নয় দফা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা শিক্ষার্থীদের
স্টাফ রিপোর্টার : সড়ককে নিরাপাদ করতে নয় দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে গতকাল রোববারের মত রাস্তা ছেড়েছে শিক্ষার্থীরা। আগের ঘোষণা অনুযায়ী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এদিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর মোড়ে অবস্থান নিলে মিরপুর সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বীর শ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, বীর শ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজ, লালমাটিয়া গার্লস কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেন সেখানে।
শেরেবাংলা নগর থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া জানান, শিক্ষার্থীরা সেখানে ৯ দফা দাবিতে স্লোগান দেন। রাস্তায় বিভিন্ন গাড়ির চালকদের লাইসেন্সও পরীক্ষা করতে দেখা যায় তাদের। পরে বেলা পৌনে ৩ টার দিকে ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত’ আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দিয়ে দিনের কর্মসূচি শেষ করেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও বেলা ১টার পর শান্তিনগর মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। নয় দফা দাবিতে সোয়া ১টার দিকে তারা শান্তিনগর থেকে কাকরাইল পর্যন্ত সড়কে মিছিল করেন তারা। এ সময় সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে তারা কাকরাইল মোড়ে অবস্থান নেন। দুপুর সোয়া ২টার দিকে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শাখা প্রধান (কলেজ) মশিউর রহমান শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এরপর কাকরাইল এলাকার সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ-অবরোধের কারণে আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট দেখা দেয় বলে পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন।
ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর পরিবহন মালিকদের চাপে সরকার বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ায়। এর পর থেকেই বাসে অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা।
বুধবার সড়কে সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সেই আন্দোলন আরও গতি পায়। বৃহস্পতিবার পথে পথে তাদের বিক্ষোভ-অবরোধে রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। মাঝে শুক্রবার বিরতি দিয়ে শনিবার দুপুরে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় সড়ক অবরোধ করে তিন ঘণ্টা বিক্ষোভ দেখায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি দল। সেখানে নয় দফা দাবি পূরণে মঙ্গলবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে তারা রাস্তা ছাড়ে।
আন্দোলনকারীদের একজন প্রতিনিধি হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেন, এই সময়ের মধ্যে তাদের দাবি পূরণ করে প্রজ্ঞাপন জারি না হলে ওই দিন দুপুরে রাজধানীর সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তারা বি আরটিএ কার্যালয় ঘেরাও করবে। তার আগে দুদিন (রোব ও সোমবার) বিক্ষোভ চলবে এবং সড়কে গাড়ির ফিটনেস ও লাইসেন্স পরীক্ষা চলবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে।
২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে যে নয় দফা দাবি ছিল, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা বাস্তবায়ন করেনি জানিয়ে শিক্ষার্থীদের ওই প্রতিনিধি বলেন, এবার দাবি আদায় না হলে মঙ্গলবার তারা নতুন কর্মসূচি দেবেন।
কাগজপত্র পরীক্ষা
রাজধানীর রাপা প্লাজার সামনে বিকাশ পরিবহনের একটি বাস থামিয়ে কাগজপত্র পরীক্ষা করলেন শিক্ষার্থীরা। দেখেন, চালকের লাইসেন্স নেই। পরে বাসের চাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা বাস থেকে নেমে যান। চালকের দাবি, তার সহকারীর কাছে লাইসেন্স, যানজটে আটকে থাকায় আগেই নেমে গেছেন তিনি।
এদিকে শিক্ষার্থীরা বাসের চাবি নিয়ে গেলে চালক তাদের কাছে অনুরোধ করছিলেন সেটি ফেরত দেওয়ার। শিক্ষার্থীরাও নাছোড়বান্দা। উপস্থিত এক পুলিশ সদস্যকে দেখে তারা বলছিলেন, ‘দেখেন, চালকের লাইসেন্স নাই। মামলা দেন।’ এ সময় শেরেবাংলা নগর থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া কাগজপত্র দেখে উপস্থিত ট্রাফিক সার্জেন্টকে মামলা দিতে বলেন।
শিক্ষার্থীরা গত তিন দিনের মতো গতকালও সড়ক অবরোধ করে যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। কোনো চালকের লাইসেন্স না থাকলে, যানবাহনের কাগজের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে থাকলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের কাছে চালকদের নিয়ে আসছিলেন। পুলিশ সদস্যরা কাগজপত্রে সমস্যা থাকলে মামলা ও জরিমানা করছিলেন।
