বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আমার কথকতা

আবদুল মান্নান সৈয়দ:

১. 

আমিও গ্রামের ছেলে।

আমাদের গ্রামের নাম ছিলো জালালপুর। মাইলখানেক দূরে ইছামতী নদী দুপুর বেলার পবিত্র রৌদ্রে ঝকঝক করছে- এরকম একটি ছবি চিরদিনের জন্যে লেগে আছে আমার মনে। লেগে আছে মানে লুকিয়ে আছে। মাইলখানেক দূরে রেলোয়ে স্টেশন। তার উল্টোদিকে গ্রামের ইস্কুল- সামনে বিরাট একটা মাঠ। আমাদের বাড়ির সামনে ধুলোওড়া কাঁচা রাস্তা, রাস্তার ওপারে মস্ত একটা পুকুর, এই রাস্তাটাই বেঁকে চ’লে গেছে গভীরতর গ্রামের উদ্দেশে। মোমের তৈরি লাল-নীল-সবুজ ফুল-পাখি ইত্যাদি নিয়ে ফেরিঅলা সেই রাস্তা ধ’রে চ’লে যেতো গরুর গাড়ি যেতে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে আর সন্ধেবেলা গরু নিয়ে গোরুর খুরে ধুলো উড়িয়ে চ’লে যেতো রাখালরা। বাড়ির পেছনে ছিলো আমাদের নিজস্ব পুকুর। তার ওপারে ছিলো চাষিদের দিগন্ত বিস্তৃত খেত। দূরে-দূরে মাটির বাড়ির আভাস। আর এক পাশে ছিলো ‘কশাড়’ (গহন) জঙ্গল-আমাদেরই বাগান। এটা দূরের বাগান। বাড়ির লাগোয়া স্বচ্ছ ব্যবহারযোগ্য বাগানে ছিলো ফলশাগাছ, কালোজামগাছ, জারুলগাছ, আম-কাঁঠাল হগাছ। (এই লেখা লিখতে-লিখতে আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি: পুকুরে ঝুঁকে থাকা গোলাপজামগাছ থেকে এইমাত্র একটা ঝলমলে মাছরাঙা উড়ে গেলো।) পুকুরের সামনেই ঘাট। এক পাশে ‘ট’ পাতা-মাছ ধরবার জন্যে। বাড়ির সামনে, ঠিক দহলিজের মুখেই দুটো ঝাঁকড়া আমগাছ। ঐ ধুলো-ওড়া রাস্তা কোথায় গেছে না-জানি। ঐ বাড়ির পেছনের খেত ছাড়িয়ে দূরের গ্রামখানি কি রকম না জানি। ঐ অজ্ঞাতের উদ্দেশে আমার কল্পনা ছুটে যেতো। ধুলো-ওড়া আজানার উদ্দেশে ধাবমান রাস্তা দেখে কিরকম যে ক’রে উঠতো বুকের ভিতরে।

চার বছর বয়সে ঐ গ্রাম আমাকে ছাড়তে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। ১৩৫০-এর মন্বন্তরে আমার জন্ম-দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালো আর ধাতব দিনগুলোতে। চার বছর বয়সে আমি রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙে সন্ত্রস্ত দেখছি জ্বলন্ত মশাল হাতে দরজার বাইরে কারা যেন দাঁড়িয়ে। আম্মা আমাদের ভাই-বোন ক’টিকে ঘুম ভাঙিয়ে পোটলা বাঁধছেন, বাড়িতে যদি আগুন দ্যায় লুকোতে হবে বাড়ির অদূরের খানার ভেতরে কি আমাদের সেই কশাড় জঙ্গলে। দাঙ্গা। রক্ত আর আগুন। গ্রাম থেকে কলকাতা গিয়ে শেয়ালদা থেকে ট্রেনে চ’ড়ে আমরা চলেছি জন্মভূমি ছেড়ে অন্য দেশে। স্টেশনে-স্টেশনে ট্রেনের কামরায়-কামরায় উঠে যে যা পারে জিনিস-পত্র নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটা পেতলের সামান্য ঘড়া কেন কেড়ে নিয়ে যাবে, তাই নিয়ে আম্মার দীপ্ত যুক্তি দাঁতবের-করা লোভীকেও নিরস্ত ক’রে দ্যায়, লোভী মানুষটার ভিতর থেকে চিরকালের মানুষটার জাগরণ দেখতে-দেখতে অতোটুকু আমি অভিভূত হ’য়ে যাই। বারবার আমি ফিশফিশ ক’রে নানীকে জিজ্ঞেস করছি: লুকানো টাকাটা ঠিকমতো আছে তো? তারপরও যাতায়াত ছিলো। শেষ বার আমরা নদীতে-নদীতে পালিয়ে আসি নৌকায়। জন্মের মতো নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যাই।

