DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

নজরুলের গান-কবিতা: মুসলিম প্রসঙ্গ

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের প্রাণের কবি। আমাদের মন ও মানসের কবি। মুসলিম জাতির প্রাণের সঙ্গীতের এক অনন্য স্রষ্টা। শয়নে-স্বপনে যিনি আল্লাহ, রাসুল (সা.), আখিরাত ইত্যাদির বিষয়ে ছিলেন মগ্ন। ইসলামি অনুষঙ্গ, ইসলামের সোনালী অতীত, মানুষদের মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলাম তা তিনি নিজ সৃজনে ধারণ করে আমাদের মননকে শান্তির পরশপাথর ইসলামের মূলকথা নান্দনিক উপস্থাপনাতে ব্যক্ত করেছেন।

Printed Edition
nazf4

মীম মিজান

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের প্রাণের কবি। আমাদের মন ও মানসের কবি। মুসলিম জাতির প্রাণের সঙ্গীতের এক অনন্য স্রষ্টা। শয়নে-স্বপনে যিনি আল্লাহ, রাসুল (সা.), আখিরাত ইত্যাদির বিষয়ে ছিলেন মগ্ন। ইসলামি অনুষঙ্গ, ইসলামের সোনালী অতীত, মানুষদের মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলাম তা তিনি নিজ সৃজনে ধারণ করে আমাদের মননকে শান্তির পরশপাথর ইসলামের মূলকথা নান্দনিক উপস্থাপনাতে ব্যক্ত করেছেন।

নজরুল ইসলাম ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে ছিলেন মহান ইসলামে বিশ্বাসী। নিজ বিশ্বাসের স্বপক্ষে ‘আল্লাহ আমার প্রভু’ কবিতায় তাঁর দ্বিধাহীন ঘোষণা-

“আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়।

আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়-

আমার কিসের শঙ্কা,

কোরআন আমার ডঙ্কা,

ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়?”

নজরুলের সৃজন সম্ভার ইসলামি বিষয়াদিতে ঠাসা। অনুপাতের দিক থেকে তিনি ইসলামকে উচ্চকিত করার আহ্বানই অধিক জানিয়েছেন।

আমরা যদি বিষয়াঙ্গীক দিকথেকে নজরুলের সৃজন সমগ্রকে মূল্যায়ন করি তবে নজরুল যে মুসলিম অন্তপ্রাণ ছিলেন তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তাই বিষয়াঙ্গীকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে নজরুলের মুসলিম মানসের প্রোজ্জ্বল দিকগুলি।

মহান আল্লাহর বন্দনা:

সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের মহান রব। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কে আছে? নেই কেহ দোজাহানে এক আল্লাহ ছাড়া। এই আল্লাহ যদি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হন তাহলে জীবন ধন্য। ইহকালীন ও পরকালীন জীবন হবে সাফল্যম-িত। আমরা আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া মুনাজাত করি-

‘হে আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়ায় কল্যাণ দান করো! আর আখিরাতেও কল্যাণ দান করো! আর জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও!’

তাই সেই আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া পরম ভাগ্য। সেই পরম ভাগ্যই কামনা করেছেন নজরুল গানে গানে-

“রোজ হাশরে আল্লাহ আমার কোর না বিচার

বিচার চাহি না, তোমার দয়া চাহে এ গুনাহগার॥

আমি জেনে শুনে জীবন ভরে

দোষ করেছি ঘরে পরে

আশা নাই যে যাব তরে বিচারে তোমার॥

বিচার যদি করবে কেন রহমান নাম নিলে।

ঐ নামের গুনেই তরে যাব, কেন এ জ্ঞান দিলে!

