকে নদী পার করতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে :

‘দেখুন এপারেও কেউ নেই ওপারেও কেউ নেই। আপনাকে আমি চিনি না। মনে হয় আপনি এতদঞ্চলের মানুষ নন। আমি কোন ভরসায় আপনাকে মাঝনদীতে নিয়ে যাব। নদীটা তো কুয়াশায় ঢাকা। আর আপনি আমার অচেনা। বরং আরও একটু অপেক্ষা করে এ ঘাটেই বসে থাকতে হবে। আরও একজন আসুক তখন না হয়ে পার করে দেব।

এ গল্পে সমাজের একজন নিম্নবিত্ত দরিদ্র যুবতী তার সম্ভ্রম রক্ষার আশংকা থেকে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

আল মাহমুদ সমকালীন বাংলা ছোটগল্পে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে বিষয় নির্বাচনে ও প্রকরণ শৈলিতে। বিষয় নির্বাচনে তিনি যেমন কোন সঙ্কীর্ণতায় ভোগেননি, তদ্রুপ শিল্পনির্মাণেও কোন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। পাঠকের মনোভূমিতে গদ্যের চমৎকার বয়নে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করছেন। তাঁর অলঙ্কারবহুল বর্ণনা খুব সহজেই পাঠককে আকর্ষণ করে।

জানোয়ারের হিং¯্র চরিত্র। তারা জাহাজ ভিরিয়ে কর্পূরের ছাগল তুলে নিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে চায় না। তখন কর্পূর ক্ষিপ্ত হয়ে যায় তার মাঝে আশ্রয় নেয় চৌর্যবৃত্তি। কর্পূর জাহাজে ওঠে ছাগলের দাম বাবদ প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা ছয়টি নতুন কম্বল নিয়ে নেমে আসে। গল্পকার এখানে জীবন ধারণের এক নিদারুণ বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন কর্পূর চরিত্রের মাধ্যমে। কর্পূরের জাহাজে উঠানামা নিয়ে লেখক যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বাস্তব প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত শৈল্পিক :

রতন দড়ি ছেড়ে বৈঠায় ঠেলা দিয়ে টালাই ভাসিয়ে দিল। টালাইটা একবার পাক খেয়েই দ্রুতগতিতে জাহাজের পাশ থেকে নদীর ঢেউয়ের ওপর লাফিয়ে উঠে চলতে শুরু করেছে। রতন দেখল কর্পূরের গায়ে কাপড় নেই। বুক দুটি রক্তবর্ণ ফলের মতো কাঁপছে। এতক্ষণে তার সাহস ফিরে এসেছে, ‘তুই বাদার বাঘিনী কর্পূরী বু’। তোর সাথে আর কাজ করতে আসব না। মারা পড়ব।