আমি আশৈশব বিমর্ষ, গম্ভীর, স্বল্পবাক, লাজুক ও আত্মবৃত। তা কি ছিলো আমার ব্যক্তিস্বভাবেই? নাকি তা আমার জন্মের ঋণশো? পরিপ্রেক্ষিতের চাপ? বোধহয় নিছক পরিপ্রেক্ষিতই নয়- কেননা তার মধ্যে তো ছিলো আরো হাজার-হাজার নরনারী, আশলে বোধহয় আমার রক্তের একেবারে কেন্দ্রকক্ষে ছিলো তার অধিবাস। তাই যে-বয়সে বালকেরা চঞ্চল ও মত্ত তখনই আমি স্বভাব-গম্ভীর, বিমর্ষ, নির্জন, ভাবনাশীল ও আত্মকেন্দ্রী। কিন্তু হয়তো নিছক ব্যক্তিগতও নয়- সেই রক্তাক্ত পরিপ্রেক্ষিতও সমান দায়ী।

আর এইসব ছায়া, অসুখ, শ্যাওলা, দুর্ভিক্ষ ও মহাযুদ্ধের ভিতর থেকেই জন্ম নেয় শিল্পের কুঁড়ি। এরকম আত্মনিবাসী স্বভাব যার সে তো নিজের ভিতর থেকেই বেঁচে থাকবার রশদ জোগাতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। আমিও কখন এভাবে, চাপে-পড়া ঝিনুকের দুই খোরার-পরিপ্রেক্ষিতের আর ব্যক্তিগতের -দুই খোলার সহ্যাতীত চাপে হ’য়ে উঠেছি একজন আত্মবয়নকারী, অর্থাৎ শিল্পী, অর্থাৎ লেখক। স্বাভাবিকভাবে হয়তো ¯্রফে কবি হওয়াই ছিলো আমার নিয়তি; কিন্তু অসম্ভব আত্মবৃত ব’লেই আমাকে অনেক গোপন এ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়তে হয়, নিংড়ে নিতে হয় বিবিধ  বিচিত্রতা, আর সেরকম একটি পথ আমার কথকতা।

২.

 ছোটোবেলা থেকেই ছবি আঁকার সঙ্গে-সঙ্গে, মাটির ঘরবাড়ি বানানোর সঙ্গে-সঙ্গে, নানারকম লেখাও লিখতাম। কবিতা তো ছিলোই, সেই সঙ্গে ছিলো আমার নানারকম লেখার প্রবণতা। আমার জন্ম থেকেই বহির্জগৎ উত্তাল ও বিলোড়ক ছিলো ব’লেই যেন ট্রেঞ্চ খুঁড়ে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম আত্মবিবরে। আর আমি জন্ম মুহূর্তেই পৃথিবীর হাওয়াই চেয়েছিলাম কাফনের ঘ্রাণ। তাই বুঝি আমি এতো বেশি মৃত্যুচিন্তিত। আর যতো মৃত্যুচিন্তিত, ততো বেশি যৌনতাড়িত। প্রথম থেকেই আমি জানি কিছুই কিছু না, প্রথম থেকেই আমার অন্তরে এক বৈরাগী ব’সে-ব’সে তার লাউ বাজায়, তাই প্রথম থেকেই জীবনের ভোগ আমার কাছে কখনো সম্পূর্ণ অর্থহীন কখনো জীবন-দাত্রী। এইসব চিহ্নে আমার গল্পউপন্যাসগুলি অবিরলভাবে খচিত হ’য়ে আছে। এজন্যেই নিছক ‘সামাজিক বাস্তবতা’র গল্প আমি লিখতে পারিনি। এজন্যেই আমার গল্পে আমার অনেক ব্যক্তিগত মানসকুটের ছাপ থেকেই যায়। একই কারণে ছোটোবেলাতেও আমি ছোটোদের লেখা খুব-একটা লিখতে পারিনি। কিশোর বয়স থেকেই আমি-যতো কাঁচাই হোক-লিখেছি প্রাপ্তবয়স্কের লেখা। কবিতার সঙ্গে গল্পও তখনই লিখতাম। 

