বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ডায়াবেটিসকে বশে রাখুন

বর্তমানে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও গর্ভবতী-সবাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে কারও না কারও ডায়াবেটিস। এ রোগের বৃদ্ধির হার যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে প্রতিটি পরিবারের সবাই হয়তো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন। নবাগত শিশুও জন্মলাভ করতে পারে ডায়াবেটিস নিয়ে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডায়াবেটিসে। এ রোগের জটিলতা অনেক। উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, পায়ে সংক্রমণ, চক্ষুরোগ, কিডনি রোগ ও সেক্সচুয়াল সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। বলা যায়, ‘ডায়াবেটিস নিজে মারে না, মারে এর জটিলতা’। রোগী ও রোগীর স্বজনরাই অনুভব করতে পারেন রোগীর চিকিৎসা খরচ বাবদ আর্থিক চাপের পাশাপাশি রোগীর দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণা। সরকারের স্বাস্থ্য খাতেও বৃদ্ধি করতে হয় বাড়তি অর্থ।

ডায়াবেটিস কী : এটি হরমোনজনিত রোগ যাতে ইনসুলিন সঠিক মাত্রায় তৈরি হতে পারে না অথবা ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে ব্লাড সুগার স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাই সেগুলোর বিপাকীয় কাজ সম্পাদনে ইনসুলিন জরুরি। ইনসুলিনের ক্রটির কারণে রক্তে অনেক সুগার থাকা সত্ত্বেও সেগুলো কোষে প্রবেশ করতে পারে না। এর পরিণামে অভুক্ত অবস্থায় থাকে দেহের কোষ, পর্যাপ্ত শক্তি তৈরি না হওয়ায় দুর্বল হয়ে যায় শরীর।

ডায়াবেটিস কেন বাড়ছে : পশ্চিমা জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে ওঠা অর্থাৎ সেডেন্টারি লাইফস্টাইল মূলত এর জন্য দায়ী। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও। বয়স বাড়লে যেমন আমাদের ত্বকে ভাঁজ পড়ে, চোখের দৃষ্টি কমে যায়, চুল পাকে, হাড় ক্ষয় হয় তেমনি অভ্যন্তরীণভাবেও দেহের ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গে কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। যেমন অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ কমে যায়। বয়স ৪৫ অতিক্রম হওয়ার পর টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। দেহের অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা ডায়াবেটিস সৃষ্টির জন্য অনেকটা দায়ী।

গ্রামের চেয়ে শহুরে মানুষের ডায়াবেটিস বেশি হয় কারণ গ্রামের মানুষেরা পরিশ্রম করেন এবং খাদ্যাভ্যাসে অনেকটা সংযত। শহরে বসবাসকারীরা বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাদের দৈহিক পরিশ্রম কম হয়, ফাস্ট ফুড, কোল্ড ড্রিংকস, তৈলাক্ত জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া হয়ে যায়। ফলে শরীর মুটিয়ে যায়; বেড়ে যায় ডায়াবেটিসের প্রবণতা।

আমাদের সন্তানদের কথাই ভাবুন। এদের জন্য স্কুলে না আছে খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ, বিকালেও না পাচ্ছে খোলামেলা কোনো জায়গা। শিশুর অবসর কাটাতে হয় টেলিভিশন, মোবাইল গেম বা কম্পিউটারে কিংবা শুয়ে-বসে। এদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যথাযথভাবে উন্নত হচ্ছে না। আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন দৈহিক সমস্যায়।

কীভাবে বুঝবেন ডায়াবেটিস হয়েছে : ডায়াবেটিস বহুরূপী একটি রোগ। ‘ঘন ঘন প্রস্রাব, অতিরিক্ত পিপাসালাগা, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া ও ক্লান্তি বোধ’-এসব লক্ষণে যদিও ডায়াবেটিস প্রকাশ পায়, তবে মনে রাখবেন ডায়াবেটিস হলে কোনো উপসর্গ অনুভব নাও হতে পারে। ব্লাড সুগার পরীক্ষা করে এ রোগ নির্ণয় করতে হয় অর্থাৎ খালি পেটে ৭ মিলিমোল/লিটার অথবা খাবারের ২ ঘণ্টা পর ১১.১ মিলিমোল/লিটার বা এর বেশি হলে ডায়াবেটিস হয়েছে এটা নিশ্চিত।

ডায়াবেটিস হলে দুটি নিয়ম মানতেই হবে : এক. সঠিক খাদ্য গ্রহণ, দুই. নিয়মিত ৩০-৪০ মিনিট একটু দ্রুত হাঁটা। খাবার ও হাঁটার নিয়মাবলি যথাযথভাবে পালন করতে পারলে সুস্থ থাকা সম্ভব। নিয়মমতো না হাঁটলে এবং খাবারদাবারে অনিয়ম করলে, ডায়াবেটিসের কোনো বড়ি কিংবা ইনসুলিনেই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।

কী খাবেন, কী খাবেন না : যেসব খাদ্য জিহ্বায় মিষ্টি স্বাদ দেয় সেগুলো খাওয়া বাদ দিন যেমন-চিনি, মধু, গুড়, খেজুরের রস, আখের রস, মিষ্টি ফলের রস ইত্যাদি। অন্যদিকে যেসব খাদ্য মুখে দিলে মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায় না সেগুলো পরিমাণমতো খান যেমন-আটার রুটি, ভুট্টা, ভাত ইত্যাদি। অন্যান্য খাবারের মধ্যে নিয়মমতো খান খিচুড়ি, দুধ, টক দই, বিভিন্ন রকমের ডাল, ছোট মাছ, ডিমের সাদা অংশ ও মুরগির মাংস। যত খুশি খেতে পারেন যেসব খাবার সেগুলো হলো-সব ধরনের শাক, শসা, খিরা, টমেটো, কাঁচা পেঁপে, পটোল, লাউ, চালকুমড়া, সজিনা, বেগুন, করলা, ঝিঙ্গে, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচামরিচ, আমড়া, জাম্বুরা, কাঁচা পেয়ারা, বাঙি, সাদাজাম, কালোজাম, কাঁচা বরই, তালের শ্বাস, আদা, পেঁয়াজ, রসুন ও বিভিন্ন মসলা। মিষ্টি ফল ও আলু খেতে হয় হিসাব করে। কোল্ড ড্রিংক্স মোটেই খাওয়া যাবে না। অতিথি আপ্যায়নে কোল্ড ড্রিংক্সের পরিবর্তে পাকা বেল বা লেবুর সরবত, দই-এর মাঠা, ফলের রস কিংবা ১ গ্লাস দুধ কিংবা ডাবের পানি প্রদান করুন।

‘একটু দ্রুত হাঁটা’ হচ্ছে সহজ ও উত্তম প্রকৃতির ব্যায়াম। এর ফলে শরীরের ইনসুলিন ভালোভাবে কাজ করে। ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করলে স্বাভাবিকভাবেই শরীরের পেশিগুলো তাদের শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সুগার রক্ত থেকে সংগ্রহ করতে পারে। ফলে ব্লাড সুগার স্বাভাবিক থাকে। পাশাপাশি দ্রুত হাঁটলে কোষের মাইটোকন্ড্রিয়াগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যেগুলো হলো জীবকোষের শক্তি উৎপাদক কেন্দ্র। এর ফলে শক্তিশালী হয় পেশি ও হাড়। রক্তের ফ্যাটও খরচ হয়। কমে যায় রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা।

হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। পানির বিকল্প যেমন পানিই! খনিজ লবণের বিকল্প যেমন লবণই! ঠিক তেমনি, হাঁটার বিকল্প হাঁটা-ই। সন্তানকে স্কুল জীবন থেকেই হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। অফিস কিংবা ব্যবসার কেন্দ্রে যতটা সম্ভব হেঁটে আসা-যাওয়ার চেষ্টা করুন। লিফট পরিহার করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করুন। নিজের সময় অনুযায়ী দিনের যে কোনো সময় নরম আরামদায়ক সেন্ডেল বা জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটা যায় এবং হাঁটতে হবে একটু দ্রুত গতিতে।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বাবা-মায়ের তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে বংশগত বা জিনের প্রভাব বিদ্যমান থাকে। স্কুল জীবন থেকেই এদের সন্তানকে খাদ্যাভ্যাস ও হাঁটা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয় বেশি। সেডেন্টারি লাইফস্টাইলে অর্থাৎ আরামপ্রিয় জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিস ছাড়াও ফ্যাটি লিভার, বিভিন্ন চর্মরোগ, মেয়েদের অনিয়মিত মাসিক, বিবাহের পর সময়মতো গর্ভধারণ না হওয়া, নারীদের মুখে ছেলেদের মতো লোম, এমনকি হার্ট ও ব্রেইনের নানা অসুখ দেখা দেয়। তাই রোগের চিকিৎসা, এমনকি রোগ প্রতিরোধেও হাঁটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সমাজের করণীয় : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শরীরচর্চা ও খেলাধুলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা, অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করা থেকে সন্তানদের দূরে রাখা, বিভিন্ন পেশাজীবীদের ডায়াবেটিস বিষয়ে প্রশিক্ষণ এবং পত্রপত্রিকা-টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ডায়াবেটিসের কারণ ও প্রতিরোধের উপায় বিষয়ে ছবিসহ তথ্য সম্প্রচার করা।

রাষ্ট্রের করণীয় : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ থাকতে হবে এমন আইন প্রণয়ন, সহজে হাঁটা যায় এমন ফুটপাতের ব্যবস্থাকরণ, পাঠ্যপুস্তকে ডায়াবেটিস রোগের অধ্যায় অন্তর্ভুক্তকরণ এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সিলেবাস সহজতর করা যাতে ছোটবেলা থেকে শিশুদের শুধু পড়াশোনায় অধিক মানসিক চাপ না পড়ে এবং খেলাধুলার প্রতি তাদের উৎসাহ জন্মায়।

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে পরিবারের সদস্য, সরকার, চিকিৎসক, গবেষক, শিক্ষক, ধর্মগুরু, সমাজকর্মী, সাংবাদিকসহ সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণাসহ রোগীর চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাবে বহুগুণ। এতে রাষ্ট্রে বাড়বে অর্থনৈতিক চাপ।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