শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রোহিঙ্গা অপরাধের লাগাম টানতে হবে

সাইয়ারা নূর

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা রোহিঙ্গাদের। একের পর এক তারা মাদক, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, পুলিশ ও সাংবাদিকের উপর হামলাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের দিকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলো। তখন থেকেই সেখানে প্রচুর পরিমাণে হত্যা, অপহরণ এবং যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার মাত্রাও বেড়ে গিয়েছে। সে বছরের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অন্তত ৭৬টি ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছিলো। ২০১৮ সালে এই মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০৮ এবং ২০১৯ সালে ২৬৩টি। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ১৭৮টি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যেও মিলেছে রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতার চিত্র। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত ৪ বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে প্রায় ১ হাজার ৩০০ মামলা হয়েছে। এতে আসামী করা হয়েছে ২ হাজার ৭৫ রোহিঙ্গাকে। অপরাধের মধ্যে আছে হত্যা, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি ও মানবপাচার। এর মধ্যে ৭১টি খুন, ৭৬৪টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ, ১০টি ডাকাতি, ৩৪টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় এবং অন্যান্য আইনে ৮৯টি মামলা হয়েছে।

মায়ানমার থেকে বাংলাদেশের ভেতরে ইয়াবা নিয়ে আসার মূল কাজটা করে রোহিঙ্গারা। মায়ানমারের যারা ইয়াবা তৈরি করে, তারাই বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, যাতে তারা গিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসে। এরপর এগুলো বাংলাদেশী নানা চক্রের মাধ্যমে দেশের ভেতর ছড়িয়ে যায়। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা কারাগারে রয়েছে।

২০১৮ সালে রোহিঙ্গা ডাকাতদের হয়রানি ও হুমকির ফলে চাক জনগোষ্ঠীর সাতঘর্য্যা গ্রাম পরিত্যাগ করতে হয়। এর কয়েক বছর আগে ভূমি বেদখলকারী ও রোহিঙ্গা ডাকাতের হুমকি ও হয়রানির ফলে নাইক্ষ্যংছড়ির বাদুঝিরি নিজ ভূমি থেকে চাক জনগোষ্ঠীর ১৫ পরিবার উচ্ছেদ হয়েছিল। নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ কর্তৃক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কমপক্ষে ২০ জনের মারমা ও তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়েছে।

২০১৯ সালের জানুয়ারি-জুন মাসে বিজিবির সাথে বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। যাদের অধিকাংশই মানব পাচার চক্রের সাথে যুক্ত।

এছাড়াও, নতুন পুরাতন মিলিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ২৯টি ক্যাম্পে অন্তত লাখ রোহিঙ্গার বসতি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে গত দুই তিন বছরে নতুন জন্ম নেয়া ৯১ হাজার শিশু। সেই হিসেবে প্রতিদিন গড়ে বারছে ১২৫ জন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির নেই কোন আগ্রহ। এদের প্রতি ফ্যামিলিতে রয়েছে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য। এর প্রভাব পরছে পর্যটন জেলা কক্সবাজারসহ সারা দেশে কিছু কিছু দালাল চক্র রোহিঙ্গা যুবতি মেয়েদের বিক্রি করে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে। কিন্তু সেখানে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকা- ঘটার পরও কোনো মামলা করছে না ভুক্তভোগীরা। রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই সরকারিভাবে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃত নয়। যার অর্থ এই দেশে তাদের কোনো আইনগত অধিকার নেই। এ কারণেই মামলা দায়ের করার প্রতি তাদের ভীতি কাজ করতে পারে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের বিচরণ এবং সেখানে নিরাপত্তার ঘাটতির কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। গত দুই বছর ধরে ক্যাম্পের ভেতরে হত্যাকা- এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাদের এসব কর্মকা-ের ফলে অবনতি হচ্ছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাও। যার প্রভাব পড়তে পারে প্রত্যাবাসনে। তাই প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা দেয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন। তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে রোহিঙ্গারা চাইছে এ দেশেই থেকে যেতে। রাখাইনে ফিরে গেলে আবার অত্যাচার নির্যাতন সইতে হবে, এই ভয় তাদের। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণের কারণে সংকট যে আরও জটিল হয়েছে এবং প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) অধিবেশনের ফাঁকে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উচ্চপর্যায়ের এক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রত্যাবাসনের অগ্রগতির ঘাটতির কারণে হতাশা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের অনেকে অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে এবং তারা অতি সহজে জঙ্গিবাদী মতাদর্শেও শিকার হচ্ছে। এ ধরনের কর্মকা- পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এই সংকট সমাধানে পাঁচ দফা আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রথমত, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ‘আমাদের সবার জোরালো প্রচেষ্টা’ চালানো প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অনিশ্চয়তা দূর করতে মিয়ানমারে রাজনৈতিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটানো এবং এই সংকট সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার একটি সংশোধন প্রয়োজন।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর থেকেই এ সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য একেবারে ধারাবাহিকভাবে ইউএনজিএর অধিবেশনে তিনি সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।

এ ব্যাপারে আমাদের সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ বজায় রেখেছে। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে, আমরা চীন ও ভারতসহ প্রধান শক্তিগুলোকে এ সংকট সমাধানে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছি। আমরা সার্বক্ষণিকভাবে আসিয়ানকে আরো সক্রিয় রয়েছে। তবে, দুঃখজনকভাবে দুর্ভাগা, গৃহহীন হয়ে পড়া মিয়ানমারের নাগরিকদের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য চালানো আমাদের প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত কোন আলোর মুখ দেখেনি।'

মূলত, তাদের কক্সবাজার ও টেকনাফের পাহাড়ি অঞ্চলে ঠাঁই দেয়া হলেও তারা জেলার বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছে, এখনো করছে। এমনকি নাম-পরিচয় গোপন করে তাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে একশ্রেণির দালাল।

কিন্তু এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে কক্সবাজার ও টেকনাফের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন খুবই দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। যেখানে একসময় দরজা খোলা রেখে ঘুমানো যেত, সেসব এলাকায় দিনদুপুরে চুরি হচ্ছে। খুন-রাহাজানি হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে, স্থানীয় অনেকে বাধ্য হয়ে নিজ এলাকা থেকে অন্যত্র গিয়ে বাস করছে। যদি কোন রোহিঙ্গা কক্সবাজার অথবা দেশের কোথাও অপকর্ম করে পুনরায় ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে তাহলে তাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। যদি রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা আইন তৈরি করতে হবে। যে আইনে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকবে কোন রোহিঙ্গা তার জন্য নির্ধারিত এলাকার বাইরে গেলে সে শাস্তির আওতায় পড়বে। আর এই তথ্য রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। মূলত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে গিয়ে তারা রুক্ষ হয়ে উঠেছে। তাদের বিভিন্ন সময়ের আচার-আচরণ ও প্রতিক্রিয়ায় এই মানসিক অবস্থা ফুটে উঠছে। রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ কোনো নির্দিষ্ট কাজে নিয়োজিত নেই। তাদের বেশির ভাগ সময়ই কাটে অলস, অবসরে। এই কর্মহীনতা তাদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিনা তাও বিশ্লেষণের সময় এসেছে। পাশাপাশি কোনো মহল বা গোষ্ঠী নিজের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের এমন আচার-আচারণ, একের পর এক অনিয়ম হানাহানি বন্ধ করতে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে অপরাধমূলক কর্মকা- বন্ধ করতে হবে।

 

 

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