তখনই, মানে আমার কিশোর বয়সে, চোন্দো-পনেরো-ষোলো বছর বয়সে। তখন লিখতাম সারপ্রাইজের গল্প। ঐ রীতির গল্পের কলা- কৌশল কোত্থেকে শিখেছিলাম, জানি না। সম্ভবত মোপাসাঁর গল্প পড়েছিলাম অনুবাদে। তখন-অনেক দিন পর্যন্ত- এখনো কি নয়? - মোপাসাঁ আর মান্টো আমার দুই প্রিয় লেখক। সারপ্রাইজের গল্পে থাকে অপ্রত্যাশিত নিয়তির মার। ছিলো আমার গল্পেও। সারপ্রাইজের গল্প লেখা পরে ছেড়ে দিই। কিন্তু নিয়তি আমার গল্পে এক অনিবারণীয় অন্তঃ¯্রােতেরমতো (নাকি বলবো নিয়তির মতোই?) তারপরও কাজ ক’রে গেছে। 

 সে-সময়কার আমার গল্পের খাতাগুলো কালের নদীতে ডুবেছে চিরকালে জন্যে। ‘সত্যাসত্য’ নামে তখনকার একটি গল্পই আছে বেঁচে। এই গল্পটি ‘আকাশটা কালো’ নামে প্রথম বেরিয়েছিলো ঢাকা কলেজ বার্ষিকীতে। ছাপার হরফে আমার প্রথম গল্প। কী মনে ক’রে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম য়্যুনিভার্সিটির মেয়েদের হল আয়োজিত একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতায়। হঠাৎ একদিন তখনকার দিনের সবচেয়ে চালু দৈনিক ‘আজাদে’ দেখলাম আমার গল্পটি বিজয়ী হয়েছে। কী খুশি আমার! পরে মেয়ে- বোঝাই কার্জন হলের একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে পুরস্কার নিলাম তৎকালীন ভি. সি. র হাত থেকে। আমার সারপ্রাইজের গল্প-বৃত্তের ঐ একটি গল্পই বেঁচে আছে। হ্যাঁ , সারপ্রাইজের গল্প আমাকেও সারপ্রাইজ দিয়েছিলো সেদিন।  

 কেন- যেন মনে হয়  আমার, সব সচেতন লেখকের ভিতর দিয়েই সাহিত্যের একটি ধারা অনুবর্তিত হয়ে বর্তমান কালে এসে মেশে; সব লেখকই নিজের ভিতর দিয়ে পুরো সাহিত্যের ইতিহাসের একটি বৃত্ত পরিক্রমণ করেন। আমার গল্পের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। সারপ্রাইজের গল্প পরে আমার কাছে মনে হয়েছে কৃত্রিম একটি শিল্পকাজ। (সব শিল্পকলাই অবশ্য কৃত্রিম, তবু অকৃতিমতার যে-অভিনয় শিল্পকলা ক’রে থাকে- সেই দিক থেকে কথাটি বললাম।) জীবনে আকস্মিক’ বিস্ময় থাকে, কিন্তু তার মধ্যেও তাকে এক মসৃণ প্রবহমানতা। গল্প যেহেতু জীবনের প্রতিরূপ বা ছাঁচ, কাজেই তার মধ্যেও থাকতে হবে এক সাবলীল সচলতা। আবার, একটি গল্পের মধ্যে যে-সম্পূর্ণতা আমি আকাক্সক্ষা করি, বা যে- কোনো শিল্পকাজের যা আরাধ্য, সারপ্রাইজের গল্প (খুব রূঢ়ভাবে হ’লেও) তা মেটায় মসৃণ জীবন প্রভৃতি গল্পেও দিতে হয় এক সম্পূর্ণতা তবে তার কৌশল আলাদা।

