DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

দৈনিক সংগ্রামের সাহিত্যপাতা : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

প্রচারমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাহিত্য-শিল্পের প্রকৃতি ও গতিপথ নির্ধারণে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে এই প্রচারমাধ্যম।

Printed Edition
Untitled-1

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

প্রচারমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সাহিত্য-শিল্পের প্রকৃতি ও গতিপথ নির্ধারণে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে এই প্রচারমাধ্যম। শিল্পসৃষ্টি নিঃসন্দেহে ব্যক্তির একান্ত অধ্যবসায় ও তপস্যার ফল। কিন্তু সেই নির্জন তপস্যার অর্জনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মৌল ভূমিকা পালন করে সংবাদপত্র। অগণিত দৈনিক পত্রিকার ভিড়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেই এগিয়ে যাচ্ছে দৈনিক সংগ্রাম। দায়বদ্ধতার কারণে এই পত্রিকার প্রতি মানুষের বিশেষ প্রত্যাশা লক্ষ্য করা যায়।

পত্রিকার রীতিপদ্ধতি অনুযায়ী পত্রিকাকে আলাদা আলাদা পাতায় সুসজ্জিত করা হয়ে থাকে। পাঠকের আকর্ষণও ভিন্নতর হয়ে থাকে পাতার গুরুত্ব অনুসারে। সেই দৃষ্টিতে সারাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমীদের জন্য আকর্ষণীয় অংশ সাহিত্যপাতা। শুধু পাঠকের ক্ষেত্রেই নয়, সাহিত্যমোদী সকল পাঠক ও লেখকের আশ্রয়স্থল ‘সংগ্রাম সাহিত্য’। সত্যিকার অর্থে, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতার প্রভাব প্রান্তবিস্তারী। এই পাতার উপর ভর করেই একটি আদর্শিক সাহিত্য আন্দোলন দাঁড়িয়ে যায়। সাহিত্যবোদ্ধা এবং প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের মাঝে দাওয়াতের একটি অন্যতম মাধ্যমও এই সাহিত্যপাতা। আজকে আশির দশকের যে উজ¦ল ইতিহাস তৈরি হয়েছে তার পিছনেও অনন্য ভূমিকা পালন করেছে এই সংগ্রাম সাহিত্য- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

একসময় সাহিত্যকর্মীদের সাহিত্যচর্চার মৌল অঙ্গন ছিলো সাহিত্যের ছোটকাগজ। তারা গোষ্ঠীভিত্তিক ‘লিটলম্যাগ’ চর্চা করতেন। গোষ্ঠীচর্চাকারী এই সাহিত্যিকরা বিশেষ করে কবি যশোপ্রার্থীরা দৈনিকের সাহিত্যপাতার প্রতি ছিলেন উন্নাসিক। চল্লিশের দশকে এসে নানামুখী হাওয়ার দাপটে অস্থির সময়কে উপজীব্য করে বাংলা সাহিত্য আবারও নতুনভাবে জেগে ওঠে। একদিকে ভারতজুড়ে এক অসুস্থ রাজনীতির উন্মাদ তাল ঠোকাঠুকি এবং তার রক্তাক্ত প্রতিফলন; অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদবিরোধী আন্দোলন ও গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে স্বদেশ ও সমাজচেতনার প্রকাশ। পাশাপাশি সংস্কৃতির নানামুখীচর্চায় স্বদেশিকতা ও সামাজিক মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। এ সময় থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকার সাহিত্যপাতা হয়ে ওঠে আকর্ষণীয় ও উপজীব্য স্থান।

দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা নিয়ে নানাজনের নানা অভিমত থাকতেই পারে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা কর্পোরেট জোনের কাছে সাহিত্যপাতা মূল্যহীন এবং গুরুত্বহীনও হতে পারে। এমনকি সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে কারো কারো নাসিকা উপরের দিকে উঠে যেতে পারে সাহিত্যপাতার স্থান দেয়ার বিষয়ে। এতে অবাক হবার মতো কোন কারণ আমি খুঁজতে যাই না। বরং এটাকে স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে করি। কারণ, অধিকাংশ মানুষ নগদ ফলাফলে বিশ্বাসী। নিউজ ভিউজে টাটকা ফলাফল চোখে পড়ে বেশি। পক্ষাপন্তরে সাহিত্যপাতা খানিকটা তালগাছের মতো। ফল পেতে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি একটা জেনারেশনকে অপেক্ষার তালিকায় রাখতে হয়। এতো ধৈর্য্যশক্তি আমাদের অনেকেরই নেই। তবে যারা বুঝেন তারা ধৈর্য্যশক্তি উৎপাদন করে হলেও অপেক্ষা করেন।

