শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

করোনায় ভালো নেই তারাও

মাহমুদ শরীফ : মোটেও ভালো নেই তারা। বেশ কষ্টে আছেন সাংবাদিকরা। করোনা মহামারির ফলে দীর্ঘদিন ধরে অচলাবস্থা চলছে অনেক সাংবাদিকের সংসারে। এমতবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা। অনেকের সাথে কথা বললে তারা তাদের নানা রকম কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা-হতাশার কথা তুলে ধরেন। স্বাদ আছে কিন্তু সাধ্য থাকে না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে বারবার। অনেকের আক্ষেপ- ভাই, আমার অবস্থা কী আর বলবো- কারো কাছে কিছু চাইলে কেউ বিশ্বাস করতে চায়না আমার অভাব আছে। সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। ভালো প্যান্ট, ভালো শার্ট না পরলে মান থাকেনা। না পারি ভ্যান চলাতে- না পারি ব্যবসা করতে। জীবনের কঠিন সময় পার করছি, দেখার কেউ নেই।
অধিকাংশ সাংবাদিকের মধ্যবিত্ত পরিবার। এরা না গরীব না ধনী। এই শ্রেণীর লোকেরা পৃথিবীতে আসে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জন্যই হয়তো! মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সাংবাদিক স্বপ্ন দেখে না বা স্বপ্ন দেখতে ভয় পায় এখন! কারণ তারা জানেন স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট খুবই মারাত্মক হয়।
উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকরা বলেন, আমরা বেতন-ভাতা পাই সামান্য। সেই সামান্য টাকাকে সম্মানী বললে চলে! এই সামান্য টাকাতেই সংসার চলে তাদের। গত এক/দেড় বছর ধরে বেতন ভাতা না পেয়ে খুব কষ্টে আছে প্রায় সবাই। ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না। অনেক সাংবাদিক বাধ্য হয়ে বারবার জায়গা/প্রতিষ্ঠান বদলান। কেউ কেউ উপজেলা ছেড়ে রাজধানী ধরেন। আবার কতজনই ফিরে যান আবার মফস্বলে। ভালো না থাকা আর সুবিধার অভাবেই এমনটি করতে হয়। দেশের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের হেড অব নিউজ আছেন এক প্রিয়জন। তিনি সম্প্রতি আক্ষেপ করে বললেন- ঢাবিতে যাদের সাথে ডিগ্রী নিয়েছিলাম তারা এখন বিসিএস দিয়ে প্রশাসনের বড় বড় পদে আসীন। আর আমি! বেতন-ভাতা বাকীতে শ্রম দিচ্ছি, কোথায় আমার ভবিষ্যৎ! আরেকজন বন্ধু একটি প্রতিষ্ঠিত টিভি চ্যানেলের ন্যাশনাল ডেক্স ইনচার্জ। তিনি জানান, দুই যুগ নষ্ট করলাম। আমার সাথে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে রাজধানীতে এসে ব্যবসায়ী হয়ে আজ ১/২টি ফ্লাটের মালিক। আর আমি আজও ভাড়া বাসায় থাকি। আমার ভালোবাসা আর পরামর্শের একজন মেধাবী সাংবাদিক, একটি জাতীয় দৈনিকের প্রভাবশালী ব্যুরো প্রধান আজ করোনায় নাকাল। তিনি বাধ্য হয়ে ইউটিউব চ্যানেল খুলে আয়ের পথ খুঁজছেন। জাতীয় পর্যারে অনেক সাংবাদিক কত মাস যে বেতন-ভাতা নিয়মিত পান না, সেটাও যেন ভুলে গেছেন। আর স্থানীয় পত্রিকার তো বেতন-ভাতার রেজিষ্টারই নাই।