 সে-সময় গল্পে অবিরলভাবে লিপ্ত থেকে আমি ক্রমশ খুঁজে ফিরছিলাম নিজস্ব-চিহ্নিত ক্ষেত্র। ‘সত্যাসত্য’ লিখেছিলাম ১৯৫৯ শালে; আমি তখন কলেজের ছাত্র। ১৯৬২ শালে লিখলাম ‘মাতৃহননের নান্দীপাঠ’, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। এই গল্পে, এতোদিনে, আমি এসে  দাঁড়ালাম নিজের জায়গায়। গল্পটি লিখেছিলাম একটি আপাতবিনোদক-কিন্তু-সংগোপন সাহিত্যপত্রিকায়। পরে বোধহয় পড়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি ক্লাসকক্ষে অনুষ্ঠিত কয়েকজন সমানধর্মা গল্পকারের উপস্থিতিতে, এক ঘনবদ্ধ ছোটো উৎসুক আসরে। গল্পটি লিখেছিলাম এক টানে, কাগজের দুই পৃষ্ঠায়। গল্প-প্রকরণের যে সচল প্রবহমানতা তখন আমার আরাধ্য ছিলো, ঐ গল্পটি যেন তারই একটি চিত্রল প্রতিভাস। আত্মখনন, নিয়তি, যৌনতা, অবিশ্বাস, অন্ধকার- আমার গল্পের এইসব জিনিশ প্রথম ঐ গল্পেই দেখা দ্যায় এক সংহত সারাৎসারে।  

তারপর এক-এক ক’রে গল্প লিখে চলি। এক-একটি গল্প লিখতাম তখন যেন ঘোরের মধ্যে থেকে, যেন আমূল আবিষ্ট হ’য়ে। এক-একটি গল্প মনের মতো সম্পূর্ণতা দেবার জন্য পরিশোধনের পর পরিশোধন ক’রে চলতাম। বহির্জগতের অভিজ্ঞতা ছিলো আমার সীমিত। আর আমি নিজে আত্মবৃত মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই আমার গল্পের লক্ষ্য হ’য়ে পড়ে ‘অন্তর্গত মানুষ’। 

১৯৬৮ শালে আমার প্রথম গল্পের বই বেরুলো, ‘সত্যের মত বদমাশ’। এই বইয়ের গল্পগুচ্ছে আমার তৎকালীন গল্প-মানসতা ধরা আছে। এই বইয়ের বারোটি গল্পের মধ্যে ‘সত্যাসত্য’ গল্পের কথা তো আগেই বলেছি, যা ছিলো আমার এক সময়কার গল্প-ধারার প্রতিভূ-গল্প। দ্বিতীয় গল্পটিই ‘মাতৃহননের নান্দীপাঠ’ - আমার সমস্ত গল্পের বীজ-গল্প। অনেক যতœ ও আনন্দে এক-একটি গল্প তৈরি করেছি। গল্প তো নয়, এক-একটি পৃথিবী। মহাকাশে যেমন সংখ্যাহীন গ্রহ-নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে, তেমনি। কিন্তু তার ক’টিই বা লিখতে পেরেছি। কতো গল্পের পর গল্পের থিম মাথায় এসেছে - তারপর অলিখিত অবস্থায় মিলিয়ে গেছে। গল্পও তো অনেক সময় বিদ্যুতের মতো-ক্ষণকালীন  একটি উদ্ভাসের পরই সে অনন্তে হারায়। শুধু তার মধ্যে যে-ক’টি লিখিত ও প্রকাশিত হ’লো সে-ক’টিই থেকে যায়। ‘সত্যের মতো বদমাশ’-এর বারোটি গল্পে ধরা আছে আমার প্রাথমিক গল্প-বিশ্ব। ঐ বইয়ের ‘চাবি’ বা ‘সত্যের মতো বদমাশে’ যে ধারা তৈরি হয়েছিলো তারই পরবর্তী ফল ‘চলো যাই পরোক্ষে’র প্রতীকী গল্পগুচ্ছ। ‘চলো যাই পরোক্ষে’র প্রতীকী দশটি গল্প একক চরিত্রবান। মোটামুটি একটি মানসিকতায় আক্রান্ত হ’য়ে লেখা-অনেক সময় একগুচ্ছ কবিতা যেমন লেখেন কবিরা একটি আবহমন্ডলে ব’সে, সেরকম। ঐ দুই গল্পেই যৌনতার সঙ্গে মিশেছিলো আমার আধ্যাত্মিক এষণা। একবার একটি নাটক লিখেছিলাম আমি ‘না ফেরেশতা না শয়তান’ নামে। আমার গল্পের পক্ষে বলা যেতে পারে, তা ফেরেশতাও, এবং শয়তানও। আমার সাহিত্য জীবনের প্রথম থেকেই বস্তুপৃথিবী এবং অবস্তুপৃথিবী দুই-ই আমাকে সমভাবে আকর্ষণ করেছিলো। ফলে আমার গল্পে সব সময় শয়তানের রাজত্ব, সব সময় ফেরেশতার আহবান। প্রথম থেকেই আমি ঐ দুজনের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, আবিষ্ট থেকেছি। লোকসমাজে আমি মিশতে পারতাম না; এখনো পারি না। ফলে আমার ভিতরে আত্ম-টানাপোড়েনের অনেক ছাপ ও চিহ্ন আমি নিজেই আবিষ্কার করেছি। সেসব আবিষ্কার আমার গল্পে উপন্যাসে খুব স্বাভাবিকভাবেই স্থান পেয়েছে।