দীন ভিখারি বলে আমি

ভিক্ষা যখন চাইব স্বামী

শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে পারবে না কো আর।।”

আমরা জানি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার মোট ৯৯টি গুণবাচক নাম আছে। এ নামগুলোতে কীযে মধুরতা যা একজন প্রকৃত আল্লাহ ভীরু মানুষেই জানে। আমাদের রিজিকদাতা মহান আল্লাহকে উপর্যুক্ত নামগুলি ছাড়াও এক বিশেষ নামে নজরুল ডেকেছেন। আর সেই ডাকটি ছিল ‘অ-নামিকা’। ‘ঝড়’ গ্রন্থের ‘অ-নামিকা’ কবিতায় কবি লিখেছেন-

“কোন নামে হায় ডাকব তোমায়

নাম না জানা অ-নামিকা

জলে স্থলে গগন তলে

তোমার মধুর নাম যে লিখা।।”

আমাদের প্রাণের কবি নজরুল আমাদের রবের শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনার পাশাপাশি তাঁর সৌন্দর্যও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি ‘গুলবাগিচা’র ৬৪ নং সংগীতে লিখেছেন-

“হে চির-সুন্দর, বিশ্ব চরাচর

তোমার মনোহর রূপের ছায়া,

রবি শশী তারকায় তোমারই জ্যোতি ভায়

রূপে রূপে তব অরূপ কায়া।”

নজরুল তাঁর বিশ্বাসের বিষয়ে কোন রাখঢাক না করে দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা দিচ্ছেন ‘মহা সমর’ কবিতার প্রথম দুই চরণে এভাবে-

“তৌহীদ আর বহুত্ববাদে বেঁধেছে আজিকে মহাসমর

লা শরীক এক হবে জয়ী কহিছে আল্লাহ আকবর‘।”

নজরুল একজন মুসলিম ছিলেন। তাই তিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা করতে পারেন না। আর সেটা তাঁর পাঠককূলকে জানাচ্ছেন এভাবে-

“ও মন, কারো ভরসা করিসনে তুই

এক আল্লাহর ভরসা কর,

আল্লাহ যদি সহায় থাকেন

ভাবনা কিসের, কিসের ডর।”

নজরুল আরো বলছেন-

“মুখেতে কলেমা হাতে তলোয়ার

বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার

হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর

চল আগে চল বাজে বিষাণ”

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ (সা.) এর বন্দনা:

নিখিল ধরার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর আদর্শেই মানুষ খুঁজে পায় ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। যিনি অনাচার, ব্যাভিচার, অত্যাচার, গোমরাহির অতল গহ্বর থেকে মানুষ জাতিকে দেখিয়েছেন সোনালী রশ্মির পথ। তাঁকে (রাসুলকে) ভালোবেসেছেন আমাদের বাঙালি-মুসলিম জাতিসত্তার কবি। মননের অনেকখানি জায়গাজুড়ে রাসুল (সা.) এর প্রেম জাগরূক ছিল। বিশ্বের অপরাপর নামকরা মুসলিম কবি ও গায়কগণ যেরূপ আমাদের প্রিয়নবিকে স্তুতি করে কাব্য ও গান লিখেছেন তদ্রুপ নজরুলও বাংলায় অনতিক্রম্য নাত এবং কবিতা লিখেছেন। যা একজন মুসলিম মানস হিসেবে প্রাধান্য পায়।

আমাদের নবি করিম (সা.) এর আগমনে যেমনটি সারা জাহান খুশি হয়েছিল। তেমনটি খুশি হতে দেখা গেছে নবির জন্মের ১৩২৯ বছর পর শ্যামল বাংলায় জন্মনেয়া নবিভক্ত নজরুলের সৃজনেও। নজরুল লিখছেন-

“নিখিল ঘুমে অচেতন সহসা শুনিনু আজান

শুনি সে তকবীরের ধ্বনি আকুল হল মনপ্রাণ

বাহিরে হেরুনু আসি , বেহেশতের রৌশনীতে রে

ছেয়েছে জমিন ও আসমান।

আনন্দে গাহিয়া ফেরে ফেরেশ্তা হুর গেলমান।”

যে নবির আগমনে কবির হৃদয় উদ্ভাসিত হয়েছিল আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। সে নবির প্রয়াণে কবির হৃদয়ে বিস্ফারিত হয়েছিল মহাকালের আর্তনাদ, বেদনা, বিধুরতা। তা প্রকাশে লিখছেন-

“হায় হায় উঠেছে মাতম

আকাশ পবন ভুবন ভরি ,

আখেরি নবী দীনের রবি নিল বিদায়

বিশ্ব নিখিল আঁধার করি।।

অসীম তিমিরে পুণ্যের আলো

আনিল যে চাঁদ সে কোথায় লুকালো

আকাশ ললাট হানি কাঁদিতেছে মরুভূমি

শোকে গ্রহ তারা পড়িছে ঝরি।।”