সাংবাদিক সমাজ অন্যের জন্য যতটুকু করছেন নিজের বেলায় তা করতে পারছেন না। শান্তি নেই তাদের সংসারে। নুন আনতে পান্তা শেষ হচ্ছে। তবে কিছু দালাল টাউট বাটপারের কথা ভিন্ন! চামচামি করে বেশ বহাল তবিয়তে তারা। মফস্বলের সাংবাদিকদের অবস্থা আমি বেশি জ্ঞাত।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে কথা বললে তাদের দুঃখ দুর্দশার নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে সেই ব্যথাগুলো তুলে ধরছি-
প্রবীণ সাংবাদিক বকুল চৌধুরী বলেন, ঘরে থাকি। বন্ধী জীবন কাটাচ্ছি। সংসার চলছে কষ্টে। চোখে লজ্জা, মুখে কিছু বলতেও পারি না। তিনি জানান, সরকার যদি উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকদের দিকে নজর না দেয়, তাহলে অনেকেই পেশা ছাড়তে বাধ্য হবে।
হাবীব চৌহান জানান, পেশাগত কাজে উদ্যমের ঘাটতি নেই, সাদামাটা জীবনযাপনে বেঁচে আছি এটাই সত্য। নিউজের ক্ষেত্র সংকীর্ণ হয়ে গেছে- তবে জীবন-সংসার তেমন ভালো চলছে না। আগামীর পথচলা শুভ হোক এই প্রত্যাশা করেন তিনি।
সাংবাদিক লিপু খন্দকার জানান, করোনা, লকডাউন, ব্যবসায়ীদের ক্ষতি সবই তীব্র গতিতে চলমান। সাংবাদিকরাও রয়েছে চরম খারাপ পর্যায়ে। মফস্বলের এই সাংবাদিকদের কথা কারোর ভাববার সময় নেই। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, সরকার সাংবাদিকদের প্রণোদনা দিয়েছে, কিন্তু প্রকৃত সাংবাদিকরা সেটা পাননি। তিনি করোনা মহামারিতে সাংবাদিকদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে ভাববার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
নবীন সাংবাদিক মনোয়ার হোসেন দুঃখের সাথে বলেন, পুলিশ- বিজিবি- সেনাবাহিনী- আনসার আর ডাক্তারদের সাথে করোনার মধ্যে কাজ করছি। জীবনের শংকা রয়েছে। অন্যের জন্য কাঁদছি, নিজের জন্য কিছুই করতে পারছি না। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বুঝতে পারছি- মফস্বলে থাকলে এই পেশায় অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীদের যুক্ত হওয়া উচিত।
সাংবাদিক কে এম সিদ্দিকুর রহমান পক্ষাঘাতজনিত রোগে আক্রান্ত। তিনি প্রায় দেড় বছর অসুস্থ। তার মতে- জীবন যেখানে প্রায় অচল, সেখানে এই মহামারির মধ্যে আরো কষ্ট বেড়েছে। পত্রিকা অফিস যা ভাতা দেয়, তাতে পেটের খাবারই হয় না। ওষুধ কেনার টাকার অভাব তো আছেই। তার পরও হাসি মুখে সবাইকে বলতে হয় ভালো আছি!
সাংবাদিক এম ইউ উল্লাস ক্ষোভের সাথে দুঃখ নিয়ে জানান, কেজি স্কুল ছিল, রাইস মিলের ব্যবসা ছিল সব বন্ধ। সংবাদের নেশায় মাঠে ছুটে চলেছি, অত্যন্ত কষ্টে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছি। মাঠের সাংবাদিকরা আজ প্রণোদনা পায় না, সেটা জোটে ঘরে থাকা বন্ধুদের! প্রণোদনাতে দলীয়করণ ভাবতে অবাক হই! তিনি জানান, আগামী মাসেও যদি অফিস বেতন-ভাতা না দেয়, তবে ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য হব।
শরিফুল ইসলাম শরিফ দুঃখের সাথে বলেন, মোটেও ভালো নেই আমরা। ভয় শংকা আর আতংক নিয়ে চলেছি। সংবাদ লিখতে আর ভালো লাগে না। বাড়ির পাশে এই বাড়িতে তিনজন করোনায় মারা গেলেন, কী করে ভালো থাকি? তিনি সবার কাছে দোয়া কামনা করেছেন।
কে এম আর শাহিন তার মতামতে বলেন, স্বেচ্ছাশ্রম হিসেবে কাজ করছি। ঝুঁকি নিয়েই ছুটি। করোনায় আক্রান্তও হয়েছিলাম। তিনি দুঃখের সাথে বলেন, আমাদের ঝুঁকি আছে- ঝুঁকি ভাতা নেই। স্বপ্রণোদিত হয়েই কষ্টের মধ্যে বেঁচে আছি।
