শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এমন ভাবনার কারণ আছে

মানুষ এভাবে ভাবছে কেন? তারা বেজোসকে মহাকাশে আটকে রাখতে চাইছে কেন? উল্লেখ্য যে, আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস আগামী মাসে মহাকাশ ভ্রমণে যাচ্ছেন। তবে তাঁকে যেন আর পৃথিবীতে ফিরতে না দেয়া হয়, অনলাইনে এমন আবেদনে গণস্বাক্ষরে অংশ নিয়েছেন হাজারো মানুষ। বেজোস কেবল আমাজনেরই নন, মহাকাশ ভ্রমণের প্রতিষ্ঠান ব্লু অরিজিনেরও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৭ জুন ঘোষণা দেন, ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নিউ শেপার্ড নভোযানে ক্ষণিকের জন্য মহাশূন্য  থেকে ঘুরে আসবেন। মানুষ নিয়ে ব্লু অরিজিনের  প্রথম সে উড্ডয়নের দিন ঠিক করা হয়েছে আগামী ২০ জুলাই। এছাড়া তাঁর সফরসঙ্গী থাকছেন আরও একজন। নিলামে প্রায় তিন কোটি ডলারে তিনি টিকিট কিনেছেন।
বেজোস মহাকাশে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর তাঁকে মহাকাশ থেকে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসতে বাধা দিতে অনলাইনে দু’টি পিটিশন চালু করা হয়। চালুর দিনদশেকের মধ্যে হাজারো মানুষ তাতে অংশ নেন। দ্য বিজনেস ইনসাইডার-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জেফ বেজোসকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে দিয়ো না’ শিরোনামে চেঞ্জ ডট অর্গ ওয়েবসাইটে খোলা পিটিশনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেছেন। সেটির বিবরণের ঘরে লেখা হয়েছে, ‘বিলিয়নিয়ারদের অস্তিত্বই থাকা উচিত নয় .... সেটা পৃতিবীতে যেমন, মহাকাশেও তেমন। তবে তাঁরা যদি পরেরটি বেছে নেন, তাহলে তাঁদের সেখানেই থাকা উচিত।’
পিটিশনে অংশ নেওয়াদের একজন লিখেছেন, ‘জেফ বিল (গেটস), ইলন (মাস্ক) এবং এমন অন্য বিলিয়নিয়ারদের চায় না পৃথিবী।’ পিটিশনে বিলিয়নিয়ারদের প্রতি ক্ষোভের একটি বার্তা পাওয়া যায়। বিলিয়নিয়ারদের অস্তিত্বই থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্যও করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, ওদের চায় না পৃথিবী। বড় বড় ধনীদের প্রতি এতো ক্ষোভ কেন? এই পৃথিবীতে ধন উপার্জনের নানা পথ রয়েছে। অবৈধ ও শোষণমূলক পথও আছে। এ পথ মানুষের জন্য, পৃথিবীর জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। আর সম্পদ অর্জন ও সুষম বণ্টনের বিষয়টি সব সময়ই মানবজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত চিত্র কমই লক্ষ্য করা গেছে। সম্পদ অর্জনে যেমন শোষণ, বঞ্চনা ও প্রতারণার বিষয় আছে; তেমনি সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও আছে অজাচার, অনাচার ও ধ্বংসাত্মক চেতনা। ক্ষতিকর চেতনা যেমন ব্যক্তি লালন করে, তেমনি পালন করে রাষ্ট্রও। বর্তমান সভ্যতায় মাদক, মারণাস্ত্র, অশ্লীলতা ও পরিবেশ বিপর্যয়ের দায় কাদের ওপর বর্র্তাবে? দরিদ্র মানুষ এবং গরিব রাষ্ট্রগুলোতো এর জন্য দায়ী নয়। যারা দায়ী, তারাই আবার সভ্যতার শাসকও! মানবিক পৃথিবীর পথে এরাই বাধা। পরিবেশের জন্য, জীবনের জন্য নদী অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নদীর প্রবাহমানকে কেউ আটকে দিতে পারে না। অথচ বড় বড় রাষ্ট্রগুলো নদীর প্রতি করছে বৈরী আচরণ।
নদীতে ড্যাম বা বাঁধ দেওয়ার বিষয়টি কতটা সঙ্গত? পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টিকে অসঙ্গত মনে করেন, তাই এর বিরোধিতা করছেন। ভারতের পলিসি রিসার্চের অধ্যাপকরাও নদী আটকে বাঁধ দেওয়ার বিষয়টিকে মানতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। চীন ভারতের উজানে এখন শুধু বাঁধ বা ড্যাম নির্মাণ করছে না, করছে সুপার ড্যামও। উল্লেখ্য যে, চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি) ১ জুলাই পার্টির শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে। এই সময় তারা শত বছরের বড় বড় অর্জনগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবে। এসব অর্জনের একটি হলো তিব্বত মালভূমির দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের জিনশা নদীর উপর নির্মিত বাইহেতান জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ। ১ জুলাই ওই বাঁধের কার্যক্রম চালু হবে বলে জানা গেছে।
চীনের ড্যাম ও সুপার ড্যাম নির্মাণ কার্যক্রমে বেশ উদ্বিগ্ন ভারতের পরিবেশবিদ, গবেষক এবং প্রশাসন। এদের একজন ব্রহ্ম চেলানি। তিনি নয়াদিল্লীভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের একজন অধ্যাপক। অধ্যাপক চেলানি তার সাম্প্রতিক এক লেখায় উল্লেখ করেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দিক থেকে চীনের থ্রি জর্জেজ ড্যাম প্রকল্প আগে থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর বাইহেতান ড্যাম নামের যে বাঁধটির উদ্বোধন হতে যাচ্ছে সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফটকওয়ালা বাঁধ । শুধু তাই নয়, এটিই হতে যাচ্ছে বিশ্বের  প্রথম কোন বাঁধ প্রকল্প যেখানে এক গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম দানবাকৃতির হাইড্রোটারবাইন ব্যবহৃত হবে। এ রকমের ১৬টি জেনারেটর থাকবে এ বাঁধে, যা এটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যাম হিসেবে দাঁড় করাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে প্রথম স্থানে আছে চীনেরই থ্রি জর্জেজ ড্যাম, যার বিদ্যুৎ উদযাপন ক্ষমতা সাড়ে ২২ গিগাওয়াট। চীনের এই বড় বড় বাঁধ শুধু যে দেশটির অভ্যন্তরীণ পানি সুরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তা নয়, বরং ভাটির দেশগুলোর উপর খবরদারি করার ক্ষেত্রে এ বাঁধগুলোকে যাতে ব্যবহার করা যায় সেটিও তারা নিশ্চিত করেছে। অধ্যাপক চেলানি আরও উল্লেখ করেন, মে কং নদী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে পয়েন্ট দিয়ে ঢুকেছে, ঠিক তার আগে চীন ১১টি বিশাল বিশাল বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে দিয়েছে। তাদের এ কাজের খেসারত দিতে হয়েছে এশিয়ার বহু নদীকে। বহু নদীর প্রবাহ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি চীনের ভেতর থাকা ইয়েলো এবং ইয়াংজি নদীও এ প্রকল্পের কারণে পানিপ্রবাহ হারিয়েছে। অধ্যাপক চেলানি যথার্থই বলেছেন, বৃহৎ বাঁধ প্রকল্প পুরো ইকো সিস্টেমের ক্ষতি করে। স্বাদু পানির জীবকে ধ্বংস করে দেয়, বদ্বীপগুলোকে ক্ষয় করে। এটি জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে বেশি গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন করে। এসব বাঁধের কারণে চীনের ভেতরই সাড়ে তিনশ’র বেশি হ্রদ শুকিয়ে মরে গেছে এবং বহু নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, চীন এখন তাদের ভূখণ্ডে ইয়ার লাং জাংবো নদীতে বিশ্বের প্রথম সুপার ড্যাম নির্মাণ করতে চাইছে। এ নদী চীনের মধ্যদিয়ে ভারতে পড়েছে, ভারতে এর নাম ব্রহ্মপুত্র। এ নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে যে সুপার ড্যাম বানানো হবে, তার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ গিগাওয়াট, অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি উৎপাদনে সক্ষম থ্রি জর্জেজ ড্যামের চেয়েও এর উৎপাদন ক্ষমতা হবে তিন গুণ। চীন ইতিমধ্যেই এ প্রকল্পের পরোক্ষ কাজ শুরু করে দিয়েছে। নদী আটকে বাঁধ এবং এর প্রভাব প্রসঙ্গে অধ্যাপক চেলানি আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় উল্লেখ করেছেন। সব শেষে তিনি উল্লেখ করেছেন, কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি) নদীতে বড় বড় বাঁধ নির্মাণের কাজকে উদযাপনের বিষয় হিসেবে দেখছে। কিন্তু তার ফলে বাকি বিশ্বের যে কী ক্ষতি হবে তা তারা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে।
নদী আটকে বাঁধ নির্মাণ এবং এর ধ্বংসযজ্ঞ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানি যে বিশ্লেষণ করেছেন তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। এসব বাঁধের ক্ষতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকরাও উদ্বিগ্ন। তবে এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, নদীতে চীন বাঁধ দিলে পরিবেশ ও প্রতিবেশীদের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি ভারত নদীতে বাঁধ দিলে পরিবেশ ও প্রতিবেশীদের ক্ষতি হবে না? বাংলাদেশের উজানে ভারত বিভিন্ন নদীতে ফারাক্কাসহ বহু বাঁধ দিয়েছে। এসব বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীসমূহ শুকিয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যে মন্দ প্রভাব পড়েছে, নদীপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় দেখা দিয়েছে সংকট। বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক মহল ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে ওইসব বাঁধের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে অনেক বক্তব্য রাখা হয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। উজানের নদীতে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে যাচ্ছে ভারত।
আমরা মনে করি নদীতে চীন, ভারতসহ যে কোন দেশ বাঁধ নির্মাণ করলে তা হবে বিশ্ব ও মানবজাতির জন্য ক্ষতির কারণ। আমরা জানি যে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে পৃথিবীকে নানা দেশে ভাগ করা গেলেও প্রকৃতিকে ভাগ করা যায় না। প্রকৃতি ও নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও বিকাশে বাধা সৃষ্টি করলে তার পরিণতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতি প্রতিশোধও নিতে পারে। করোনা মহামারির উদাহরণ আমাদের বোধোদয় ঘটাতে সাহায্য করতে পারে। সবকিছুকে রাজনীতির চশমায় অবলোকন করলে মানব জাতির সংকটের মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানি আলোকপাত করলে আমরা উপকৃত হবো।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