শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শুধু লকডাউন

সামছুল আরেফীন : করোনা মহামারীর এই সময়টায় দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া আর সবই খোলা। বিধি নিষেধের মধ্যেই খুলে দেয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক-বীমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। চলছে গণপরিবহন। শপিং মল, বিপণিবিতান, মার্কেট আগেই খুলেছে। প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ও চলছে স্বাভাবিক নিয়মেই। উচ্চ আদালত চলছে ভার্চুয়ালে। আজ রোববার থেকে হাই কোর্টের সব বেঞ্চ ভার্চুয়ালে শুরু হবে। প্রায় দেড় বছর ধরে তালাবদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরীক্ষা ও ক্লাসে ফেরার অপেক্ষায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী। যদিও শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবী জানিয়ে আসছেন। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে কোন আশার আলো দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। পরীক্ষা নিয়ে বিকল্প চিন্তা করছেন বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রী ডা: দীপু মনি।  
করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটিও। দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ ঘোষণা করলেও সরকার খুলতে পারেনি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ৩০ জুন পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১৫ জুলাই পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপ করায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ ছুটি ফের বাড়বে। কবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। করোনার কারণে গত বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা না নিয়ে অটোপাস দেওয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় এখনো এসএসসি ও এইচএসসিতে পরীক্ষা নিতে পারেনি সরকার।
সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল এসএসসির জন্য ৬০ কর্মদিবস ও এইচএসসির জন্য ৮৪ কর্মদিবসের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রকাশ করা। এ সিলেবাসের আলোকেই তাদের ৬০ দিন ও ৮৪ দিন ক্লাস নেওয়া হবে। এরপর কমপক্ষে ১৫ দিন সময় দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে। সর্বশেষ গত ১৩ জুন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ছিল। কিন্তু করোনার ঊর্ধ্বগতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ৩০ জুন পর্যন্ত হয়েছে। বর্তমানে করোনার যে ঊর্ধ্বগতি ও আগামী জুলাই মাসে ঈদুল আজহার কারণে ঈদের আগে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে ক্লাস নেওয়াও যাবে না। এ কারণেই মন্ত্রণালয়কে বিকল্প ভাবতে হচ্ছে।
অনলাইনে পরীক্ষার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ইতিমধ্যে একটি কমিটি করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কমিটির মত, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে অনলাইনে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। যদি অনলাইনে পরীক্ষা নিতে হয় তাহলে অন্তত তিন-চার বছর আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
পরীক্ষা আয়োজনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। ডিসেম্বরে পরীক্ষা নিতে হলে শিক্ষার্থীদের কিছুদিন ক্লাস করানোর জন্য কয়েক মাস আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে গুরুত্বপূর্ণ চার-পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষা গ্রহণের বিকল্প ভাবনা আছে। বিশেষ করে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই পরীক্ষা হতে পারে।
তবে কোনোভাবেই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক মূল্যায়ন হতে পারে। ইতিমধ্যে ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া শুরু হয়েছে। একই ভাবে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদেরও অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে। তবে এই দুই পাবলিক পরীক্ষায় অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হলে এর সঙ্গে আগের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার নম্বর যুক্ত করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে এসএসসির ক্ষেত্রে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং এইচএসসির ক্ষেত্রে জেএসসি ও এসএসসির নম্বর এই মূল্যায়নে থাকতে পারে। তবে এবার পরীক্ষার্থীদের অটোপাস দেওয়া হচ্ছে না। নির্ধারিত সিলেবাসের ওপরে দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট, বাড়ির কাজ ও ব্যবহারিক কাজের ভিত্তিতে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এখন পর্যন্ত পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারেই মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত রয়েছে। অন্তত আমরা ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখতে চাই। এ সময়ের মধ্যে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে আমাদের বিকল্প ভাবতে হবে। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতিই রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের বাড়িতে স্বাভাবিক পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পরীক্ষা নিতে পারব কি পারব না, না নিলে বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে, সে সবকিছু নিয়েই আমাদের চিন্তাভাবনা রয়েছে। অনলাইন ও অ্যাসাইনমেন্ট যা হচ্ছে, তার বাইরে যেটুকু সম্ভব, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বাড়িতে চালিয়ে যাক। তাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না, যাতে তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করোনাভাইরাসের কারণে তো সারাবিশ্বেই শিক্ষার ক্ষতি হচ্ছে।
পিছিয়ে যাচ্ছে ভর্তি পরীক্ষাও : একের পর এক পিছিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তা পেছাতে বাধ্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবর্তিত তারিখ ঘোষণা করেছে। সর্বশেষ বুধবার সাত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়।
দেশে ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তবে এবার প্রথম বর্ষ অনার্সে শিক্ষার্থী নিচ্ছে ৩৯টি। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গুচ্ছবদ্ধ হয়ে এবারে পরীক্ষা নিচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। গুচ্ছগুলো হচ্ছে, সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া পুরোনো ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা পরীক্ষা নিচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পরীক্ষার পরিবর্তে এসএসসি-এইচএসসিতে প্রাপ্ত গ্রেডের মাধ্যমে ভর্তি করা হয়। সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আলাদা পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ই আবেদন ও পরীক্ষার সময় পুনর্বিন্যাস করেছে। তবে এ পরিস্থিতির মধ্যেই ২ এপ্রিল মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির পরীক্ষা নেওয়া হয়।
জাতিকে মেরুদন্ডহীন করে দিচ্ছে: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে রেখে জাতিকে মেরুদণ্ডহীন করে দিচ্ছে উল্লেখ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, এই সরকারের সবচেয়ে বড় ভুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা। বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নেবে কিন্তু হল খুলবেন না। এর থেকে বড় ভুল হতে পারে? ছাত্ররা কি মাঠে থাকবে? মাটিতে বসে থাকবে? গতকাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, পত্রিকায় পড়েছি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কিন্ডারগার্টেনও বন্ধ; কিন্ডারগার্টেন মানে একটি বিশেষ মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর একজন প্রিন্সিপাল নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ার-টেবিল বিক্রি করে ভাড়া পরিশোধ করেছেন, এরপর গ্রামে গেছেন। গ্রামের বাজারে চা বিক্রি করছেন। লজ্জা করে না এই শিক্ষামন্ত্রীর?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