লেখক এ গল্পে চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীর জীবন ধারণের নিদারুণ বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। ‘রুহানীর রুদ্ধশ্বাস’ গল্পে লেখক রুহানীর সংগ্রামী জীবনের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। রুহানীর জীবনের কয়েকটি প্রতিকূল দিকের বর্ণনা লেখক ‘রুহানীর রুদ্ধশ্বাস’ গল্পে সমান্তরালভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, যার দরুণ লেখক গল্পের আঙ্গিক বিন্যাসে শিল্পসংহতি রক্ষায় পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। রুহানী একট মফস্বল কলেজের বাংলা শিক্ষিকা। মেধা ও যোগ্যতায় অনন্য রুহানী আধুনিক জীবনের সমস্যার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সংগ্রামী জীবনের বলয়ে। কলেজের এক নিরূপায় ছাত্রীকে রুহানী রাতে তার বাসায় আশ্রয় দিলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ছাত্রী জমিলা যে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দলের সদস্য তা রুহানীর জানা ছিল না। ফলে রুহানীর তিন মাসের জেল হয়। জেল থেকে ছাড়া পেলে রুহানীর একমাত্র অভিভাবক মামা রুহানীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তখন রুহানী মামাকে তার পছন্দের পাত্র রাহাতের কথা বলে। রাহাত বেকার হওয়ায় তার বিয়েটা পিছিয়ে যায়। জেল থেকে বের হয়ে রুহানী নিজেকে কর্মব্যস্ত রাখার চেষ্টা শুরু করে। একদিন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকুরি পেয়ে যায়। সংস্থার মালিক রুহানীকে ইন্টরভিউয়ের কথা বলে তাকে ভোগ করতে উদ্যত হলে রুহানী কৌশলে সেই নরপশুর হাত থেকে রক্ষা পায়। নরপশুর হাত থেকে রুহানী নিজেকে, নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় সমর্থ হলেও তার ভালবাসার মানুষ রাহাত পত্রিকায় এ সংবাদ জেনে মা-বাবার অনিহার অজুহাতে রুহানীকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। গল্পের শেষে জেলমুক্ত রুহানীর প্রতি পুলিশ অফিসার মাহবুবের অতি সদয় আচরণ এবং পূর্ব প্রেমিক রাহাতের সঙ্গে রুহানীর বিয়ের আয়োজন অতি আবেগময় ঘটনাচালিত হয়ে উঠেছে, ফলে গল্পের পরিণতি নাটকীয় ও আবেগতাড়িত হয়।

লেখক এ গল্পে তিনটি বিষয়বস্তুকে গল্পের কাহিনিতে নিয়ে এসেছেন। একÑ অপরাজনীতির করাল গ্রাসে মেধাবী তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা কীভাবে নিজের সুন্দর জীবনটাকে নষ্ট করে দেয়। দুইÑ সহজ-সরল নারীদের চাকরির লোভ দেখিয়ে কিভাবে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনÑ সমাজে পুলিশ শ্রেণিকে হেয় করে দেখার যে প্রবণতা এখানে লেখকের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান। সমাজে পুলিশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সাধারণত বাঁকা চোখে দেখা হয়। কিন্তু পুলিশের ভিতরেও যে চরিত্রবান, আদর্শবান লোক আছে লেখক ‘রুহানীর রুদ্ধশ্বাস’ গল্পে তা তুলে ধরেছেন।

একাধিক বিষয়কে লেখক কাহিনির মধ্যে প্রাধান্য দেওয়ায় শেষ দিকে গল্পের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হয়ে যায়। তবুও রুহানীর সংগ্রামশীল জীবনের যে আলেখ্য গল্পকার তুলে ধরেছেন তাতে রুহানীকে একজন সাহসী, আদর্শবান ও তেজোদ্দীপ্ত নারী বলেই মনে হয়।

‘এক পলক’ গল্পে লেখক দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছেন। বর্তমান ফিল্ম মেকাররা অত্যন্ত স্বল্প বাজেটে বৃহৎ চলচ্চিত্রের স্বপ্ন দেখেন। অর্থাৎ তাদের কাজ অত্যন্ত ছোট কিন্তু প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে দর্শকের মনোযোগ পেতে চায়; ফলে তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। নি¤œ বাজেটে স্বল্প সময়ে ভালো ছবি নির্মাণ করা যায় না। তারা দর্শক চাহিদা পূরণ করার জন্য যৌনতা, নগ্নতা, বেহায়াপনা সম্পৃক্ত ছবিগুলো প্রদর্শন করে। কিন্তু এগুলো মানুষের ধারাবাহিক স্মৃতির মধ্যে ক্ষণিকের জন্য স্থান করে নিতে পারে। লেখক ‘একপলক’ গল্পে চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বার্থান্বেষী, অর্থলিপ্সু শিল্পী ও কলাকৌশলীদের বাস্তব অবস্থান দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরেছেন।

