রাজধানীর বুকে বেসামাল ডেঙ্গু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগী
তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : ‘মশার জ্বালা বড় জ্বালা’-এই ক্ষেদোক্তি এখন রাজধানী ঢাকার ঘরে ঘরে। ‘ছোট্ট’ একটা প্রাণী মশার ‘বড়’ উৎপাতে নাজেহাল নাগরীক জীবনে ছন্দপতন ঘটছেই। এই মশাবাহিত রোগ “ডেঙ্গু” আশংকাজনকহারে বাড়ছেই। দিন দিন যে হারে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার রেকর্ড গড়ছে তাতে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরই বলছে ‘ঢাকার বুকে বেসামাল ডেঙ্গু’। মশা সামলাতে ব্যস্ত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। তাদের মশক নিধন বাহিনীও বসে নেই। প্রতিদিনই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি অভিযান, জরিমানা, সচেতনতামূলক কার্যক্রম, মশা তাড়াতে ধোঁয়া (ফগিং), উৎসমূলে লার্ভিসাইডিংসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিধন করতে পারছে না। ‘ডেঙ্গু’ জ্বরবাহি এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ নিতে সব চেষ্টাই কার্যত ব্যর্থ হতে চলেছে। বেপরোয়া এডিস মশার ওড়াওড়ি আর কামড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। সর্বশেষ গত ২৪ ঘন্টায় আগের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ১৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী দেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তারমধ্যে শুধুমাত্র ঢাকার হাসপাতালেই ১৫০জন রোগী।
চলমান মহামারি করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর এই বিস্তার নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে সরকার। দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র জানিয়েছেন, ডেঙ্গু বেড়েছে। এডিসের উপযোগী পরিবেশ দেখা গেলে ভবনে অভিযান চালিয়ে নানা সময় নগর কর্তৃপক্ষ জরিমানাও করছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম আশঙ্কা করছেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। মেয়রের আক্ষেপ, তারা রোগীর তথ্য পাচ্ছেন না। হাসপাতালে যে নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ হয়, সেটিও সঠিক নয়। ফলে কোন কোন এলাকায় আসলে রোগী বেশি, সেই বিষয়ে নগর কর্তৃপক্ষের ধারণা থাকে না। আর এ কারণে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন।
আর দক্ষিণের মেয়র শেখ তাপস বলেছেন, তাদের পক্ষে সবার বাড়ি বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। যেখানে এডিস মশার দেখা মিলবে খবর দিলে তারা সেখানে গিয়ে তা দমনে কার্যকর ভূমিকা নেবে। বর্তমানের পরিস্থিতিতে কোনো উদ্বেগ নেই বলে জানান এই মেয়র। তবে, আগষ্টে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জিং হবে বলে তিনি মনে করেন।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চললেও ২০১৯ সালে ঢাকায় ব্যাপকভাবে এ রোগ ছড়ায়। সে সময় সরকারি হিসাবে দেশে লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত ও দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর সমালোচনার মুখে দুই বছর ঢাকায় মশকনিধনে ব্যাপক কার্যক্রম চালায় দুই সিটি করপোরেশন। এবার করোনা মহামারির মধ্যে আবার সেই ডেঙ্গু নতুন দুশ্চিন্তা হয়ে দেখা দিয়েছে।
ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় মশার মাধ্যমে। আর অন্য মশার সঙ্গে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশার পার্থক্য আছে। এই মশাগুলোর জন্ম হয় ঘরের আবদ্ধ পরিবেশে। ফলে নাগরিকরা সচেতন না হলে এই রোগ প্রতিরোধ করা কঠিন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। মানুষ এখন ঈদের জন্য দেশের বাড়িতে গেছে, যা ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা শহরে যে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা রয়েছে, লকডাউনের কারণে সেগুলো এখন বন্ধ। এগুলো এখন এডিস মশার প্রজননের বড় ক্ষেত্র।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে মশা নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার, এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করাসহ অন্য উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের শরীরেও জ্বর থাকে। তাই জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের করোনা পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু পরীক্ষাও করতে হবে এবং পরীক্ষাপ্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই রোগীর পরবর্তী চিকিৎসাসেবা দিতে হবে।’
ভিসি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের পাশাপাশি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরুষ ও নারীদের জন্য মেডিসিন বিভাগে ২৬ শয্যার এবং শিশুদের জন্য শিশু বিভাগে ১২ শয্যার ডেঙ্গু কর্নার চালু করা হয়েছে।’ ডেঙ্গ জ্বর প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে মশা নিধন কার্যক্রম আরো জোরদার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার, এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করাসহ অন্যান্য উদ্যোগ বাস্তবায়নের আহ্বানও জানান তিনি।