সোহাগ মাহমুদ বলেন, আর জীবন চলছে না। বেতন ভাতা বন্ধ, সংসার জীবন শুরু করিনি তাই হয় তো স্বস্তিতে কিছুটা আছি। নিজের খেয়ে বনের মোষ তেড়ে চলেছি, শক্তি-সামর্থ-আগ্রহ যতদিন থাকবে, এখানে আছি ততদিন। তিনি বলেন, কোচিং চালাতাম সেটা বন্ধ। অর্থনৈতিকভাবে কষ্টের মধ্যেও হাসি মুখে সংবাদ লিখে চলেছি। আমাদের কথা কেউ ভাবে না, যদিও আমরা সবার কথা ভাবি।
রাকিব হোসেন সোহাগের মতকে গুরুত্ব দিয়ে একই রকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
সবক্ষেত্রে ছুটে চলা নবীন সাংবাদিক মিজানুর রহমান নয়ন। তার মন্তব্য সংবাদের নেশায় ছুটে চলি, স্বাস্থ্য সুরক্ষার মত কিছুই নেই। কোচিং ও ব্যবসা করতাম সেটা বন্ধ। পেটে জ¦ালা থাকলেও বলার জায়গা নেই। মহান পেশা, মহৎ কাজ, তাই রাতদিন ছুটে চলেছি অবিরাম।
আরেকজন মেধাবী সাংবাদিক কাজী সাইফুল। তিনি মতামত দিয়েছেন এভাবে- আসলে মফস্বলের বেশিরভাগ সাংবাদিকই নিজের খেয়ে বোনের মহিষ তাড়ানোর মতো করে সাংবাদিকতা করেন। বেশিরভাগ সাংবাদিকই বেতনহীনভাবে কাজ করেন। এই করোনাকালীন সময়ে সাংবাদিকরা ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। হ্যাঁ জেলার মধ্যে সরকার সাংবাদিকদের জন্য প্রণোদনা দিয়েছে কিন্তু জেলায় শতাধিক প্রকৃত সাংবাদিক থাকা শর্তেও সেই প্রণোদনা মেইনস্ট্রিমের ১০/১২ জন সাংবাদিক পেলেও বেশিরভাগই সাংবাদিকতার সাথে যুক্তই নেই এবং নামসর্বস্ব পত্রিকার পরিচয়পত্র বহনকারী পেয়েছেন। যদিও প্রকৃত সাংবাদিকরা ১০ কেজি চাল, ১ লিটার তেল, ১ কেজি ডাল, দুই কেজি আলু, ১টা মিনি সাইজ সাবানের জন্য বা প্রণোদনার টাকার জন্য সাংবাদিকতা করে না।
নবীন সাংবাদিক মাসুদ রানা সাংবাদিকতার পাশাপাশি পশু চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত। তার মতামত হচ্ছে- ভালো কী করে থাকি? পশু চিকিৎসক না হলে খবর ছিল! পত্রিকা অফিসের দিকে চেয়ে থাকলে ডান হাত মুখে চলতো না। তিনি কষ্টের মধ্যেই তৃপ্তির হাসি হেসে সুখের সন্ধান করছেন বলে জানান।
যখন কুমারখালীর সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম তখন অনেকেই উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়েছে- সিনিয়র, আপনি কেমন? কেমন চলছে? হাসিমুখে জবাব দিয়েছি- আছি আলহামদুলিল্লাহ! ছোটখাটো একটি চাকরি করি, তাতেই চলছে আর কী! পত্রিকা অফিস প্রায় ৭০ মাস বেতন-ভাতা দেয় না, দিতে পারেনা। তারপরও সমস্যা সম্ভাবনা উন্নয়ন নিয়ে সংবাদ লিখে চলেছি। সেবার মানসিকতায় এখনো আছি, জানিনা আর কতদিন টিকে থাকবো এভাবে!
দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা ন্যায়বান সাংবাদিকরা আজ ভালো নেই। ভবিষ্যৎ নেই তাদের। সুখবর নেই কোথাও। পত্রিকা বাড়ছে, চ্যানেল বাড়ছে, সাংবাদিক ব্যাঙের ছাতার মত গজাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেই সাংবাদিকদের মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রটা বাড়ছে কী? এই প্রশ্নের উত্তর একজন প্রকৃত সাংবাদিক দিতে পারবেন কী? না কী তথ্য প্রযুক্তি আইনের ভয়ে বলবেন ‘যা হবার হয়ে যাক, আমি কিছু কমুনা’!

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