‘মৃগয়া’ গল্পে লেখক সমাজের অপহরণকারীদের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছেন। এ গল্পের প্রধান নারী চরিত্র নিলুফা। কিডন্যাপাররা নিলুফাকে অপহরণ করে তার স্বামীর কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। কিন্তু নিলুফা জানে তার স্বামী তাকে কোটি টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনতে পারবে না। কেননা এত টাকা জোগাড় করা স্বামী হিশাম সাহেবের পক্ষে অসম্ভব। স্বামী-স্ত্রীর সব সম্পদ বিক্রি করেও ক্যাশ এক কোটি টাকা বের করা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় এখন হিশাম কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। পুলিশের কাছে গিয়েও কোন সুফল হচ্ছে না। তাই নিলুফা মনে করে অপহরণকারীদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র অবলম্বন নিজের কৌশল। নিলুফা অপহরণকারীদের বোঝাতে সক্ষম হয় সে এতটা ভীতু নারী নয়। সে নিজেকে বাঁচানোর যাবতীয় কৌশল রপ্ত করতে থাকে। ডাকাতরা নিলুফার কথাবার্তার ঢঙ দেখে বিস্মিত এবং ভীত হয়। পরিশেষে হিশাম পুলিশ ইন্সপেক্টরের সহযোগিতায় গুপ্তদলের ডাকাত সদস্যদের পরাজিত করে নিজের স্ত্রীকে উদ্ধার করে। লেখক ‘মৃগয়া’ গল্পে তৎকালীন সমাজের ডাকাত, খুনি ও অপহরণকারীদের পাশবিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন।

‘নেশাগ্রস্ত নদীর সতীন’ গল্পে লেখক শহরের উচ্ছৃঙ্খল মেয়েদের জীবন যাপনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। এ গল্পে বিত্তশালী বাবার দুই মেয়ে আইরিন ও ইয়াসমিন ছোটকাল থেকেই তারা শহরের যান্ত্রিক পরিবেশে অভ্যস্ত। ঢাকা শহরের সংস্কৃতি তাদেরকে অন্ধকারের অতলগর্ভে গ্রাস করে ফেলেছে। সমাজের ন্যায়-অন্যায়, সঙ্গতি-অসঙ্গতি তাদের বিবেচনায় সমান। মদ, তাস নিয়ে চলে তাদের বেখেয়ালি জীবন। বন্ধু বা প্রেমিকের সাথে অবাধ মেলার ফলে তারা বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত হয়। মা-বাবারা শত চেষ্টা করেও তাদের আলোর পথে নিয়ে আসতে পারে না। মফস্বল থেকে আসা ফাহমিদা মামাত বোনদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ফাহমিদার মনে হয় শহরের আধুনিকতা তাদের নেশাগ্রস্ত করে ফেলেছে সমাজ গর্হিত পথে। লেখক এ গল্পে ঢাকা শহরের তরুণ তরুণীদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনের সুষ্ঠু পরিবেশকে বর্ণনা করেছেন।

‘রাগ যন্ত্রণা’ গল্পে লেখক সংগীত জগতের একজন অজ্ঞ বিচারকের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপণকে তুলে ধরেছেন। মোস্তফা সাহেব পুরোপুরি সঙ্গীতের লোক নয়। শুধুমাত্র একবার দেশের একটি প্রখ্যাত সঙ্গীতগোষ্ঠীর আগ্রহে দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি প্রতিযোগিতামূলক সম্মেলনের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যন্ত্র বা কণ্ঠসঙ্গীতের ব্যাপারে মোস্তফা সাহেবের মোটামুটি ধারণা ছিল কিন্তু একজন শিল্পীর বাদন বা গায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে চুলচেরা বিচারের মতো যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা তার ছিল না। অনুষ্ঠান আয়োজকদের ধারণা ছিলো যে মোস্তফা সাহেব দেশীয় সঙ্গীতের একজন অভিজ্ঞ বিচারক। মোস্তফা আয়োজকদের তার ভেতরের অজ্ঞতা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত তাকেই প্রধান বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। মোস্তফা সাহেব তখন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। কেননা যারা অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন তারা তিনজনেই অভিজ্ঞ ও নামকরা শিল্পী। তাই এদের প্রতিভা বিবেচনা করা মোস্তফার পক্ষে অসম্ভব। অনুষ্ঠানে তিনজন শিল্পীর পারফর্ম মোস্তফাকে মুগ্ধ করে। তাদের মধ্যে মেধা তালিকায় কাকে প্রথম স্থান দেয়া যায় এ নিয়ে মোস্তফা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। ফলে তিনি তিনজন বিচারকের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করলেন। মোস্তফার ধারণা ছিল বাকি দুজন বিচারক যে রায় দিবেন তিনি সেই রায়কেই সাধুবাদ জানাবেন। ঠিক এমন সময়ে এক নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয় :