আমাদের সেই পরম শ্রদ্ধেয় রাসুল (সা.) এর রেখে যাওয়া সুন্নত অনুসরণই আমাদেরকে নিয়ে যাবে অনিঃশেষ সুখের স্থান জান্নাতের দিকে। আল্লাহ, তাঁর কিতাবের পরই হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্মানীয়। তাই রাসুলের কোনো সুন্নত যদি হয় অবহেলিত অথবা জ্ঞানপাপী নাস্তিকদের দ্বারা যদি হয় অপমানের শিকার তবে আমাদের কলিজা নীল হয়ে যাওয়ার কথা। আর যদি কলিজা নীল তথা ওদের প্রতি ঘৃণা, ক্ষোভে আমাদের ভিতর তেমন কোনো রাসুলভক্তি কাজ না করে তবে নজরুল তাকে মুসলিম হিসেবে মেনে নিতে চাননি।

মুসলিম মানেই রাসুলের প্রেমে দেওয়ানা। রাসুলের সাথে যদি কারো ঈমানের সহিত দেখা হতো আর যদি তিনি সেই ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করতেন তবে তিনি সাহাবা হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পাবেন আল্লাহর কাছে। সেরকম মর্যাদা লাভের সৌভাগ্য আমাদের এই শ্যামল বাংলার বুলবুলের হয়নি। তিনি তাই হতে চেয়েছিলেন মদিনার পথঘাট, ধূলিকণা। কেননা তার উপর দিয়েই কল্যাণের নবি হাঁটাচলা করতেন। সেই মহান পদের ছোঁয়ায় ধন্য হতেন কবি। সেটাই হতো তাঁর পরম সুখ। কল্পনা করুণ তো, কতটা নবিপ্রেম সত্তার ভিতর ধারণ করলে এরকমটি ভাবা যায়! নজরুল বলেছেন-

“আমি যদি আরব হতাম মদীনারই পথ,

সেই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হযরত।

পয়জার তার লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে,

আমি ঝর্না হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে।”

  • সামগ্রিক জীবনের শিল্পীকবি নজরুল ইসলাম তাঁর একমাত্র আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী বিশ্বমানবের অকৃত্রিম বন্ধু রাসুল মুহাম্মদ (সা.) কে। রাসুলের শানে এত নাত ও গীত রচনার পেছনে বিদ্যমান ছিল রাসুলের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা। তিনি রাসূল (সা.) কে শ্রেষ্ঠতম গুরু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁ’র সাথে নজরুলের একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। শিল্প-সাহিত্যের নানা বিষয়াদিসহ ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ভালোলাগা ইত্যাদি নিয়ে চলতো আলাপন। এরকম আলাপনের একটি চিঠিতে নজরুল লিখেছিলেন-

“আমার শ্রেষ্ঠতম গুরু যিনি, সেই হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর কথা মনে করুন। তিনি মে’রাজে গেলেন কিন্তু ধরার ধুলাকে ভুললেন না, ফিরে এলেন। কত গওস, কুতুব, ঋষি পয়গম্বর সে মহান সুন্দরের পরম আকর্ষণে নিজকে সম্পূর্ণ বিকিয়ে বিলিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমার রাসূল সে আকর্ষণের চুম্বক খ-কে বুকের তলে পুষে নিয়ে ফিরে এসেছেন তাঁর সঙ্গে আর সবাইকে সেই সুন্দরের পথে ডেকে নিয়ে যেতে। আমিও তাই করতে চাই।”

নামাজ বিষয়ক চিন্তা:

নজরুল ধর্মভীরু কবি, গায়ক এবং মানসের অধিকারী ছিলেন। ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলির প্রতি আন্তরিক ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল তাঁর উল্লেখ করার মতো। যেমনটি ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ নামাজের বিষয়ে নজরুলের গায়কী মনের আকুতি ছিল-