শিক্ষার্থীদের কাগজপত্র পরীক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ছিলেন ওসি উৎপল বড়ুয়া। শিক্ষার্থীরা কোনো গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা শেষ করলে দ্রুত সেটি ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছিলেন তিনি। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, রাপা প্লাজার সামনে গতকাল দুই ঘণ্টায় বিভিন্ন যানবাহনের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা ও ৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিবহন করা গাড়ির চাপায় নাঈম হাসান নিহত হয়। সেদিন থেকেই নিরাপদ সড়কের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম নিহত হন। সেদিন থেকে ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশবাসীর সমর্থন পেয়েছিল। টানা ৯ দিন রাজপথে আন্দোলনের পর সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।
ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির অন্যতম ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ, লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে গাড়ি চালাতে না পারে, শিক্ষার্থীদের চলাচলে পদচারী-সেতুর ব্যবস্থা, দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় গতিরোধক বা স্পিডব্রেকার বসানো, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নেওয়া ও সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা।
সাড়ে তিন বছর আগে করা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের তোলা দাবিগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ার কথা তুলে ধরে আজও শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, কয়েক বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সড়ক শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ হবে। এই সময়ে আগের দাবিগুলোর অধিকাংশই পূরণ হয়নি। এই কারণেই সড়কে আবার এক ভাইয়ের রক্ত ঝরল। তাই তো তারা স্লোগান তোলেন, ‘আশ্বাস আর না, বাস্তবায়ন কর না’।
‘ইন্ধন-সূত্র’ খুঁজতে ছাত্রী ও বাবাকে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ
নিরাপদ সড়কের দাবিতে দিনভর ধানমন্ডি ২৭ এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেওয়া এক ছাত্রীকে তার বাবাসহ থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। গতকাল রোববার (২৮ নবেম্বর) সন্ধ্যায় বাসা থেকে তাদের থানায় নিয়ে যায় মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মোহাম্মদপুর থানার ওসি আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, গতকাল ধানমন্ডি ২৭ এলাকায় সকাল থেকে আন্দোলন করছিল একদল শিক্ষার্থী। দুপুরে ওই ছাত্রী সেখানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে খাবার পরিবেশন করে। একই সময়ে আরেকটি ছেলে ওই ছাত্রীর কাছে বিকাশ নম্বর চায় এবং টাকা পাঠানোর কথা জানায়। বিষয়টি পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারিতে এসেছে। এই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ঘিরে অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা বা লেনদেনের বিষয়টি রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতেই ওই ছাত্রীকে তার বাবাসহ থানায় ডেকে নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনে অন্য কারো ইন্ধন কিংবা যোগসাজশ রয়েছে কি না এ ব্যাপারে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, গতকালকে ধানমন্ডি ২৭ এলাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝখান থেকে এক অছাত্রকে আটক করা হয়েছে। তার নাম হাফিজুর রহমান। তার কাছ থেকে কিছু ইনজেকশন ও জাল টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। হাফিজুর রহমানকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এর আগেও হাফিজুরকে ধানমন্ডি ২৭ এলাকায় দেখা গেছে। তখন সে শিক্ষার্থী ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। গতকাল ঘটনাস্থল থেকে আটকের সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হাফিজুর রহমানকে ঘিরে ধরে। এ সময় হাফিজুর রহমান আন্দোলনরত অধরা নামে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বারবার বিকাশ নাম্বার চাচ্ছিল। অধরার পূর্ব পরিচিত, নাকি তাকে ব্লাকমেইল করতে চাচ্ছিল, নাকি আন্দোলন ঘিরে আটক হাফিজুরের অন্যকোনো উদ্দেশ্য ছিল? সেটি খতিয়ে দেখতেই অধরাকে থানায় ডেকে নেওয়া হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, গতকালই অধরা নামেই ছাত্রী নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীদের পক্ষে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করে বক্তব্য ও বিবৃতি পাঠ করেছিল।
বাসের ধাক্কায় কিংবা চাপা পড়ে যখনই আন্দোলনে গেছে শিক্ষার্থীরা, ততবারই আশ্বাসের বাণী শুনতে হয়েছে। কিছুদিন ভালো যায়। আবারো সড়কে রক্ত ঝরে, শিক্ষার্থীরা মারা যায়, ফেরে না সড়কে শৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা কাটে না গণপরিবহনে। তাই কোনো আশ্বাস নয় আর বিশ্বাসও নয়।