আমি দরজা পেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখলাম, দিল আফরোজ ওস্তাদ আমীর খানের ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজায় খিল এঁটে দিল। আমি বেশ অবাক হলাম। বারান্দায় অন্য কারও আনাগোনা নেই। দারুণ কৌতূহলের প্ররোচনায় আমি ওস্তাদখানের দোয়ারের সামনে মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালাম। কিন্তু এখান থেকে ভেতরে শিল্পীদের মধ্যে কি ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই। আমি এগিয়ে গিয়ে জানালার ছিদ্র দিয়ে যেটুকু আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছিল সেখানে উবু হয়ে ভেতরের দিকটা দেখার চেষ্টা করলাম। আমার ভাগ্য ভালই বলতে হবে। আমি স্পষ্ট দেখতে পারলাম দিল আফরোজ ওস্তাদ আমীর খানকে তিরস্কার করে কি যেন বলছে।... আপনি জালিয়াতি করেছেন। যে রাগ বাজাবার কথা তা না বাজিয়ে উল্টাপাল্টা বাজনা বাজিয়ে গেছেন।

এ কথা জানার পর মোস্তফা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। এখন আর প্রকৃত শিল্পীর সম্মান দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই তিনি দিল আফরোজকে প্রথম মালবিকাকে দ্বিতীয় এবং ওস্তাদ আমীর খাঁকে ডিসকোয়ালিফাইড লিখে রেজাল্ট প্রকাশ করলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যায়। মোস্তফা সাহেব অনুষ্ঠানে সবার কাছে বিজ্ঞ বিচারকের সম্মান পেলেন।

মোস্তফা সাহেব নিজের চাতুরীর কাছে নিজেই হেরে যান এবং নিজের মূর্খতা সম্বন্ধে মনে মনে অনুশোচনা করতে থাকনে। তবু সান্তানা এইটুকু যে, সে নিজেই সঙ্গীত সম্পর্কে অজ্ঞ ও মূর্খ হলেও যে কোনো কারণেই হোক সে প্রকৃত শিল্পীর মর্যাদা দিতে পেরেছে। লেখক ‘রাগযন্ত্রণা’ গল্পে মোস্তফা চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের মূর্খ অজ্ঞ ও পক্ষপাতিত্ব বিচারকের প্রকৃত মুখোশ উন্মোচন করেছেন।

আল মাহমুদের অতি সাম্প্রতিক কালে রচিত যে গল্পগুলো পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘নিশিন্দা নারী’। নিশিন্দা নারী মানে তিক্ত নারী। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করা এক দুঃসাহসী যুবতীর জীবন সংগ্রামের ইঙ্গিত। সাহস ও প্রেম একটি নারীকে কিভাবে বিরূপ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষায় সক্ষম ও মহিমান্বিত করে নিশিন্দা নারী’ এরই এক মর্মস্পর্শী দলিল। নিশিন্দা নিম্নবিত্ত পরিবারের শ্রমিক নেতা আব্দুল্লাহর স্ত্রী। শ্রমিক নেতা ও কমুনিষ্ট পার্টির আন্ডার গ্রাউন্ড শাখার প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহ্র সঙ্গে বলা যায় প্রেম করেই তার পরিণয় সম্পন্ন হয়। পার্টির স্বার্থবাদী গ্রুপের হাতে আব্দুল্লাহ্কে প্রাণ দিতে হয়। নিহত হওয়ার পনের দিন পূর্ব থেকেই আব্দুল্লাহ পুলিশের হয়রানি ও মামলার ভয়ে বাড়ি থেকে ফেরারি হয়েছে। পনের দিন পর ক্ষুধার্ত নিশিন্দা রাতে স্বপ্নে দেখে যে, খলার সব গরুগুলো তার উঠানে এসে হাজির হয়েছে। নিশি স্বপ্নের ঘোরেই অবলা গরুর সঙ্গে কথোপকথন শুরু করেছে :