“হে নামাজী! আমার ঘরে নামাজ পড় আজ।

দিলাম তোমার চরণ-তলে হৃদয় -জায়নামাজ।

আমি গুনাহগার বে-খবর, নামাজ পড়ার নাই অবসর

(তব) চরণ-ছোঁয়ায় এই পাপীরে কর সরফরাজ।।

তোমার ওজুর পানি মোছ আমার পিরান দিয়ে

আমার এ ঘর হোক মসজিদ তোমার পরশ নিয়ে।

যে শয়তানের ফন্দিতে ভাই,

খোদায় ডাকার সময় না পাই

সেই শয়তান যাক দূরে, শুনে তকবীরের আওয়াজ।।”

এছাড়াও নজরুল তাঁর আরেক সংগীতে ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে গেয়েছেন-

“নাই হল মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার।

আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার।।

নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি

ওতেই আমায় মানায় ভারী

কলমা আমার কপালে টিপ, নাই তুলনা তার।।”

এখানে মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার পাশাপাশি রাসুল পাক (সা.) এর অবস্থান নির্ধারণ করেছেন মুসলিম মানসের অনন্য নজরুল। নামাজ ও রোজাকে তিনি কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন তা অনুমেয়।

পরকালীন চিন্তা:

একজন মু’মিন সদা-সর্বদা তার পরকালীন মঙ্গল চিন্তায় থাকেন মগ্ন। কেননা সে জগতে নিজ আমল ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। মানুষ মরণশীল। আর মারা গেলেই তাকে করা হবে সমাহিত। মৃত্যুবরণের সাথে সাথেই মানুষের সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩টি আমল বন্ধ হয় না- ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. এমন জ্ঞান (ইলম)- যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ও ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দোয়া করে। সহিহ মুসলিম : ৪৩১০

অর্থাৎ নিজের কিছুই করার থাকে না। মুমিনগণ যদি মৃত মুমিনদের জন্য দুয়া করেন সেটাও হবে পরম পাওয়া। সেই দুয়ার বদৌলতে আল্লাহ চাহে তো মাফ করতে পারেন। আর যদি চোখের সম্মুখে কোনো কবর থাকে তাহলে সেই কবরবাসীর জন্য মনের অজান্তেই দুয়া চলে আসে নামাজি ব্যক্তির। এরকমটিই বুঝে আমাদের পরকালে বিশ্বাসী কবি নজরুল গেয়েছিলেন-

“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।

যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।।

আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,

পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।

গোর আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।”

একজন খাঁটি মুসলিমের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায়:

পৃথিবী মোহাবিষ্ট যত নেতিবাচক বিষয়াদিতে। আমরা যারা ঈমানদার তাদের চরম প্রকাশ্য শত্রু বিতাড়িত শয়তান। এই শয়তান সদা তৎপর আমাদেরকে ঈমানের পথ থেকে চ্যুত করতে। কিন্তু আমাদেরকে শয়তানের মন্ত্রণার ফাঁদে পা দিলে চলবে না। আমাদেরকে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। সাময়িক দুঃখ যাতনা আসবে। আসবে দারিদ্র্যের কষাঘাত। তবুও যেন আমরা ইসলামের বাইরে না যাই। আমরা যেন না করি নিজেকে সমর্পণ শয়তানি ফাঁদে। আল্লাহর কাছে যেন মাগি সবি। কেননা তিনিই দিবেন। নজরুল তাই উচ্চকিত করে বলছেন-

“খোদা এই গরীবের শোন শোন মোনাজাত।

দিও তৃষ্ণা পেলে ঠান্ডা পানি, ক্ষুধা পেলে লবণ-ভাত।।

মাঠে সোনার ফসল দিও,

দিও গৃহ ভরা বন্ধু প্রিয়, দিও হৃদয় ভরা শান্তি দিও

(খোদা) সেই তো আমার আবহায়াত।।”

আমাদের নবি করিম (সা.) আমাদের জন্য পবিত্র দু’টো কল্যাণকর উৎসব উপহার এনেছেন আল্লাহর কাছ থেকে। এই ঈদ যেমনটি আনন্দের, উৎসবের, তেমনটি অন্যকে সেই আনন্দে অংশীদার করাতেও আনন্দ। এটা কোনো অনুগ্রহ নয় অন্যদের তথা গরীব-দুঃস্থদের প্রতি। এটা তাদের অধিকার। ঈদ আসলে আমাদের মধ্যে যে আনন্দের বিরাজমান তা রোজা, ফিৎরা বা কুরবানি করার সাথে সম্পর্কিত। এই রোজায় উপলব্ধি হয় গরীবদের কায়-ক্লিষ্টের জীবন। আমরা কতটা আল্লাহর নেয়ামতে তার উপলব্ধিও এই রোজা। একজন মুসলিমের গায়ক ও কবির পক্ষেই সম্ভব উপর্যুক্ত বিষয়াবলির উপর মনোহরী সৃজন রেখে যাওয়া। নজরুল সেরকমই একজন শিল্পমানস ছিলেন বলে লিখেছেন-

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আসমানি তাগিদ।।

তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহেলিল্লাহ্।

দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ্।।

আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে।

যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।।”

ইসলামের অন্যান্য অনুষঙ্গ বিষয়ক বন্দনা:

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান। এখানে তাই আছে একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, পরিণত বয়স, মধ্যবয়স, বৃদ্ধ বয়সের প্রয়োজনীয় সকল বিধিবিধান। আছে আর্থিক বিধান, সাংস্কৃতিক বিধান প্রভৃতি।

এই ইসলাম ধরা মাঝে আসেনি শুধু মুসলিমের জন্য। এ ইসলাম এসেছে সবার কল্যাণের জন্য। এই কল্যাণরাষ্ট্রই রাসুলে আকরাম (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সেখানে ছিল সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য শান্তির ব্যবস্থা। তারা থাকতো নিরাপদে। এ জন্যই ইসলাম সার্বজনীন। নারীকে সর্বপ্রথম ইসলামই দানিয়াছে সম্মান। ইসলামি মননের গীতিকার নজরুল তাই ‘শহীদী ঈদগাহে দেখ’ নামক গীতিতে সুরে সুরে গেয়েছেন-

“কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি’ক ইসলাম

সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তা’রি নাম।

আমিরে ফকিরে ভেদ নাই, সবে ভাই সবে এক সাথী।

আমরা সেই সে জাতি।।

নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নরসম অধিকার

মানুষের গড়া প্রাচীর ভাঙিয়া করিয়াছি একাকার,

আঁধার রাতের বোরখা উতারি’ এনেছি আশার ভাতি।

আমরা সেই সে জাতি।।”

ইসলামের মূল আলোচ্য বিষয় মানুষ। কুরআনের মূল আলোচ্য বিষয়ও মানুষ। এই মানুষের নানাবিধ কার্যক্রম কিভাবে পরিচালিত হবে। মানুষের মর্যাদা কিরূপ হবে ইত্যাদির স্পষ্ট সমাধান আছে ইসলামে। আর ইসলামের অন্যতম প্রচারকারী কবি নজরুল ইসলামও তাঁর কবিতায় মানুষকে করেছেন ধারণ। আমাদের ইসলামের অতি আধুনিক ব্যাখ্যাকারী কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘মানবতাকে সম্মান করার ভিতরেই মানবতা, মানবতার মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞাত হও!’ নজরুলও শান্তির ধর্ম ইসলামের সেই বাণীকে উচ্চকিত করেছেন তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতায়-

“গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান!

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”

ইসলাম বরাবরি অসাম্য, জুলুম ও শ্রেণিবিভেদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রতিষ্ঠা করেছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। আর নজরুল সেই ইসলামের ঘোর সমর্থক। তাই ‘ঘোষণা’ শীর্ষক গানে গাইছেন-

“মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,

কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন-

এ জুলুম সহেনিক ইসলাম,

সহিবে না আজও আর।।”

ইসলাম আসলেই সবার অধিকার সংরক্ষণ করেছে। কেননা মহান আল্লাহতায়ালা কোনো ব্যক্তির উপর অন্য ব্যক্তির যে অধিকার আছে তা সংরক্ষণ করেছেন কঠোরভাবে। অধিকারী ব্যক্তি যদি মাফ না করে তবে আল্লাহ মাফ করবেন না। ইসলামের এই সুমহান বাণী প্রচারার্থে মানুষকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে নজরুল তাঁর ‘একি আল্লাহর কৃপা নয়’ কবিতায় লিখেছেন-

