শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ইন্টেরিয়র ডিজাইনার

অয়েজুল হক

 

একমাত্র ছেলের বিয়েতে শহরের সবচেয়ে নামকরা আর্টিস্ট দিয়ে পুরো বাড়িটা ডেকোরেশন করবেন আলম সাহেব। এ ব্যাপারে তার ছাত্র মেঘের সঙ্গে কথা বলতেই বলে, স্যার আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি গল্পকে বলে দেব।

- গল্পকে বলে দেবে মানে!

- গল্পকে চেনেন না?

- চিনব না কেন! তোমাদেরই তো কত গল্প পড়িয়েছি মনে নেই?

মেঘ হাসে। গল্প এ শহরের সেরা ইন্টেরিয়র ডিজাইনার।

- সেরা ইন্টেরিয়র ডিজাইনার তো একটা গল্প হবেই, আরও ওপরে গেলে হবে ইতিহাস।

- স্যার ওর নামটাই হল গল্প।

- ও আচ্ছা, নাম গল্প! আজকাল বাবা-মার নাম বাদ দিয়ে তোমরা নিজেরা কী সব নাম জুড়ছ...

মেঘ হাসে। চুপ করে থাকে।

তাহলে ওকে বলে দিও ঈদের আগে যেন বাড়ির লুকটা চেঞ্জ করে দেয়। থ্রিডি স্টাইলের লুক চাই। জানো তো আমার একটাই মাত্র ছেলে।

- থ্রি, ফোর, ফাইভ আপনি যে ডি চান সব হবে স্যার। আমি ওকে বলে দিচ্ছি।

- আচ্ছা।

পরদিন সাত সকালে বিরামহীন কলিংবেলের শব্দে মেজাজটা খারাপ হয় রাজুর। রাজু আলম সাহেবের একমাত্র ছেলে। একমাত্র ছেলেদের সম্ভবত রাগ জেদ একটু বেশি হয়। কলিংবেল বেজে চলছে। একবার চাপ দে। মানুষের আসতে, দরজা খুলতে তো সময় লাগবে। বাইরের সুইচটা সম্ভবত টিপে ধরে রেখেছে। দরজা খুলেই দেখে দুজন মানুষ। সামনেরটার বয়স পঁচিশ, ত্রিশ হবে। পরিষ্কার ছিপছিপে গড়ন। পেছনে দাঁড়িয়ে বয়স পঞ্চাশের মোটাসোটা হাতির মতো একজন। গায়ের রঙটাও হাতি কালারের। একটার পাশে আরেকটা বড়ই বেমানান। দরজা খুলেই রাগ ঝাড়ে রাজু, কলিংবেলের সুইচে কি আঙ্গুল আটকে গেছে? চুম্বক নাকি?

- স্যার আমি গল্প...

মিনমিন করে কথা বলে সামনের ছেলেটা।

- গল্প! আচ্ছা বলেন। সকালটা গল্প দিয়েই শুরু করি।

- স্যার, আসলে সে গল্প না।

- আরে ভাই বললাম তো বলতে। যে গল্প বলতে মন চায় সে গল্পই বলুন।

- কাল ফোন দিয়েছিলেন। আসার কথা বলেছিলেন।

- আমি ফোন দিয়েছিলাম!

- জি আমার সঙ্গে কথা হয়নি, মেঘের সঙ্গে কথা বলেছেন।

পুরাই পাগল। সাত সকালে তামাশা একদম পছন্দ হয় না রাজুর। কাল মেঘের সঙ্গে কথা বলেছে! সকালেই আকাশ থেকে নেমে এসেছে দুজন। গল্প শোনাতে! ফাজিলের দল। লাল চোখে বলে, কাজ কাম নাই? ফাজলামি করতে বেরিয়েছ। বাড়ি আর পাওনি! পাছায় দুটো লাত্থি মেরে রং ছোটাব। যা ভাগ। কথা শেষ করেই রাজু দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়।

গল্প বেচারা জীবনে এমন রুক্ষভাষী মানুষ দেখেনি। কী কর্কশ ব্যবহার! আজকের দিনটাই নষ্ট হয়ে গেল। পেছন থেকে কথা বলে মনির। ওস্তাদ ঠিকানা ভুল হইছে মনে হয়। ভালো একটা কথা বলেছে মনির। বয়স হয়ে গেলে সাধারণত মানুষ কম বুদ্ধির কথাই বেশি বলে। মনির অবশ্য তার উল্টো। যত বয়স বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বুদ্ধিমত্তা।

নোটবুকটা বের করে মোবাইল নাম্বারে ফোন দেয়। একটু পরই একটা মেয়ের গলা শোনা যায়। হ্যালো। দারুণ মিষ্টি কণ্ঠস্বর। কাস্টমার কেয়ারের মেয়ে ফেল। অবশ্য ফোনটা ধরার কথা বুড়ো গলার আলম নামের এক ভদ্রলোকের। সেটা না হয়ে হয়েছে উল্টো। বুড়ো পুরুষ তো নয়ই, বুড়ো মহিলাও না। যুবতী মেয়ে!

- আমি স্থপতি ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার গল্প বলছিলাম।

- জি বলেন।

- আমি আলম সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

- জি বলেন।

গল্প অবাক হয়। একটা যুবতী মেয়ে কী করে আলম সাহেব হয়! হিসাব মেলাতে পারে না। আবার বলে, আমি আলম সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

মেয়েটা কিছুটা রেগে যায়, বলতে বললাম না।

- সরি আলম সাহেব। আপনার গলাটা কেমন মেয়েলি মেয়েলি লাগছে।

- মানে!

- আমি ভেবেছিলাম কোন যুবতী মেয়ে ফোন ধরেছে। বুঝতে পারিনি আপনি আলম সাহেব।

- মাথায় কী গ-গোল আছে?

- গ-গোল থাকবে কেন!

- আমি নিতু, আলম সাহেব হতে যাবো কেন? ছাগলের জ্ঞানটুকুও মাথায় নেই।

ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয়। গল্প দুবার বলেছে আলম সাহেবকে চাই। দুবারের জবাব, বলেন। মানে কী দাঁড়ায়! তিনি আলম সাহেব। আবার ফোন দেয়। আবার। কয়েকবার ফোন দেয়ার পর ওপাশে আলম নামক ভদ্রলোকের মেয়েকণ্ঠ শোনা যায়!

- কী ব্যপার! আবার ফোন দিয়েছেন কেন?

গল্প সুন্দর করে বলে, আলম সাহেব আপনি এমন করছেন কেন?

- এই ব্যাটা ছাগল তোকে না বললাম আমি নিতু। ফের যদি এই নাম্বারে ফোন করিস সোজা ওসি দিয়ে তোকে আচ্ছামতো পেদানি খাওয়াব। লাইন কেটে দেয়। এটা অহংকারী মানুষের একটা স্বভাব। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গল্প বলে, মনির সাব।

- হু।

- আজকের দিনটা আসলে কেমন যেন। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মনির সাব ফিক করে হেসে ওঠে। দিনটা আবার কেমন হবে! সূর্য উঠেছে। আলো বিলাচ্ছে। তালগাছে তাল থাকতে পারে। আর তাল তো গোলই। তাল পাকবে এটাও স্বাভাবিক।

গল্প কিছু বলে না। চুপচাপ সামনের রাস্তা ধরে হাঁটে। বেচারা মনির সাবও তার সঙ্গে মশকরা করছে। বেশ কড়া রোদ। যেটুকু গায়ে লাগছে মনে হচ্ছে পুড়ে যাবে। আগুন ধরে যাবে। ভাগ্যিস আগুন ধরে যায় না। পথ চলতে চলতে হঠাৎ করে দাউদাউ করে কারও শার্ট-প্যন্ট থেকে আগুনের লেলিহান শিখা বের হতে শুরু করলে দারুণ ভোগান্তি হতো। বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়ত। গলা শুকিয়ে আসে। হাঁটতে হাঁটতে বলে, মনির সাব।

- জি, বস।

- আর হাঁটতে পারছি না। খুব ক্লান্ত লাগছে।

- তাহলে কি বসে পড়ব?

- রাস্তার ওপর বসে পড়লে কেমন দেখায় না?

- যেমন দেখায় দেখাক তাতে আমাদের কী? আসেন বসে পড়ি...কথা শেষ না হতেই মনিরের মুখটা উজ্জ্বল হয়। বস।

- হু।

- সামনের বাড়িটা দেখেন। বাইরে ডেকোরেশন হয়েছে। এটা হতে পারে। গল্প মনে মনে ভাবে, ঠিক বাড়ি ভুল বাড়ি যা হোক একগ্লাস ঠা-া পানি তো খাওয়া যাবে। আচ্ছা চলুন গিয়ে দেখি।

পাঁচতলা একটা বাড়ি। সুন্দর ডিজাইন। ওপরের দিকে উঠে গেছে স্বমহিমায়। বাইরে একটা গেট সাজানো। ভেতরে সাজসজ্জা নেই। মূল ফটক পেরোতেই দেখা যায় বয়স্ক একজন মানুষ পায়চারি করছেন। ওদের দেখেই হাঁক ছাড়েন, কী চাই?

- স্যার এটা কি বিয়ে বাড়ি? প্রশ্ন করে মনির।

- বিয়ে বাড়ি হোক না মরা বাড়ি হোক তা দিয়ে কী দরকার? দেখতে যতটা সুন্দর, ব্যবহার ততটাই অসুন্দর! মানুষ আজকাল মানুষরূপি হয়ে পড়ছে। রূপের মানুষ। আলম সাহেব প্রতারণা করলেন। কেন করলেন কে জানে!

- স্যার আমরা ইন্টেরিয়র ইঞ্জিনিয়ার......