একপাল ক্ষুধার্ত গাইগরু মুহূর্তের মধ্যে হাম্বা রব তুলে যেন দশটা হাতির জোড় নিয়ে নিশিন্দার দুয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়ে খিল ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কোথায় পালাবে নিশিন্দা এখন? নিশিন্দা দেখল অসংখ্য বাঁকা শিংয়ের চূড়ায় মানুষের রক্ত শুকিয়ে আছে আর শিংয়ের ছুরির ফলার মতো এলোমেলোভাবে নেমে আসছে তার দুর্দিনের উপোসে শুকিয়ে থাকা নাভীর ওপর।

লেখক নিশিন্দার জীবনের গভীর মর্মমূলে লুকিয়ে থাকা ব্যাথা বেদনাকে শিল্পিত রূপ দিয়েছেন। ক্ষুধা ও ঘুম একসাথে থাকলে মানুষের স্বপ্ন চটে যায় না। আজ পনের দিন ধরে আব্দুল্লাহ নিঁেখাজ। বেঁচে থাকার সুতীব্র ইচ্ছায় ক্ষুধার কাছে পরাজিত হয়ে নিশিন্দাকে বাথানের গাভীর দুধ চুরি করতে হয়। লেখক নিশিন্দাকে সাহসী নারী হিসেবে চিত্রিত করেছেন। দুধ চুরির সময় ধরা পড়লে সাহসের কারণে নিশিন্দা ছাড়া পায়। আব্দুল্লাহর অনুপস্থিতে অনন্যপায় নিশিন্দা ক্ষুধার তাড়নায় চিন্তিত হলেও ভেঙ্গে পড়েনি :

নিশিন্দার মনে হল সে একটা ক্ষুধার্ত বাঘিনী। যে করেই হোক তার বেঁচে থেকে দুনিয়ার ওপর প্রতিশোধ নিতে হবে। প্রতিশোধ হত্যা এবং নিজের ক্ষুধার্ত পেটের। বেড়ায় ঝোলানো কনুই জালটার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। এই তো এখনও বেঁচে থাকার কিছু উপকরণ তার ঘরে আছে।... তবু হার মানবে না সে। হার মানবে না আব্দুল্লাহর খুনী শহরের জোতদার, ইট ভাটার মালিক আর গুপ্ত পার্টির ছদ্মবেশধারী রাজনৈতিক ডাকাতদের কাছে।

নিশিন্দা আল মাহমুদের সমগ্র ছোটগল্পের মধ্যে অন্যতম প্রতিবাদী চরিত্র। সে স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত শান্ত হয়নি। স্বামীর প্রতি অগাধ ভালবাসা ও বেঁচে থাকার যাবতীয় কৌশল নিশিন্দা অবলম্বন করে নিজের সতীত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। ইটখোলার মালিক, বাথানের মালিক, ঘুষখোর পুলিশ অফিসারে লিবিডো দৃষ্টি থেকে সে সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করেছে। ইটভাটার ম্যানেজারের লোভী আঙুল ক’টি নিশিন্দা রামদা দিয়ে কেটে ফেলেও সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। নিশিন্দার এই শক্তি বা সাহসের উৎস ছিল আব্দুল্লাহ্র ব্যবহৃত রাম দা। এ গল্পে লেখক ঘুষখোর পুলিশ অফিসারদের সত্যিকার মুখোশ উন্মোচন করেছেন তারা যেন সামন্ত শ্রেণির কেনা গোলাম। খলার ম্যানেজার তার ইজ্জতের ওপর হামলা করলে তার পাঁচটি আঙুল নিশিন্দা রামদা দিয়ে কেটে ফেলে। রমিজ দারোগা খলার ম্যানেজারের পক্ষ নিলে নিশিন্দার মাঝে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে :

আমি নিশিন্দা নারী, খলার ম্যানেজার আমার ইজ্জতের ওপর হামলা করেছিল বলে আমি তার পাপী আঙুলগুলো কেটে ছাইয়ের গাঁদায় পুঁতে রেখেছি। তোমরা সাক্ষী থেকো। রমিজ দারোগা ফোর্স নিয়ে এলে তোমরাও হাজার হাজার চামার নর-নারী তোমাদের যার ঘরে যা আছে দা, কুড়াল, ঝাঁটা, লাঠি নিয়ে আমার পক্ষে থেকো। ওরা আব্দুল্লাহর নাম নদীর এপার থেকে মুছে দিতে চায় আমি এ নাম মুছতে দেব না।

‘নিশিন্দা নারী’ গল্প আল মাহমুদের অভিনব সৃষ্টি। লেখক নিশিন্দার সংগ্রামী জীবনের পাশাপাশি তৎকালীন সমাজের উচ্চবিত্তের শাসন-শোষণ, জুলুম, নির্যাতন ও পাশবিকতার প্রকৃত ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। নারী নিজেকে কীভাবে সাহস ও প্রেমের বলে বলীয়ান হয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে তারই জীবনালেখ্য ‘নিশিন্দা নারী’ ছোটগল্প। প্রতিকূল পরিবেশে নিশিন্দা তার সমস্বর শক্তি নিয়ে স্বামী প্রেমে অটল থেকে সমাজের জোতদার শ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। মূলত শ্রেণি চেতনাই এই গল্পের প্রধান বিষয়বস্তু। শ্রেণি চেতনাকে রূপ দিতে গিয়ে লেখক স্বপ্ন ও প্রেমের প্রসঙ্গ এনেছেন।

‘তৃতীয় এক নদী’ গল্পে লেখক লিবিডোতাড়িত প্রেমের উর্ধ্বে এক শাশ্বত নারীর সম্ভ্রম রক্ষার যাবতীয় কৌশলের পাশাপাশি জীবন ধারণের এক কৌশলী পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। ইদু মাঝির অসুস্থতার কারণে তার দ্বিতীয় বউ নদী পারাপারের কাজ করে জীবন নির্বাহ করে। কিন্তু এই ভোরবেলায় সে একা একটি যুবক মানুষকে নদী পার করতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে :

‘দেখুন এপারেও কেউ নেই ওপারেও কেউ নেই। আপনাকে আমি চিনি না। মনে হয় আপনি এতদঞ্চলের মানুষ নন। আমি কোন ভরসায় আপনাকে মাঝনদীতে নিয়ে যাব। নদীটা তো কুয়াশায় ঢাকা। আর আপনি আমার অচেনা। বরং আরও একটু অপেক্ষা করে এ ঘাটেই বসে থাকতে হবে। আরও একজন আসুক তখন না হয়ে পার করে দেব।

এ গল্পে সমাজের একজন নি¤িœবিত্ত দরিদ্র যুবতী তার সম্ভ্রম রক্ষার আশংকা থেকে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

আল মাহমুদ সমকালীন বাংলা ছোটগল্পে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে বিষয় নির্বাচনে ও প্রকরণ শৈলিতে। বিষয় নির্বাচনে তিনি যেমন কোন সঙ্কীর্ণতায় ভোগেননি, তদ্রƒপ শিল্পনির্মাণেও কোন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। পাঠকের মনোভূমিতে গদ্যের চমৎকার বয়নে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করছেন। তাঁর অলঙ্কারবহুল বর্ণনা খুব সহজেই পাঠককে আকর্ষণ করে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক