কবিতা
ভাঁজ করার কৌশল
জাকির আবু জাফর
জামা ভাঁজ করার কৌশল এঁকে মা বললেন –
এমন করেই ভাঁজ করে নিতে হয় জীবনের দুঃখগুলো
ভাঁজের চাতুর্য শিখতে শিখতে আমি শিখে গেলাম
কীভাবে একাই ভাঁজ করে নিতে হয় পথের বন্ধুর
আমি সুখ ভাঁজ করার নিদান খুলে বরাবরই অপলক
মা আমার দৃষ্টি ভাঁজ করে রেখে দিলেন কৈশোরের তাকে
বললেন- যখন ইচ্ছে খুলে দেখিস নিষ্পাপ এই চোখের নদী
সহসাই নদীগুলো ভাঁজ করে রেখে দিলাম বুকের ভেতর
তারপর ঢেউয়ের পৃষ্ঠাগুলো সেলাই করে দেখি-
কীভাবে এক মলাটে বন্দি -জলের অভিধান
জল থেকে চরাচর আমার মুহুর্মুহু পাঠের আয়াত
ঘাসের অক্ষর থেকে পাতার নকশা
সবুজ শরবত থেকে ভোমরের চুম্বন
পাপড়ির ঠোঁট ও বৃক্ষের ধ্যান
এসব দরবেশী মাকাম আমার নিত্যতায় চোখা
ফসলের ছায়া ছেঁকে ভাঁজ করি ধ্যানের কম্পন
আমার রোদ ও ছায়ার ফাঁকে থৈথৈ বৃষ্টির ঘ্রাণ
মৌমাছির গুঞ্জন ভাঁজ করে পাঠ করি মৌচাকের লিপি
রাতগ্রন্থ পাঠ করে জেনে গেছি অঘুমো চোখের বিধি
জেনে গেছি শিউলির শ্বাস থেকে মুদ্রিত গন্ধের হরফ
জোছনায় টুপটাপ শিশিরের কেরাত শুনে ভাঁজ করি ভোরের নিশ্বাস
আমার আমিকে ভাঁজ করার কায়দা এখন দুর্দান্ত
যখন সবাই ভাঁজ করে ক্ষমতার উত্তাপ
সকলেই ভাঁজ করে খ্যাতির তৃষ্ণা
হৃদয় কাটার ছোরাটি শাণিয়ে সবাই যখন সন্তর্পণ
আমি একাকীই ভাঁজ করি মানুষের মানচিত্র
পরতে পরতে আস্ত জীবনটি ঘেঁটে দেখি
সুখের নেশায় কেবল দুঃখই ভাঁজ করে মানুষ!
নৈঃশব্দ্য দাহন
এবি ছিদ্দিক
সময়ের প্রতিটি সোনালি মুহূর্ত উৎকট মিছিল
প্রসব করে সহস্র জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি
সভ্যতার ধূসর প্রান্তরে
হৃদয় নৈঃশব্দের সুপ্ত লাভার দহনে
ক্ষত-বিক্ষত
অগ্নি শপথের বাণী খুঁজে মিছিলের পরতে পরতে
লাউয়ের ডগার মতো স্বপ্নগুলো!
দীর্ঘঃশ্বাস ভোরের কুয়াশায় আবৃত থালার মতো-
লাল টুকটুকে সূর্যের প্রত্যাশায় প্রহর গুণে।
আশ্রয় খুঁজে নেয় নুয়ে থাকা নারকেলের ডগায়!
কখন যুগের সফল চাষি ঘাসফুল আর পলাশের
নতুন বীজ বপন করবে অনুর্বর পতিত ভূমিখ-ে!
হীরকখ-ের চেয়েও দীপ্তিমান সময় কি আমাকে সময় দেবে?
উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো, সবুজ ধানের ঢেউয়ের মতো
দেখে নিতে কিভাবে সভ্যতার ফুল ফোটে সর্বাঙ্গে!
যেখানে তুমি আছো তুমি নেই
শশো ব্যাপারী
যেখানে তোমার শুভ্রতা মেশানো থাকে
সেখানের বন্য পাখিগুলো
হয়ে ওঠে মানবিক
হিংস্র জন্তু-জানোয়ার মানুষী জীবন চায়!
মাটিতে মিশে থাকা অণুজীবগুলো
ফুল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমে
নুয়ে পড়া লতাগুল্ম সতেজতা ফিরে পায়।
সেখানে তোমার শরীরের গন্ধ লেগে থাকে
সেখানে এসে শত প্রজাপতি মাতাল হয়
পথ হারায় দিশাহীন ভ্রমর
মৌমাছিগুলো পাহারা দেয় সেইটুকু জমিন!
রাতের সুবিশাল আকাশ
জোছনার নদী হয়ে মিশে যায় সুদূরে
আমি যেন হারিয়ে ফেলা পথটাকে খুঁজে পাই।
যেখানে তোমার হাতের ছোঁয়া, হাঁটার শব্দ
হাসি-কান্না নিঃশ্বাসের গভীরতা
বাসনের ঝনঝন আওয়াজ
কিচ্ছু নেই সেখানে জঙ্গলে ভরে যায়!