প্রতীকী গল্পের তবু একটি চিহ্ন স্থাপিত হয়েছে ‘চলো যাই পরোক্ষে’ গ্রন্থে, কিন্তু সাধারণভাবে আমার মনস্তত্বের প্রতি যে-উন্মুখিতা তার কোনো একক স্থির বই নেই। যদিও আমার কথকতার সব প্রচেষ্টার ভেতরই তার কোনো-না-কোনো স্বাক্ষর র’য়ে গেছে। 

গল্প নিয়ে সত্যি এক সময় খুব মেতেছিলাম। যদিও, এখন মনে হচ্ছে, ফসল সেই তুলনায় সামান্যই ফলেছে। ‘আত্মতাড়িতেরা’ নামে তখন যে-সররিয়ালিস্ট গল্প লিখেছিলাম, যা ছিলো আমার তখনকার সুররিয়ালিস্ট কবিতারই সহযোগী, কেননা তখন লেখা চলছে ‘জমান্ধ কবিতাগুচ্ছে’র কবিতা, তার ধারাবাহিকতা আর ঠিক সচল থাকেনি। ঐ নামেই আরো দু-একটি সুররিয়ালিস্ট গল্প লিখেছিলাম, কিন্তু তা বেশিদূর আর বহাল থাকেনি। ৬৫-৬৬-৬৭ শালের দিকে কায়সার নামে এক নবীন যুবাকে নিয়ে গল্প লিখতাম, যে আশলে ছিলো আমারই প্রতিরূপ, সেই গল্পগুলি ‘ গোধূলি-দ্বারা আক্রান্ত’ নামে বেরোনোর কথা ছিলো-পান্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছি।।

 

গল্প নিয়ে ঐ মত্ততা এক সময় অবসিত হ’য়ে গেছে। কিন্তু এই প্রকরণটি এখনো আমার কাছে সবচেয়ে তৃপ্তিকর। এখনো একটি মন-মতো গল্প লিখে উঠতে পারলে  যে-অপরিমেয় আনন্দ পাই, কোনো কিছুর সঙ্গে তার তুলনা হয় না। বিভিন্ন মাধ্যমে আমি কাজ করি। কিন্তু গল্প লিখে যে-আনন্দ পাই, আর-কোনো মাধ্যম তা আমাকে দ্যায় না। যদি দৈবদুর্বিপাকে এরকম কোনো আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যে আমাকে একটিমাত্র মাধ্যমে লিখতে হবে, তাহলে আমি যে-মাধ্যমটি বেছে নেবো তা ছোটোগল্পে। গল্পের খর¯্রােত ক’মে এলেও ধারাবাহিকতা কখনো নষ্ট হয়নি আমার। ১৯৭৯ নাগাদ দু’টি ঝরনা উদগীত হয়েছে; ‘দরোজা’ গল্প থেকে একেবারে পারিবারিক কেন্দ্র থেকে গল্পের বিষয় নির্বাচন; আর অমরতার জন্যে মৃত্যু’ গল্প থেকে ইতিহাসধর্মী গল্প রচনা। এসবের আগে চিত্রনাট্যের ধরনে কিছু গল্প লিখেছিলাম। সেগুলোও কোনো একক আধারে ধরা হয়নি। আমার অন্যান্য সাহিত্যমাধ্যমের মতো ছোটোগল্পেও আমি ভ্রাম্যমাণ। তার বিষয়ের মতো রচনার পদ্ধতিও বারবার বদলেছে: ছক-কাটা পূর্বপরিকল্পিত গল্প থেকে এখন আমি স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী। গল্পই লিখতে চাই।

৩.

