শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বুড়িগঙ্গার পর ধলেশ্বরীতেও ভয়াবহ দূষণ

চামড়া শিল্পের দূষণ প্রসঙ্গে অনেক উপলক্ষেই বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখনও কথা ওঠে। মাত্র কয়েক বছর আগেও দূষণের প্রধান শিকার হতো রাজধানীবাসীর জন্য অক্সিজেনের প্রাণ হিসেবে বর্ণিত নদী বুড়িগঙ্গা। সে সময় নদীর আশপাশের অসংখ্য ট্যানারি কারখানার বর্জ্য ফেলা হতো বুড়িগঙ্গায়। এভাবে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার ফলে সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়ে পড়েছিল যে, এত বিরাট এবং এককালের স্রোতোস্বিনী নদীর পানিকেও পৃথকভাবে চেনা সম্ভব হতো না। মনে হতো, নদীতে আসলে পানি নেই, আছে কেবলই পানির মতো নোংরা তরল কিছু।
অন্যদিকে সে তরলকেই পানি হিসেবে চালিয়ে দেয়া হতো। শুধু তা-ই নয়, বিষাক্ত এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর সে তরলগুলোকেই লোকদেখানো খান দুই-চারেক যন্ত্রের মাধ্যমে শোধন করে রাজধানীবাসীর জন্য ‘সুপেয় পানির’ ব্যবস্থা করা হতো! মানুষকেও পানি নামের সেই বিষ পান করতে হতো। এ অবস্থাই চলেছে বছরের পর বছর ধরে। পানির নামে বিষ খাওয়ার ফলে বহু ধরনের অসুখ-বিষুখে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। কতজনের যে মৃত্যু ঘটেছে তার হিসাব এখনও করা হয়নি। কখনও করা হবেও না।
কিন্তু এভাবে অনির্দিষ্টকাল চলতে পারেনি। পরিবেশ বাঁচানোর কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সংগঠনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কেবল ঢাকার নয়, সারাদেশের মানুষও বুড়িগঙ্গাকে এবং একই সঙ্গে ঢাকার অধিবাসীদের বাঁচানোর আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। পানির ওপর জমে থাকা কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ বর্জ্যরে স্তর সরিয়ে পানিকে পরিষ্কার, বিপদমুক্ত ও সুপেয় করার দাবিতে আন্দোলন ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে। এতে অংশও নিয়েছে সকল পেশা ও বয়সের মানুষ। সরকারকেও শেষ পর্যন্ত জনগণের দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সরকারকে দেয়া পরামর্শে বলেছেন, রাজধানীবাসীর পাশাপাশি বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হলে নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা সকল শিল্প-কারখানা উচ্ছেদ করতে হবে। সেই সাথে এমন ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কারখানার বর্জ্য দূরে থাকুক, কোনোরকম ময়লা-আবর্জনাই নদীর পানিতে পড়তে বা মিশতে না পারে।
এরপর এসেছিল বুড়িগঙ্গার তীর থেকে শিল্প-কারখানা উচ্ছেদ করার পালা। কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে উচ্ছেদ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শিল্প-কারখানার মালিকসহ স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল নানা পন্থায় সে প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। পরিণতিতে বিলম্বিত হয়েছে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া। সাভারে সরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে সে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে দৃশ্যপটে এসেছে নানা শ্রেণির সমস্যা সৃষ্টিকারীরা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধরনের ঝামেলা তৈরি করেছে চৌর্যবৃত্তিতে পারদর্শী একটি বিশেষ গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর লোকজন দিনের বেলায় আইন মেনে চলে কিন্তু রাত শুরু হতে না হতেই তাদের অশুভ তৎপরতা বেড়ে যায়।
প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, তারা রাতের অন্ধকারে পাইপ বসিয়ে শিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য ধলেশ্বরীর পানিতে ফেলতে থাকে। জানা গেছে, ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিইটিপি বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার নাকি সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর বিপুল বর্জ্য পরিশোধনের জন্য যথেষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞরা একে কার্যকর বলতেও সম্মত নন।
ওদিকে পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে দুর্বৃৃত্তরা। তারা দিনের বেলায় নীরব থাকলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠে। সীমানা দেয়ালের কয়েকটি পর্যন্ত স্থানে তারা বড় ধরনের ফুটো করে নিয়েছে। এসব ফুটো দিয়েই তারা রাতের বেলায় পাইপ দিয়ে নদীতে বর্র্জ্য ফেলে কিন্তু দিন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইপগুলোকে লুকিয়ে ফেলে। লক্ষ্যণীয় এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গণমাধ্যমের ক্যামেরায় যখন ধরা পড়েছে তখন বিসিকের মাধ্যমে সরকার চাইলে খুব সহজেই পাইপের রহস্য উদ্ঘাটন করতে এবং অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বুড়িগঙ্গার পর ধলেশ্বরীতেও ভয়াবহ দূষণ ঘটানোর কর্মকাণ্ড অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা আশা করি, কালবিলম্ব না করে সরকার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করবে এবং প্রয়োজনে সিইটিপির আকৃতি ও সক্ষমতা বাড়িয়ে হলেও নদীতে বর্জ্য ফেলার কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটাবে। মনে রাখতে হবে, দেশবিশেষের পানি আগ্রাসনের অসহায় শিকার বাংলাদেশ এমনিতেই ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। তার ওপর যদি নদীর পর নদীর পানিকে দূষিত ও বিষাক্ত করতে দেয়া হয় তাহলে বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটবে। নদ-নদীগুলো তো ধ্বংস হয়ে যাবেই, একই সঙ্গে বিষাক্ত পানির কারণে মানুষেরও বিপদ, এমনকি মৃত্যু ঘটতে থাকবে। আমরা অবশ্যই অমন পরিণতির অসহায় শিকার হতে চাই না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