‘দৈনিক সংবাদপত্র’ মূলত বিশ্বের সঙ্গে হাজার চোখে আমাদের সাংস্কৃতিক মিলন ঘটায়। মননশীল পাঠকের বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে। স্থানিক-অস্থানিক, জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিচিত্র সংবাদ-সম্ভার আমাদের মনন সমৃদ্ধ করে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ মানবিক জীবনের হাজারো বিষয়াবলি সম্পর্কে জানার কৌতূহল মেটায়। এরই মধ্যে এক ফাঁকে সাপ্তাহিক অবসরে সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের সাংস্কৃতিক তৃষ্ণাও মেটায়। পরিচয় ঘটায় দেশ বিদেশের সাহিত্যের সঙ্গে। এর মধ্যদিয়ে মেধা-মননের বিকাশ ঘটায় এবং পথনির্মাণের যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব গঠনে ফুয়েল হিসেবে কাজ করে।

নিরেট সত্য কথা যে, অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকার প্রধানতম চিন্তা বাণিজ্য প্রসারের দিকে। কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করে মালিকপক্ষ বাণিজ্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তারপরেও পত্রিকার বিশেষ অংশের প্রতি একটা আলাদা আবেগ কাজ করতো। সংবাদপত্রের বিশেষ অংশটুকুকে আমরা চিনি সাধারণভাবে ‘সাহিত্য-সাময়িকী’ নামে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা-উত্তর পূর্ববাংলায় মূলত পঞ্চাশের দশকে মাত্র দু’-তিনটে পত্রিকায় সাহিত্য-সাময়িকীর প্রকাশ দেখা যেতো। সেগুলো প্রকাশিত হতো দুই পাতার ‘সাপ্লিমেন্ট’ হিসেবে। প্রথম পর্বে ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’ পরে ‘ দৈনিক পাকিস্তান’ এবং ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকা এ ক্ষেত্রে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। পূর্ববাংলার সাহিত্যচর্চার কৈশোর-তারুণ্য পার করছে মূলত কবিতায় ও ছোটগল্পে, অংশত প্রবন্ধে-উপন্যাসে। স্বভাবতই অবজার্ভারের সাহিত্য-সাময়িকীটি সমৃদ্ধ ছিল অনেকাংশে বিদেশি সাহিত্যের মূল্যায়নে। ফলে তরুণ সংবাদপত্র পাঠকের সুযোগ ঘটত বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হবার, বিশেষ করে প্রবন্ধ পাঠে, কবিতা পাঠে কিংবা সমালোচনার ধারালো ভাষ্যে।