এডিস মশার বিস্তার প্রতিরোধে বাসাবাড়ি ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখা, বিশেষ করে তিন দিন যেন পানি জমতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। এই মশার জন্ম হয় জমে থাকা এই পরিষ্কার পানিতে। আর মশাগুলো ঘরোয়া পরিবেশে ডিম দিতে পছন্দ করে।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগে ব্যাপক প্রাণহানি ও লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর গত বছর সতর্ক অবস্থানে ছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ২০২০ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪০৫ জন, যাদের মধ্যে ৬ জন মারা যায়। এর আগের বছর ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটে। সেবার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখের বেশি, যাদের মধ্যে মারা যায় ১৭৯ জন। গত বছরে সংক্রমণের মাত্রা অনেকটা কমলেও এ বছর পরিস্থিতি এখনই খারাপের দিকে।
এরইমধ্যে রাজধানীর ১৭টি জায়গাকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে বিবেচনা করে সোমবার থেকে সেসব এলাকায় মশা মারার ওষুধ ছিটাতে ঢাকার সিটি করপোরেশনের মেয়রদের নির্দেশ প্রদান করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ডেঙ্গু নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে তিনি গত রোববার সচিবালয়ে এক জরুরি বৈঠকে এই নির্দেশ দেন। রামপুরা, মহাখালী, মগবাজার, সিদ্ধেশ্বরী, শান্তিনগর, ক্যান্টনমেন্ট, সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, পল্টন, খিলগাঁও, মিরপুর, বসুন্ধরা, মুগদা, বাসাবো, সবুজবাগ, বাড্ডা এবং মোহাম্মদপুরকে ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ঢাকার ৬টি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষনার কাজ চুড়ান্ত করেছেন। এই হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করা হবে।
২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ১৫৩ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বর্তমানে প্রতি ঘণ্টায় ছয়জনের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতালে মোট ১৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার একদিনে সর্বোচ্চ ১৪৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
তাদের মধ্যে রাজধানীর হাসপাতালে ১৫০ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে তিনজন ভর্তি হন। এ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬৮ জন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৫৫৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ১১ জন ভর্তি রয়েছেন। ডেঙ্গু সন্দেহে মারা যাওয়া চারজন রোগীর তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৫৩ জনের মধ্যে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ৩৬ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ১১৪ জন এবং ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের হাসপাতালে তিনজন ভর্তি রয়েছেন।
গতকাল বুধবার স্বাস্থ্যঅধিদফতরের স্বাস্থ্য তথ্য ইউনিটের (এমআইএস) সহকারী পরিচালক ও হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. কামরুল কিবরিয়া স্বাক্ষরিত ডেঙ্গু সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ৩৬ জনের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মিটফোর্ড হাসপাতালে ২৯ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে চারজন এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনজন ভর্তি হন।
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেলে একজন, হলি ফ্যামিলিতে ছয়জন, বারডেমে তিনজন, ইবনে সিনায় ছয়জন, স্কয়ারে ছয়জন, ডেল্টা মেডিকেল মিরপুরে তিনজন, ল্যাবএইডে একজন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১২ জন, গ্রিনলাইফ হাসপাতালে নয়জন, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল কাকরাইলে ১৬ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে দুইজন, খিদমা হাসপাতাল খিলগাঁওয়ে ছয়জন, সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয়জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন।
এছাড়াও এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনজন, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সাতজন, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুইজন, বি আরবি হাসপাতালে তিনজন, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে দুইজন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারজন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে আটজন, পপুলার ধানমন্ডিতে দুইজন, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে তিনজন এবং আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন ভর্তি রয়েছেন।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল ২৮ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে সর্বমোট দুই হাজার ৯৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এক হাজার ৫২৬ জন রোগী।
চলতি বছর জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে নয়জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে তিনজন, মে’তে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন এবং ২৮ জুলাই পর্যন্ত এক হাজার ৭২৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।