শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

একাত্তরের একটি রাত

সোলায়মান আহসান

সেদিন একজন প্রশ্নকর্তা জানতে চাইলেন- আপনি তো একাত্তর দেখেছেন, সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেনÑ আপনার লেখায় একাত্তর কিভাবে এসেছে, জানান।

এমনতর প্রশ্ন এর আগেও আমার প্রতি করা হয়েছিল। জবাব দিয়েছি। সে জবাবে ছিল কিছু রাখঢাক। চালাকি। এ রকম কথাকে চালাকি অতিকথন অনেকেই করে থাকেন, করেছেন। এবার ভাবলাম- না, রাখঢাক আর করব না, চালাকির আশ্রয় নেব না। যা জানি, যা লিখেছি তা সব বিস্তারিত বলে দিই।

বললাম, শুনুন! একাত্তর আমাদের জাতীয় জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়! খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ঘটনাপ্রবাহ। যখন লিখতে শুরু করি তখন মনে হয়েছে এতো বড় ক্যানভাসÑ আমার দ্বারা এর ছবি আঁকা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই, কি লিখব! কী লিখে আমার দেখা একাত্তরকে মহিমান্বিত করতে পারি! দ্বিধাবোধ করেছি।

হ্যাঁ বলুন, তারপর কি লিখলেন? প্রশ্নকর্তা নড়েচড়ে বসলেন। আমার মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড।

বিব্রত বোধ করে বললাম, আপনার প্রশ্নের দুটো অংশ- একটা আমার একাত্তরের সংশ্লিষ্টতা, আরেকটা অংশ লেখক হিসেবে দায়িত্ব পালন কিভাবে করেছি।

আমি বিলক্ষণ জানি প্রশ্নকর্তার ধৈর্য্যে কুলাবে না আমার সব কথা শোনার। আমি ভাবছিলাম কিভাবে সংক্ষিপ্ত করব আমার বক্তব্য।

আপনি বরং একাত্তরের একটা গল্প শোনান। তাতেই আমি খুশি। আমিও মনে মনে খুশি হলাম। অনেক প্রিয়-অপ্রিয় প্রসঙ্গ না বলে বাঁচা যাবে। না, এখানে বাঁচা-মরার প্রশ্ন নয়।

একাত্তর নিয়ে অনেকে লিখেছেন। কেউ প্রত্যক্ষ দেখে লিখেছেন। কেউ শুনে শুনে। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন নিয়েও লেখা হয়েছে। কিন্তু আমি এমন একজন সম্পর্কে বলব, তাকে নিয়ে কেউ কিছু লিখেছেন এমনটা জানা নেই আমার। এ রকম অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাহিনি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি।

আমি একাত্তরে জামালপুর ছিলাম। না, আমার জন্মভূমি নয়। বাবার চাকরির সুবাদে ছিলাম। ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা বয়ে যাওয়া পাশে জামালপুর শহর। তখন জেলা নয় মহকুমা। একটা গ্রাম্য পরিবেশ ছিল। শহরের বৈশিষ্ট্য হলোÑ বড় বড় বকুল আর কালোজাম গাছের শহর। একটা মায়াময় পরিবেশ। সবাই সবাইকে চেনে। দেখা হলে কুশল বিনিময় করে।

আখলাক ভাই, ভূমিকাটা ছোট করেন, গল্পটা শুরু করেন।

বোঝা গেল আমীরুলের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে।

শোন, তখনও যুদ্ধটুদ্ধ লাগে নাই। ২৫ মার্চের ঢাকায় পাক আর্মির পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা ভার্সিটিসহ বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত হামলার ঘটনা বিবিসির মাধ্যমে গোটা দেশবাসী জেনে গেছে। ঢাকা থেকে পাক আর্মি মুভ করছে। বিভাগীয়, জেলা, মহকুমা শহরের দিকে। কোথাও প্রতিতরোধের চেষ্টা, কোথা গা ঢাকা দিয়ে থাকা, পরে প্রতি আক্রমণের প্রস্তুতি। আমার বন্ধু খালেদ রাতে আমার বাসায় এলÑ চল্ ওই পাড়ে যাইÑ সবাই যাচ্ছে। এখানে থাকলে বাঁচবি না।

কিভাবে যাব? আমার প্রশ্ন।

একটা ব্যবস্থা হবে। খালেদের মনে দৃঢ় প্রত্যয়। তার উৎসাহ প্রাণ চাঞ্চল্য দেখে আমিও রাজি হলাম। ঠিক হলো আগামী মধ্যরাতেই ঘুমিয়ে পড়া শহর ছেড়ে আমরা রওনা দেব।

তারপর? এই তো জমে উঠেছে গল্প।

বাসা থেকে বের হলাম এ কথা বলে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য। তখন আমার মতো যুবকরা এর ওর বাসায় রাত কাটাত। পাক আর্মির ভয়ে। তাই আমার অন্য স্থানে রাত কাটানো প্রস্তাব শুনে কেউ কোনো বাধা দিল না।

মধ্যরাত অবধি কাটালাম আরেক বন্ধুর বাসায়। আমার বাসার সামনে শহরের মেইন রোড। রাস্তার ওপাশে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পেছনে বন্ধু শাকুরের বাসা। সেখানে গিয়ে উঠলাম সন্ধ্যা রাতের পর। রাতের খাওয়া হলো। বন্ধুকে কিছু বললাম না। শুধু জানালাম থাকতে আসিনি। মধ্যরাতে বের হয়ে যাব।

সেভাবে বের হলাম। বন্ধুটি সন্দেহ করেছিল আমি হয়তো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ওপারের উদ্দেশে যাচ্ছি। কিন্তু সরাসরি প্রশ্ন করেনি।

একটা পাটের ব্যাগে একটা লুঙ্গি একটা গামছা আর দাঁতের মাজন নিয়ে বের হয়ে পড়লাম পথে। রাস্তায় তখন মানুষ চলাচল নেই। কয়েকটা কুকুর। কেউ রাস্তার মাঝখানে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে আরামসে শুয়ে। আর একটা কুকুরির পেছন পেছন দুটো কুকুর হাঁটছে। না, হাঁটছে না দৌড়াচ্ছে। আমাকে দেখে ওরা বিস্ময় মিশ্রিত চোখে দেখল। এতো রাতে রাস্তায় আদম সন্তান কেন। এতো রাতে আদম সন্তান রাস্তায় থাকে- হয় চোর নয়তো নেশাখোর। কিন্তু দিনকাল এতো উদ্বেগের মধ্যে যাচ্ছে ওরাও আজকাল থাকে না।

কুকুর কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝে। ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ দেখেই বুঝে নেয়।

ঠিক বলেছ আমীরুল, আমাকে কুকুরগুলো কিছু বলল না। আমি হাঁটতে থাকলাম। দূর থেকে একটু পর শেয়ালের ডাক শুনতে পেলাম। পেঁচক পাখির ডাকও তার সঙ্গে মিশে রাতের এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করল। খালেদ বলেছিল আর্মির গাড়ি নাকি টহল দেয় মাঝে মাঝে। দেখেশুনে চলতে। একান্ত আর্মির টহল গাড়ির সামনে পড়লে দাঁড়িয়ে যেতে। যদি গাড়ি থেমে জিজ্ঞেস করেÑ বলতে হবে নজদিক যায়েঙ্গেÑ আত্মীয়কা ঘরমে। বিমারি হ্যায়।

সে রকম গাড়ির সম্মুখীন হতে হয়েছিল কি? আমীরুলের কণ্ঠে ভয় মিশ্রিত প্রশ্ন।

না। আমার বরাত ভালো ছিল। কোনো আর্মির গাড়ি আমার সামনে পড়েনি। হাঁটতে হাঁটতে যখন বকুলতলা মোড় এলাম তখন দু’জন নাইটগার্ডের সাক্ষাৎ পেলাম। এরা আনসার। দেশের পরিস্থিতি ভালো নয় বলে আনসারদের পাহারা দিতে প্রশাসন নিযুক্ত করেছে। হাতে মোটাসোটা লাঠি। কিছু বলল না। বকুলতলায় একটা কালিমন্দির আছে। সাধারণত সারারাত পূজা-আচ্চা হয়, ঠুং ঠুং করে কাঁসার শব্দ বাজে। কোনো শব্দ নেই। হিন্দুরা পালিয়েছে। পূজা করবে কে। মন্দিরের পাশে একটা পানবিড়ির দোকান- প্রায় সারা রাত খোলা থাকে। পানবিড়ির অন্তরালে নেশা জাতীয় অন্য কিছু বিক্রি হয়। তাও বন্ধ। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদ মেঘের অন্তরালে। অমাবশ্যা নয়, তবে প্রচুর মেঘ জমেছে। ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি হতে পারে।

আখলাক ভাই, মূল গল্পটা বলে ফেলুন- তাড়া আছে।

এতক্ষণ যা বললাম তা না বললে বুঝবে কিভাবে কোন পরিবেশ-পরিস্থিতির ভেতর গল্পটা সংঘটিত হয়েছিল।

ঠিক বুঝতে পারছি না আপনার গল্পটা কতটুকু সময় নেবে। ঠিক আরো অনেক সময় লাগে, তবে আজ এখানে থাক।

কী অধৈর্য্য হয়ে গেলে এতো জলদি! তোমার মতো অনেক লোক আছে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গল্প শুনতে চায় না। যুদ্ধের কাল্পনিক গল্পটা শুনতে ভালোবাসে। যুদ্ধের আগে ও পরের ঘটনা থাকে মানবিক বিষয়-আশয় থাকে তা জানতে চায় না। নয় মাসের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নানাভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের গল্প জানতে চায় না। কতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লড়াই না করেও জীবন দিতে হয়েছে। তাদের কথা কেউ বলে না। যুদ্ধের পরও কতো হারানোর বেদনা সহ্য করেছেÑ তা জানতে চায় না।

আখলাক ভাই, আপনার কথা ঠিক তবে এজন্য আমরাও দায়ী। আপনি কি লিখেছেন আপনার জীবনের গল্প? আজ আপনাকে প্রশ্ন করায় কিছু বলছেন।

কেউ শুনতে চায়নি। শুনতে চায় না। শুধু ইনিয়ে বিনিয়ে কল্পনার আশ্রয়ে গল্প বানানো।

আখলাক ভাই, তারপর ওপারে কিভাবে গেলেন?

শোন আমীর, সে রাতটি আমার জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ- খালেদের কথায় সে রাতেই শহর না ছাড়লে আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া হয়তো হত না। কারণ পাক আর্মি খুব দ্রুত বর্ডার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল।

তারপর?

তারপর ওই অন্ধকার রাতে হেঁটে হেঁটে খালেদের বাড়ি শেখের ভিটা পৌঁছলাম। আমার বাসা থেকে শেখের ভিটার দূরত্ব সাড়ে তিন মাইল হবে। রেল লাইন পার হবার সময় দু’জন লোকের সঙ্গে দেখা। এরা নেশাখোর লোক বলেই মনে হলো। একজন প্রশ্ন করল- ক্যাডা যায়- কোন বাড়ি- জবাবে বললামÑ মুন্সিবাড়ি। আর কিছু বলল না। খালেদের বাড়ি ওই গ্রামে। মুন্সিবাড়ি হিসেবে বিখ্যাত। খালেদের বাবা মসজিদের ইমাম।

তারপর? খালেদের ঘর মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে। আফ্রিকার নিয়ম অনুসারে খালেদদের পরিবারেরও নিয়ম ছেলে লায়েক হলে আলাদা ঘর করে থাকতে দেয়া। তাই, খালেদের ঘরের কাছে এসে ডাক দিলাম- এ্যাই খালেদ- এক ডাকেই খালেদ খুলে দিল দরজা। তার মানে সে জেগে জেগে আমার অপেক্ষা করছিল।

আইছস বন্ধু! খালেদ বুকে জড়িয়ে ধরল। চল চাইট্টা খাইয়া লই। আর কবে পেটে ভাত পড়ব আল্লা জানে। শুকনা চিড়া আর গুড়ই সম্বল।

খাওয়া-দাওয়ার পর অন্ধকার পথে রওনা দিলাম দুই বন্ধু।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