আমাদের জানা থাকা ভালো যে, ক্রমশ বামপন্থী ঘরানার কাগজগুলো সাহিত্যপাতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যায়। তারা সেই পত্রিকাকে একটি মিশন হিসেবে চালাতে থাকে। ত্রিশ-চল্লিশ বছরে একটি লেখকগোষ্ঠী তৈরিতে সফল হয় তারা। দীর্ঘ কর্মপ্রয়াসের ফসল হিসেবে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে এখনো তারাই শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। এমন কি ইতিহাস ঐতিহ্য নির্মাণের ধারায় তারাই এখনো বিশাল জনগোষ্ঠীকে নাকে রশি লাগিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক মাঠে কর্মী না থাকলেও দেশ পরিচালনার মৌলমন্ত্র থাকে তাদের হাতেই। ইতিহাসের বয়ান তৈরিতে তারাই সফল হচ্ছে।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি বিপ্লব-সংগ্রামে মুসলমান জনগোষ্ঠীই প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। বক্সার যুদ্ধে মীর কাসিম যে স্বাধীনতার চেতনার সূচনা করেছেন তা এগিয়ে নিয়েছেন শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, ফকির মজনু শাহ-সহ অসংখ্য মুসলিম সংগ্রামী। তারা স্বাধীনতার জন্য জীবন বিলিয়েছেন। এমনকি মুসলমানদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে এগিয়ে নিয়েছে মুসলমানরাই। নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, হাজী মুহম্মদ মহসীন, মন্নুজান, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ-সহ হাজারো মুসলিম মণীষীর উদ্যোগে মুসলমানদের স্বাধীনতার চেতনাকে উজ্জীবিত করেছে। ১৯০৫ সালের বাংলাবিভক্তিকরণ, ১০৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৭ সালের পাকিস্তানের আজাদী, তমুদ্দুন মজলিশের ভাষাসংগ্রাম থেকে চব্বিশের জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত প্রতিটি বিপ্লব সংগ্রামে মুসলমানরা মূল ভূমিকা পালন করলেও বয়ান তৈরি করে চলেছে বামপন্থীরা। অবশেষে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য নির্মাণের তাদের কলমই জয়ী হয়; টিকে যায় মানুষের মগজে। বিশ^াসী ঘরানা বলে পরিচিত মুসলিম ঐতিহ্যের লেখকরা চেষ্টা সাধনা করেও মূলধারার রাস্তায় এখনো স্বীকৃতি পাচ্ছে না। ‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাসে।’

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার বিষয়টি আজও আমাদের মূলধারার মুসলিম জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের মগজে সঠিকভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। এখনো আমরা নগদ লাভে বিশ^াসী। নির্ধারিত ফ্রেমের বাইরে চিন্তা করতে পারি না। দু’দশজন চৌকস মানুষ এ বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারলেও অনেকেই তাদের সামনে বাগড়া দিয়ে বসেন। এ সবের এখন প্রয়োজন নেই। সুযোগ মতো দেখা যাবে। তাদের দৃষ্টিতে সংস্কৃতি চর্চা মানে জনসভা কিংবা কোন অনুষ্ঠানে দুটো হামদ-নাত গাওয়া, কিংবা প্রতিপক্ষকে ব্যঙ্গ করে দু’একটা প্যারোডি পরিবেশন করা। বিশেষ আয়োজনে বিপ্লবী কবিতাপাঠ কিংবা দুই চারটা পোস্টার পেপার ডিজাইন করা। এই অবস্থার কারণে দীর্ঘ পথযাত্রায় এই অঙ্গনে আমরা এখনো মৌলিকভাবে খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারি নি।

ব্যক্তিগত কর্মচঞ্চলতা এবং গুটি কয়েক উদার দৃষ্টিভংগী লালনকারী রাজনৈতিক দায়িত্বশীলের কর্মপ্রয়াসে ইসলামী ধারায় বেশ কিছু লেখক, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী তৈরি হয়েছে। তাদের যোগ্যতার বিষয়েও আস্থা রাখার মতো। কিন্তু এই অঙ্গন নিয়ে সুদূর প্রসারী রোডম্যাপ আজও স্বীকৃতি পায়নি। রাজনৈতিক বিজয়কে ফলপ্রসু করতে হলে এই অঙ্গনের মজবুতির কোন বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ। বিশ^ায়নের এই বাজারে এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা বিশেষ প্রয়োজনীয় বলেই মনে করি।

দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি সারাদেশের বিশ্বাসী মানুষের আস্থা ও আশা-ভরসার স্থল। নীরব বিপ্লবের সাথী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে এর সাহিত্যপাতা। কবি আল মাহমুদের বাঁক-বদল, আবদুল মান্নান সৈয়দের শেকড়ে ফেরা, আফজাল চৌধুরীর সাহিত্য চেতনার বিকাশসহ বিভিন্ন গুণিজনের মিলন-মোহনা এই সংগ্রামের সাহিত্যপাতা।

সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে বড় ধরনের পরিকল্পিত স্পেস প্রয়োজন। সংগ্রাম এগিয়ে যাক সে পথে।

লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর,

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়