রাতের নিঃসঙ্গ শেয়াল চোখ মুছে বারবার
পানির খোঁজে ছুটতে থাকে চাতক
বেনামি পোকাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেরোয়
স্মৃতির বসন থেকে।
বিপন্ন বন্দর
সাজু কবীর
উদ্ভট ভাবনায় জন্মে পাগলা ঘোড়া
দাপিয়ে ধূলি ওড়া আর খটমট শব্দতরঙ্গ
এসবে মুক্তির ঠিকানা নেই।
মনুষ সবাই মুক্তিকামী। একটি অভিন্ন
সাদাগোলাপের জন্য আহাজারি আর রক্ত¯্রােতে
দাফন করা হয় মানবিক জাতীয়তা।
গড়তে গিয়ে যদি 'ভাঙা' দিয়ে শুধু গেঁথে যাই
বেজন্মা স্বার্থের পথ, বলো, তাহলে কীভাবে
হাঁটবে আমাদের অখন্ড জাতিসত্তা?
কীভাবে টিকে থাকবে নগর ও নাগরিক ইতিহাস?
মানবপ্রেমের শিল্পিত কবিতা?
পবিত্র কাবা অভিমুখে
রিতা ফারিয়া রিচি
আহত হৃদয়টাকে পরিশুদ্ধ করি
জোছনা বৃষ্টিতে
নিয়মিত হোক সারসের পাখা মেলা
গড়াই নদীর প্রবাহিত উর্ণাজালে।
রেশমি স্বপ্নগুলো মেলে ধরি চন্দ্রিমা রাতে
পশ্চাতের ঝুলবারান্দায় পড়ে থাকবে
বিক্ষত অর্থহীন আচরণ।
প্রিয়তমের আরাধনায় নিশি হোক ভোর
আমার চাওয়ার সাথে যোগ হয় গড়াই নদীর
ছোট ছোট ঢেউয়ের নকশা আঁকা পাটি
এইবার উড়াল দেবো মানসিক প্রশান্তিতে
পবিত্র কাবা অভিমুখে।
ঘুম
সোলায়মান জয়
অন্ধকার কাটেনি,
ধৈর্য নেই বলে সূর্য অঙ্কন করে
সকাল হয়েছে বলে
মনকে সান্ত¡না দিয়েছি;
সকাল হয়েছে এবার,
উঠে পড়ো ঘুমানো সব সুখ?
তোমাদের এখন পরিশ্রম করতে হবে,
পাখির ডানার মতো।
তবেই দুপুর আসবে,
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা শেষে রাত!
হে সুখ? তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে,
তোমাকে ক্লান্ত হতে হবে,
মনে রেখো?
ক্লান্তির ঘুমই সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তির ঘুম।
কাশফুলের উঠোন
পারভীন আকতার
নীলাভ ডুবন্ত সাগরে সাঁতরে দেখেছি
জলের ধারায় মিশেল হচ্ছে হেমের দিবারাত্রি।
ফুটন্ত কলির মতো ঢেউ ফেনিল ডুবছে উঠছে
নির্ঘুম রাতে অবিরাম শ্রাবণ ধারায়।
শ্রাবণের কাশবনে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে
ভেজা পায়ে নূপুরের শব্দ!
অস্থির আবেশে ঘিরে রেখেছে চারদিক।
প্রেমময় উদ্ভাসী হৃদয় ছুঁয়ে যায়
যেন কাশফুল আবেশের নরম ছোঁয়ায়।
সাদা পালকের হাতছানি
দূরে মেঘের সারি সারি অভ্যর্থনা!
ডাকছে কাশবন,বৃষ্টিস্নাত অবগুণ্ঠন খুলে।
এসো প্রিয় শ্রাবণ ধবল সবলে মিশে একাকার হই।
এসো তবে কাশফুলের উঠোনে লুটোপুটি খেলি।
সুরঞ্জনার খোঁজে
শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম
হোক না আবার লোকনিন্দা ঢের,
পাইলে পাকনা সবে আমাদের টের।
কন্ঠকিত সুরঞ্জনা আসো যদি ফের,
সইব আজিকে নিন্দা সে চির দিনের।
তাতে কি বা যায় আসে হে সুন্দরতম
সুরঞ্জনা আমার...
তুমি তো ধরা দিয়েও অধরায় চিরকাল;
মনে হয় পেয়েও যে হারিয়েছি সে তোমাকে।
দাদুরে কাঁদানো সন্ধ্যা জোনাকির আলো
এমন সময় এসে বেসেছিলে ভালো।
তুমি ছিলে আলোকিত রাতের আঁধারে
প্রেম দিয়ে কাছে টেনে সরালে বাধা'রে।
সহসা উঠিত মাতি বেণুবনে বাঁশি;
প্রেমভাবে মজেছিনু মুখে দেখে হাসি!
ওগো চপলা চঞ্চলা প্রেয়সী আমার,
ওই গড়ায়ের পারে আসো আরবার!
সভ্যতার নীল চাদর
রাজীব হাসান
মানুষের আসল চেহারাটা আজকাল
সভ্যতার নীল চাদরে ঢেকে গেছে
যদিও তাতে কারো কিছু আসে যায় না
তবে যার যায় সে ঠকে যায় আর বলে যায়
এ সমাজের মানুষ আমাকে সভ্য হতে দেয়নি।
মুখোশের আড়ালে নিজেকে বন্দি করে
প্রতিনিয়ত নিয়ম ভাঙার খেলায় যেভাবে মানুষ মেতে চলেছে
একদিন না একদিন ঠিক তার এই কাজের বিনিময় পাবে
এখন যতই সভ্যতার চাঁদরে ঢেকে রাখুক না কেনো নিজেকে।
তখন হয়তো নিজেকে দেখেও নিজের ঘৃণা জন্মাবে
আর বলবে যে চাদরে সভ্যতা ঢেকেছিলাম
সে চাদরে ফাঁস নিয়ে পাপমুক্ত করা উচিত ছিলো।