উপন্যাস নামধেয় কয়েকটি রচনা লিখলেও আমি যাকে সত্যিকার উপন্যাস ব’লে মনে করি, লিখিনি একটিও। আবার, যেগুলি লিখেছি, সেগুলিকে উপন্যাস ছাড়া কিইবা বলতে পারি? হ্যাঁ, এতো দিনে একটি নাম খুঁজে পেয়েছিÑনভেলা। যে-পাঁচ-সাতটি নভেলা আমি লিখেছি, সেগুলি সম্পর্কে দু’একটি কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

প্রকৃত উপন্যাস লিখবার মতো লিখনের ও জীবনের অভিজ্ঞতা কোনোটিই আমার হয়নি। অর্থাৎ সোজা কথায়, আমার ধারণা, আমি উপন্যাস লিখতে অক্ষম। কাজেই কখনো সে- চেষ্টাই করিনি। তাহ’লেও আমার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে ছোটো উপন্যাস বা নভেলা হয়তো সম্ভব-এই বিবেচনা থেকেই কয়েকটি দীর্ঘ কাহিনী লিখে ফেলেছি। ‘নভেলা’ শব্দটি ‘সনেট’-এর মতোই বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তিত হওয়া উচিত-হয়তো হবেও কোনো দিন। আপাতত বারবার ‘নভেলা’ না -ব’লে আমি ‘উপন্যাস’ শব্দটিই চালাবো এখানে।      

 কোনো উপন্যাসই আমি নিজে থেকে লিখিনি। (আত্মতাড়নায় অন্তত একটি উপন্যাস লিখবো ব’লে ভাবছি কিছু দিন থেকে।) আমার উপন্যাসগুলো লিখেছি সম্পাদক ও বন্ধুবান্ধবের প্রচন্ড চাপে। গত কয়েক বছরে কয়েকটি, মূলত ঈদ সংখ্যার জন্যে। চাপে প’ড়ে কয়েক দিনে বা সপ্তা’য় লিখে ফেলি। (আর যা আত্মতাড়নায় লেখা নয়, - তার সাফল্য অকিঞ্চিৎকর তো হবেই।)

নভেলা লিখতে গিয়েই বুঝলাম, ছোটোগল্প আর উপন্যাসের চরিত্র এক নয়। সংহতি নয়, বিস্তারের দিকেই এর ঝোঁক। এমনকি দু’ফর্মার একটি লেখাও লিখেছি (‘প্রবেশ’), অন্তশ্চারিত্রে যা উপন্যাসই। অথচ দু’ ফর্মার ছোটোগল্পও অসম্ভব নয়। এটা লিখতে গিয়েই আমি অনুভব করি, উপন্যাস আলাদা জিনিশ, উপন্যাস ছোটোগল্প নয়, ওর ধনুকের ছিলা অতো টানটান ক’রে না-বাঁধলেও চলে, এমনকি ওটাই বোধহয় নিয়ম। আর যে- কোনো ফর্মই তো অনুশীলন ক’রে-ক’রে আয়ত্ত করতে হয়। উপন্যাসও তাই। কয়েকটি ছোটো উপন্যাস লিখে ফেলার পর এখন যেন ভরসা হচ্ছে, প্রকৃত উপন্যাস না-লিখতে পারলেও ছোটো উপন্যাস বা নভেলা হয়তো পারবো। এমনকি এই মাধ্যমটি ভালোও লাগছে। যেন একটু হাত-পা খেলানোর পরিসর পেয়েছি। জীবনের কতো ঋতু পার ক’রে দিলাম! বহির্জীবনের হাজার অভিজ্ঞতা জমা হ’লো। অন্তর্জীবনের হাজার অভিজ্ঞতা জমা হ’লো। আর আমার জীবন বিষয়ক বাণী প্রকাশের জন্যও এই গদ্য মাধ্যমটি এখন মনে হচ্ছে বেশ উপযোগী। আমি কাব্যনাটকে কবি বা লেখক-শিল্পীর জীবনবাণী প্রকাশের খুব উপযোগী মাধ্যম ব’লে মনে করি। ‘বিশ্বাসের তরু’ নামে এক সময় লিখেও ছিলাম একটি কাব্যনাট্য -যার মধ্যে আমার তৎকালীন জীবনবাণী প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু কাব্যনাট্য তো-তাই কোথায় তাতে একটুখানি কবিতার রঙ বা নাটকের সুর লেগে থাকে, যা হয়তো আমাদের গদ্যবাহিত জীবনে একটুখানি পালিশ। কিন্তু ছোটো উপন্যাসে ঐটুকু অতিরঞ্জনেরও দরকার হয় না-জীবনের একেবারে বস্তুভিত্তিতেই তার স্থাপনা। মাটির উপরে আমরা বাস করি ঠিকই, কিন্তু নীল আকাশটাও তো মিথ্যে না। উপন্যাস সেই নীল আকাশকেও দেখায়-গলির ওপরে যে-নীল আকাশ জেগে থাকে, তাকেও। উপন্যাসের কবিত্ব শব্দের কবিত্ব না, জীবনের কবিত্ব। 

