শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ইভ্যালিতে পাওনা ২ লাখ গ্রাহকের কি হবে!

এইচ এম আকতার : ই-কর্মাসে কেনা কাটায় মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা,আলিশা মার্টসহ ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অবৈধ লেনদেনের কারণে বন্ধ। এসব প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সব লেনদেন বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে গ্রাহকরা। শুধু ইভ্যালির দেনা আছে দুই লাখ ৮ হাজার গ্রাহকের কাছে। ইভ্যালির গ্রাহকদের কি হবে এমন প্রশ্ন সবার মুখে মুখে।
ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী (প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান) শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার বিকালে রাসেলের মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এর আগে তাদের দুজনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় প্রতারণার মামলা দায়ের করেন ইভ্যালির এক গ্রাহক।
এর আগে ই অরেঞ্জের মালিক ভারতে গ্রেফতার হন। এছাড়াও বন্ধ রয়েছে আলিশা মার্ট ধামাকা দালালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লেনদেন। বড় বড় এসব ই-কর্মাসে প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো। এসব প্রতিষ্ঠান গত ৫/৭ বছরে মানুষের  আস্থা অর্জন করে। আর এ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন তারা অবৈধ লেনদেন চালিয়ে গেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর দেখেও না দেখার ভান করেছে। এতে করে গ্রাহকের ক্ষতির পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের প্রশ্ন হাজার হাজার কোটি টাকা আটকের পর কেন সরকার উদ্যোগ নিল। আগে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো না।
এর আগেও যুবক,ডেসটিনি,ইউনিপে টুসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্টান গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি হাউজিং প্রতিষ্ঠানও। প্রশ্ন হলো এসব প্রতিষ্টান যখন ছোট থাকে তখন সংশ্লিষ্ট দফতর কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। যদি তাই হতো তাহলে গ্রাহকরা হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হতো না।
এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেশ নামিদামি ই কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে সারা দেশে। এদের তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানও। কিন্তু এসব প্রতিষ্টানের কারণে মানুষের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ক্ষতির সম্মুখিন হবে ই কর্মাস ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, ইভ্যালির বিরুদ্ধে পাঁচ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা হয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে। এর মধ্যে বেশিরভাগই হলো ‘টাকা পরিশোধ করে দীর্ঘদিন পণ্য না পাওয়া’র অভিযোগ। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে ইভ্যালির নেওয়া প্রায় ৩৩৯ কোটি টাকার খোঁজ পাওয়া যায়নি দুদকের অনুসন্ধানে। এই অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা আছে বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত ইভ্যালির নেওয়া অগ্রিম ৩৩৯ কোটি টাকারও হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ টাকা আত্মসাৎ বা অবৈধভাবে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, গত বুধবার মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বগ্রাম এলাকার বাসিন্দা মো. আরিফ বাকের ইভ্যালি এমডি মোহাম্মদ রাসেলকে এক নম্বর আসামি ও চেয়ারম্যান শামীমাকে দুই নম্বর আসামি করে একটি প্রতারণার মামলা করেন। মামলায় ইভ্যালির আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে ‘অজ্ঞাতনামা’ দেখিয়ে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে আরিফ বাকের উল্লেখ করেছেন, ইভ্যালির অনলাইন প্লাটফর্মে ৩ লাখ ১০ হাজার ৫৯৭ টাকার পণ্য অর্ডার করেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাননি তিনি।
জানা গেছে, ইভ্যালির নিবন্ধিত গ্রাহক ৩৭ লাখের বেশি। এরা নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলেন ইভ্যালির দেনা আছে দুই লাখ ৮ হাজার গ্রাহকের কাছে। যার পরিমাণ ৩১১ কোটি টাকা। এ ছাড়া ১৫ জুলাই পর্যন্ত মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ছিল প্রায় ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। দেশের প্রায় ২৫ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
পণ্য কিনলেই অর্থ ফেরতের অস্বাভাবিক অফার দিয়ে ব্যবসা করছিল ইভ্যালি। ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি থেকে বলা হতো ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। ‘সাইক্লোন’, ‘থান্ডারস্টর্ম’, ‘আর্থকোয়াক’সহ নানা ধরনের লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হতো। দেওয়া হতো অস্বাভাবিক মূল্যছাড়। কিছু গ্রাহক লাভ পেলেও বেশিরভাগই আছেন টাকা ফেরতের অনিশ্চয়তায়।
ইভ্যালির বিরুদ্ধে আট ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে প্রচলিত বিভিন্ন আইনভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ সদর দফতরের একটি তদন্ত টিম অনুসন্ধান করে নানা অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে অর্ডার করা পণ্য নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি না দেওয়া, গ্রাহকদের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ না রাখা, পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলেও টাকা ফেরত না দেওয়া- ইত্যাদি অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ক্যাশব্যাক অফারের মাধ্যমে পাওনা টাকা নগদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ফেরত না দিয়ে ই-ওয়ালেটে যোগ করা এবং ই-ব্যালেন্স থেকে পণ্য কেনার সময় ১০০ শতাংশ ব্যবহার করতে না দেওয়ার অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ইভ্যালি থেকে অনেক সময় কমমূল্যের ও মানহীন পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে ইভ্যালি। লোভনীয় ডিসকাউন্ট ও ক্যাশব্যাকের অফার দিয়ে দ্রুত গ্রাহকদের কাছে পরিচিতি পায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সময়মতো পণ্য না দেওয়াসহ নানা অভিযোগে সমালোচনার শীর্ষে চলে আসে। মাঝে ইভ্যালিতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ যমুনা। কিন্তু সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে গ্রুপটি। জানা গেছে, ই-ভ্যালির কার্যক্রম শুরুর দুই বছর পার না হতেই নানা কৌশলের আশ্রয়ে প্রতিষ্ঠানটি দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক কোটি টাকা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে শুধু প্রতারণা নয়, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ইভ্যালি যা করেছে তা হলো মাছের তেলে মাছ ভাজা। আবার কিছু তেল সেখান থেকে সরিয়েও ফেলেছে। এই ধরনের ব্যবসা শেষপর্যন্ত টেকে না। ইভ্যালি যেভাবে ব্যবসা করেছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের মূলধন ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য।
এ তালিকায় আরও যারা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে মানুষ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ই কর্মাসে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আস্থার সংকট দুর করতে হবে। তা না হলে ই কর্মাস ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যা ঘুরে দাড়াতে অনেক সময় লাগবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইভ্যালি দুটি ক্ষতি করেছে- প্রথমত, গ্রাহকের ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, ইকমার্সের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট। এরপর থেকে দেশি কোনও প্রতিষ্ঠানকে জনগণ বিশ্বাস করবে না। এই সুযোগে বিদেশি কোম্পানি এসে নিয়ম মেনে ব্যবসা করবে। পরে তাদের দাপটে দেশে নতুন কোনও প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতেই পারবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