“তাঁর সৃষ্টিরে ভালোবাসে যারা, তারাই মুসলমান,

মুসলিম সেই, যে মানে এক সে আল্লাহর ফরমান।”

আমরা আল্লাহর পেয়ারা রাসুল (সা.) এর পর চার খলিফাকে প্রাধান্য দেই। তাদের চারজনের আদর্শ আমাদের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মানিয়ে চলতে চাই। নবি করিম (সা.) এরপরে তাদের নামই উদাহরণ হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। তাদের মর্যাদাও অধিক। ইসলামি মূল্যবোধ সম্পন্ন কবি হবেন অথচ এনাদের স্তুতি নিয়ে কোবিদ মননের ছন্দ ঝংকৃত হবে না, তা একবারেই বেমানান। নজরুলের কবিতায় সাহাবা কেরামের কীর্তির উজ্জ্বল উপস্থিতি। যেমনটি ‘খেয়াপারের তরুণী’ কবিতার কিয়দংশ-

“আবু বকর উসমান উমর আলী হায়দর

দাঁড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর।

কা-ারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,

দাঁড়ি মুখে সারি গান-লা শরীক আল্লাহ্!”

আবার অর্ধজাহানের পরম

ন্যায় শাসক আমিরুল মুমিনের বিশেষ স্তুতিতে কবির কলম হয়েছে সরব। আজানের ধ্বনির প্রবক্তা সেই দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) এর মহিমা বর্ণনায় ‘উমর ফারুক’ কবিতায় নজরুল ঘোষণা করেছেন-

“তিমির রাত্রি ‘এশা’র আজান শুনি দূর মসজিদে

প্রিয়া-হারা কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়া বিঁধে!

আমির-উল-মুমেনিন,

তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন!

তকবির শুনি শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,

বাতায়নে চাই উঠিয়াছে কি রে গগনে মরুর শশী?

ও-আজানা ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?

মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ও কি ও তোমারই সে আহ্বান?

আবার লুটায়ে পড়ি!

‘সেদিন গিয়াছে’ শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি!”

আমরা নজরুলের সারাজীবনের যদি ব্যবচ্ছেদ করি তাহলে পাব যে, নজরুল তাঁর কিশোর বয়সে কুরআন, হাদিস, ফিকহ, ধর্মতত্ত্ব, সুফিজম ইত্যাদি নিয়ে পড়াশুনো করেছিলেন। নিজ পিতামহ ও পারিবারিক গ-ির প্রায় সকলেই মসজিদ-মাদরাসা, মাজারের খাদেম ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর দুখু মিয়াও কিছুদিন এই মক্তবে শিক্ষকতার পাশাপাশি খাদেম হিসেবে খেদমত করেন উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির। সেখানেই আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষা রপ্ত করেছিলেন।

পরে সেই ভাষার প্রতি প্রবল আকর্ষণ তাকে হাফিজ শিরাজীর দিওয়ান আর খৈয়ামের রুবাইয়াত অনুবাদে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃতই নজরুল কাব্য ও মানসে উভয় বিখ্যাত ফারসি কবি ও তাদের আধ্যাত্মিকতার ব্যাপক ছাপ পরিলক্ষিত হয়।

এছাড়াও তিনি পবিত্র কুরআন শরীফের পদ্যানুবাদ করাকে তাঁর জীবনের বড় সাধ বলে জানতেন। একজন মানুষ আল্লাহর নাজিলকৃত মহাপবিত্র আল-কুরআনের প্রতি কতটুকু সম্মান-শ্রদ্ধা থাকলে এরকম সাধ মনের মাঝে লালন করে। যেমনি তিনিই লিখছেন ‘কাব্য আমপারা’র ভূমিকাতে-

“আমার জীবনের সব চেয়ে বড় সাধ ছিল পবিত্র কোর-আন’ শরীফের বাংলা পদ্যানুবাদ করা। সময় ও জ্ঞানের অভাবে এতদিন তা করে উঠতে পারি নি। বহু বছরের সাধনার পর খোদার অনুগ্রহে অন্তত পড়ে বুঝবার মতও আরবি-ফার্সি ভাষা আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি।”