মুখের কথা কেড়ে নেয় বয়স্ক লোকটা, বুঝেছি। এই ইন্টেরিয়র ইঞ্জিনিয়ারগুলো মানুষের জাত না। পশু থেকে উৎপাদিত নয়, তবে মানুষ থেকে রূপান্তরিত অমানুষ। আমার সামনে যে পড়বে আচ্ছামতো ধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেব। গল্প কেঁপে ওঠে। লোকটার সামনে যদি নিজের পরিচয় প্রকাশ পায় অপরাধ ছাড়াই নির্ঘাত মার খেতে হবে। বড়লোক মানুষ চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারলে বিচার হয় না। পেটে ক্ষুধা, মনে ভয় এর ভেতর মনির বলে ওঠে, স্যার সকাল থেকে তো খুঁজছি। গল্পের ইচ্ছা করে মনিরের মুখটা টিপে ধরতে। আপাতত কাজটা করা যাচ্ছে না। আবার কথা বলেন ভদ্রলোক, আর পেয়েছ! আমি একমাস ধরে খুঁজছি। বিয়ের ফুল ডেকোরেশন, লুক, থ্রিডি ডিজাইন সব করবে বলে একমাস আগে অগ্রিম পঞ্চাশ হাজার নিয়ে সেই যে পালাল আর খুঁজে পেলাম না। মুখে হাসি নিয়ে বলে, তা তোমাদের কত গেছে বাপু?

তড়িঘড়ি করে গল্প জবাবটা দেয়, ঐ রকম। কাজটা হাজার পঞ্চাশের মতো। কোথায় যে গেল!

- এগুলো হল শয়তানের দুই নাম্বার চেলা। নতুন প্রজাতির শয়তান।

গল্পের গলা শুকিয়ে আসে, একগ্লাস পানি খাওয়ানো যাবে?

- আরে বলো কী! আমরা এক পথের পথিক। সুফিয়া, সুফিয়া। হেড়ে গলায় চিৎকার করতে থাকে লোকটা। ডাক নয় যেন আকাশের বজ্রধ্বনি। সুফিয়া হুড়মুড় করে হাজির হয়। সেটাও ওপর থেকে জিন পরী পড়ার মতো।

- স্যার ডেকেছেন?

- হ্যাঁ, ভদ্রলোকদের জন্য কফি আর ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো।

হঠাৎ গল্পের মোবাইল বেজে ওঠে। সেই নাম্বার! ওসি সাহেব কল দিল নাকি! রিসিভ করে। হ্যাঁ, নিতু বলেন

- কি যা তা বলছ। নিতু বলবে কেন! ওপাশ থেকে এবার বুড়ো কণ্ঠের গলা শোনা যায়! আমি আলম। গল্প সাহেব না?

- জি, স্যার।

- ইন্টেরিয়র ইঞ্জিনিয়ার গল্প তো?

গল্পের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কফি আনতে পাঠানো ভদ্রলোক। লাল চোখ। ইন্টেরিয়র ইঞ্জিনিয়ার বললেই বিপদ ঘটার সমূহ সম্ভাবনা আছে।

- না স্যার আমি ইন্টেরিয়র ইঞ্জিনিয়ার হতে যাব কেন? এগুলো তো মানুষই না। শয়তানের দুই নাম্বার চেলা।

- তুমি নিতুকে চিনলে কী করে?

- আমার ক্লাসমেট। আমরা একসঙ্গে পড়ি।

- কী বল! নিতু তো পড়ে না।

- তাহলে রং নাম্বার।

ভদ্রলোক থামেন না । দেখ আমার ছেলে কিন্তু ওসি। রাজু ওসি। আমি ঠিকই তোমার তামাশা ছোটাব। একটু থেমে আবার বলেন, আচ্ছা কাল মেঘ যে এ নাম্বারটাই দিল! - সরি স্যার।

- হয়তো ভুল হয়েছে। রং নাম্বার।

- তোমার রং আমার রং সব রং একসঙ্গে হয় কী করে?

গল্প কেটে দেয়। কফি, ঠা-া পানি চলে এসেছে। মনির মুখের ওপর এসে প্রশ্ন করে, স্যার আলম সাব ফোন করেছিল?

- হ্যাঁ।

- তা বললেনটা কী! আপনি ইন্টেরিয়র ইঞ্জিনিয়ার না? আপনি হলেন এ কাজের গুরু। কাজটা হাতছাড়া করে ফেললেন? সঙ্গে সঙ্গে চা কফির গ্লাস ভাঙার শব্দ। চিৎকার, বড় শয়তানটাকে পেয়েছি। আমার মেয়ের বিয়েটাই বরবাদ হয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশ হাজার লুটে হয়নি। আবার ধান্দামি করতে এসেছে। আজ মেরেই ফেলব। বড় লোহার রড নিয়ে তেড়ে আসে। গল্প দেরি করে না। ভোঁ দৌড়। সঙ্গে মনির। বুড়ো লোকটা বেশিদূর এগোতে পারে না। অলিগলি পেরিয়ে কিছুটা নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দৌড় থামায়। মনিরকে ইচ্ছামতো গালমন্দ করতে ইচ্ছা করে। আবার ভাবে লাভ কী! গল্পের মনে হয় তার সঙ্গে একঝাঁক গল্প ঠাট্টা করছে। বিদ্রুপ করছে। হাসছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