নিজের উপন্যাসগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখছি আমার সব উপন্যাসের নায়করাই শেষ-অব্দি পরাজিত। জীবনের বিস্ময়ের আশ্চর্য পথ দিয়ে চ’লে যায় তারা, কিন্তু শেষ-পর্যন্ত তারা শোচনীয় পরাজয়কেই ডেকে আনে। আমার বিশ্বাস, আমি কোনো মন-গড়া তমসালিপ্ত উপন্যাস লিখিনি। জীবনের কথাই লিখেছি-অন্তর্জীবনের কথা-স্বাভাবিকভাবেই যা কোনো নির্দেশিত বা পূর্বনির্দিষ্ট ব্যাপার নয়, জীবনের পথে চলতে-চলতে যা আমারই নিজস্ব উপার্জন। আমার কোনো-কোনো গল্পে আমি যে-রূপক বা প্রতীকের ব্যবহার করেছি, উপন্যাসে তা করিনি কখনোই। কবিতায় আমার প্রতীক প্রয়োগের একটি ঝোঁক আছে অনেক দিন থেকেই- ছোটো গল্পেও প্রতীকের ব্যবহার আমার পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক। কিন্তু উপন্যাসের দীর্ঘ পরিসরে আমার মনে হয়েছে তা অব্যবহার্য। জীবনের একান্ত স্বাভাবিক উদযাপন ও পরিণামকে অঙ্কিত করতে গিয়েই দেখেছি আমার নায়কেরা ভেঙে  পড়েছে বার-বার। মানুষের ঘটনার প্রকৃতির মধ্যে যে-বিস্ময় আমার ঔপন্যাসিক সত্তা সেই বিস্ময়ে প্লুত হয়েছে বার-বার। আর সব বিস্ময়েই থাকে এক- ফোঁটা আনন্দ ও মুগ্ধতা। আমার নায়কেরা ঐ মুগ্ধতার শিকারী; তবু শেষ রক্ষা হয় না; শেষ দৃশ্যে তারা পতিত হয়। কেননা, আমাদের সব মানুষের, সুখী মানুষেরও জীবন শেষ-পর্যন্ত ট্রাজিক। উজ্জ্বল অগ্নিশিখা জ্ব’লে-জ্ব’লে শেষ-পর্যন্ত প’ড়ে থাকে নিরাশ্বাস ছাই। নিজেকেই নায়ক ক’রে কিশোরবেলা একটা গল্প লিখেছিলাম একবার-নিজেকে বাঁচানোরও পরিতৃপ্তি দেবার জন্যে। বয়স হ’য়ে যাওয়ার পর তো তা আর সম্ভব নয়।

শুধু কবির লেখা উপন্যাস নয়, এমনকি গদ্যতম ঔপন্যাসিকেরও কেন্দ্রীয় চরিত্রে তার নিজের ছায়া পড়বেই। সে-ছায়া বাস্তবের ছায়া; কিন্তু তার স্বপ্ন ও ইচ্ছা, কল্পনা ও আকাক্সক্ষারও ছায়া; অর্থাৎ সব মিলিয়ে লেখকের বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির ছায়া। আবার এই দুয়ের শৈল্পিক মিশেল ঘটে এমন এক আশ্চর্য রসায়নে যে লেখক এবং তার নায়ক হ’য়ে ওঠে বিভিন্ন দুই চরিত্র। উপন্যাসের কোনো চরিত্রই তো আর অবিকল বাস্তব নয়, কল্পনার মিশেল তাতে থাকেই। ঔপন্যাসিকও তো মানুষ। তিনিও পৃথিবীতে যে-মানুষটিকে সবচেয়ে বেশি জানেন সে তিনি স্বয়ং। কাজেই ঔপন্যাসিকের আত্মপ্রতিফলন স্বাভাবিক। কিন্তু আত্মও তো একক নয় বা নয় এককের প্রতিবম্ব। নিজের ভিতরেই আছে হাজার-হাজার মানুষের প্রতিচ্ছবি। আমার নিজের উপন্যাসসমূহের কেন্দ্রীয় চরিত্রে হয়তো আমার অজ্ঞাতেই আমার অন্তঃপৃথিবী রূপ পেয়েছে। 