নজরুল জীবনের প্রারম্ভ যেমন ইসলামি বিষয়-আশয় নিয়ে শুরু। তেমনি তাঁর শেষ জীবনের (তিনি ১৯৪২ সালে পিকস ডিজেজে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বাকরূদ্ধ থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবন) রচনাসমূহও ইসলামি ভাবধারা, বিষয়পুষ্ট ছিল। তাঁর তিনহাজার সংগীতের মধ্যে সাতশতই হচ্ছে ইসলামী সংগীত।

তাই নজরুল একজন কবি হিসেবে অনন্য মুসলিম মানুষ। একজন গায়ক বা গীতিকার হিসেবে প্রায় অনতিক্রম্য অমূল্য ইসলামি সংগীতের ¯্রষ্টা।

আসুন, আমরা সব অনাচার, পাপাচার, কূপম-ূকতা, ধর্মের নামে ব্যবসা, মুসলিমদের অলসতা আর বিধর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে ধুকে ধুকে ধ্বংস হওয়ার কালে নজরুলের মুসলিম মানসের সৃজনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওমরের মতো সাহসী হয়ে হেরার রাজ কায়েম করি! যেমনটি আলোকের পথের অন্যতম সিপাহশালার হযরত ওমর করেছেন। আর সেই সময়ের আহ্বান আজো সামসময়িক হয়ে হয়েছে কালোত্তীর্ণ। নজরুল তাঁর ‘উমর ফারুক’ কাব্যে সে কথাগুলোই তুলে ধরেছেন-

“উমর ফারুক! আখেরি নবির ওগো দক্ষিণ-বাহু!

আহ্বান নয় রূপ ধরে এসো! গ্রাসে অন্ধতা-রাহু

ইসলাম-রবি, জ্যোতি আজ তার দিনে দিনে বিমলিন!

সত্যের আলো নিভিয়া জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ!”

তবে কি আমরা জাগবো না? ইসলামের আলো জ্বালাবো না? ক্ষীণ হয়ে থাকবে কি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলোটি?

ঋণ স্বীকার

১. নজরুল রচনাবলী (১ম থেকে ৫ম খ-), বাংলা একাডেমী। নতুন সংস্করণ: মে ১৯৯৩;

২. নির্বাচিত নজরুল শিশুসাহিত্য, ড. করুণাময় গোস্বামী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, প্রকাশ সাল-২০০০ সাল;

৩. নজরুলের কাব্যানুবাদ; নজরুল ইনস্টিটিউড, ঢাকা, ষষ্ঠ মুদ্রণ, প্রকাশ- জানুয়ারি-২০১৮;

৪. নজরুল সাহিত্যে ইসলামী সমাজ; নাসির হেলাল, নজরুল ফাউন্ডেশন, ঢাকা, প্রকাশ- ২০১৬;

৫. নজরুল সাহিত্য দর্শন, শাহাবুদ্দীন আহমদ, রেয়ার বুকস, বাংলা বাজার ঢাকা, প্রকাশ- বইমেলা-২০০৩;

৬. নজরুল ইসলাম: ইসলামী কবিতা, আব্দুল মুকিত চৌধুরী (সম্পাদিত), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, চতুর্থ সংস্করণ, জুন-২০০৫;

৭. ঘধুৎঁষ, ঐধভরু ধহফ ঋরৎফধঁংর ঈড়সসবসড়ৎধঃরড়হ ঠড়ষঁসব, উযধশধ টহরাবৎংরঃু, গধু ২৪, ২০১৫ ্ ২০১৬;

৮. ঘধুৎঁষ: ঞযব এরভঃ ড়ভ ঃযব ঈবহঃঁৎু, জবুধঁষ ক. ঞধষঁশফধৎ, এধহঃধননধ চৎড়শধংযড়হর, উযধশধ, ঔঁহব ২০০৭;

৯. নজরুল কাব্যের শিল্পরূপ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, প্রকাশ- ফেব্রুয়ারি ২০০৭;

১০. মনসুর আহমদ, নজরুল কাব্যে রাসূল (সা.) প্রসঙ্গ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ঢাকা, প্রকাশের তারিখঃ ১৬.১০.২০১৫

লেখক: প্রবন্ধকার, গবেষক, অনুবাদক ও শিক্ষক