এখন পর্যন্ত যে-ক’টি উপন্যাস লিখেছি, তার মধ্যে দু’টি আমার খানিকটা অনুমোদন পায়। ‘অ-তে অজগর’ এবং ‘পোড়ামাটির কাজ’। এসব উপন্যাস লিখতে গিয়ে দেখিছি সেখানেও সচেতন বুদ্ধিই নয় সমস্তের নিয়ন্তা। কবিতার মতো সেখানেও অজ্ঞাতসারে কাজ ক’রে যায় সম্পূর্ণ অস্তিত্ব-যার অনেকখানি হয়তো সচেতন নয়। কাজেই চরিত্র, ঘটনা, পটভূমি বা এরকম সব কলকব্জা দিয়েই একটি উপন্যাসকে বিচার করা চলে না, তারপরেও কিছু রহস্য বাকি থেকে যায়। অতিদ্রুত রচনার মধ্যেও কি-ক’রে-যেন কি-ক’রে-যেন কাজ ক’রে যায় গোপন সব সূত্র, উল্লেখ, পরম্পরা। যা হয়তো সব মিলিয়ে ঔপন্যাসিককেও দান করে তার নিজের সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে এক বিস্ময়। 

এই রচনারই প্রথম পরিচ্ছেদে যে-জগতে কথা বলেছি, তাই নিয়ে লেখা ‘অ-তে অজগর’। ছেলেবেলা বোধহয় চিরকালের মতো মানুষের আত্মায় চেপে ব’সে থাকে। তিরিশ পেরিয়ে দেখি টানছে আমার ছেলেবেলা, জন্মজায়গা। তার স্বাক্ষর আছে আমার কিছু কবিতায় আর ছোটোগল্পে। এখানে, একটি পুরো উপন্যাসে। উপন্যাসশোভন অনেক স্বাধীনতাও নিয়েছি। এই কাহিনীর মন্টু আমার আরো কোনো-কোনো গল্পে ছিলো। মন্টু এক চির-কিশোর। ওকে নিয়ে খুব স্থির চিন্তা ক’রে গল্পে ছিলো। মন্টু এক চির-কিশোর। ওকে নিয়ে খুব স্থির চিন্তা ক’রে গল্প-উপন্যাস লিখিনি- যেমন এক সময় কয়েকটি গল্প লিখেছিলাম কায়সার নামে একটি চরিত্র নিয়ে। একটা সময়কে কায়সার আমার প্রতিনিধিত্ব করেছে ঠিকই, কিন্তু আমার অপরিকল্পিত মন্টুই বোধহয় সাহিত্যিকভাবে বেশি সফল। মন্টুও আমার প্রতিরূপ, কিন্তু আমার অজ্ঞাতসারে মন্টু এক চির-কিশোর, যে কোনো দিন বয়স্ক হ’লো না। মন্টুকে নিয়ে ‘চমৎকার অবচেতন’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম অনেক দিন আগে, তার অনেক পরে ‘অস্তিত্ব অন্যত্র’ নামে আর-একটি গল্প। “পোড়ামাটির কাজ” আমার ইতিহাসকেন্দ্রী গল্প দ্বারা সঙ্গী। ইতিহাসের নিছক মধুর বা অমধুর পলায়ন বা পুনর্রূপায়ণ আমার লক্ষ্য নয়। একটা যে- কোনো গল্প বা উপন্যাসে আমার যা বক্তব্য, তাকেই আমি কখনো-কখনো ইতিহাসের পাত্রে পরিবেশন করেছি বা করতে চাই। 

ঔপন্যাসিক হিসাবে আমি এ্যাডভেঞ্চার-পন্থী। একটি বিষয়ে জ্যা-নিবদ্ধ না- থেকে নতুন-নতুন বিষয় আমাকে টানে-যখন আমি  উপন্যাস লিখতে যাই। অনুবাদ ক’রে খেলা করার যে-আনন্দ পাই, প্রায় তাই আমি পাই উপন্যাস লিখে। খেলতে- খেলাতে, এখন মনে হচ্ছে, সিরিয়াসভাবে শুরু করা দরকার। এখন তো বয়স হচ্ছে। খেলা আর কতো।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