শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

উদ্বাস্তু জীবন

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী: পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হামলায় ১৯৭১ সালে আমরাও লাখে লাখে উদ্বাস্তু হয়েছিলাম। উদ্বাস্তু জীবন বড় কষ্টের। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, চিকিৎসার ওষুধ নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। জীবনের সবটুকুই ছিল পরমুখাপেক্ষী। সে জীবন বড় কষ্টের। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ একাকার। কারও জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। টয়লেট নেই। পানি নেই। কষ্টের অবধি নেই।

আমরা তাড়া খেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু হারিয়ে যাইনি। একেবারে শুরু থেকেই প্রতিরোধের সংকল্প নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। ছাড়ব না আমাদের মাতৃভূমি। সে প্রতিরোধের ব্যুহ থেকে আমরা গড়ে তুলেছিলাম মুক্তিবাহিনী। সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল, সামারিক নেতৃত্ব ছিল। প্রশিক্ষক ছিল। প্রতিরোধ যুদ্ধের কলাকৌশল শেখানোর লোক ছিল। ফলে দ্রুতই আমরা একটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পেরেছিলাম এবং এক সময় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে পেরেছিলাম।

কিন্তু সব জায়গায় সব সময় একই ফল পাওয়া যায় না। সব জায়গায় সব সময় প্রতিরোধ যুদ্ধের আয়োজন করা যায় না। ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি তা অনুমোদনও করে না। সে কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকটরূপ ধারণ করেছে। এই সমস্যা বসনীয়া থেকে সিরিয়া, সিরিয়া থেকে ফিলিস্তিন, ফিলিস্তিন থেকে উপমহাদেশের রোহিঙ্গা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। সংকটগুলোর জন্ম হয়, কিন্তু সমাধান হয় না। এসব সমস্যা নতুন নতুন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। লক্ষ লক্ষ সন্তান হারায় তাদের পিতামাতাকে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাদের পরিবার। হামেশাই কান্নার রোল ওঠে। কিন্তু ¯িœগ্ধতায় তার পরিসমাপ্তি সাধারণত ঘটে না।

আবার একেবারে যে ঘটে না, তেমনও নয়। কিন্তু সেগুলো খুবই বিরল। কোনো কোনো দেশের জান্তা কিংবা স্বৈর শাসকেরা কখনো কখনো জাতিগত নিধনের পথ বেছে নেয়। তখন সংকট আরো ঘনীভূত হয়। রোহিঙ্গা সমস্যা তেমনি একটি জাতিগত নিধনের সমস্যা। ভুয়া ইতিহাস ও তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে মিয়ানমারের আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে, সেখানকার বেসামরিক জান্তা। অং সাং সূ চি সামরিক লোক ছিলেন না। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেখানকার সামরিক জান্তার চেয়েও পৈশাচিক ভূমিকা তিনি গ্রহণ করেন। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের নাগরিকই নয়, এমন ধোয়া তুলে অং সাং সূ চি সেখানে গণহত্যা যজ্ঞ পরিচালনা করে। তাতে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সাধারণ বৌদ্ধ নাগরিকেরা। নরহত্যার এক উৎসব সেখানে পরিচালিত হয়। সংখ্যালঘু, দরিদ্র দুর্বল রোহিঙ্গাদের পক্ষে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। এসব রোহিঙ্গা জীবনরক্ষার্থে সহায়-সম্পদহীন, কপর্দকশূন্য অবস্থায় হাজারে হাজারে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে।

আশির দশকে একবার একই রকম পরিস্থিতির তৈরী হয়েছিলো। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জিয়া বিশেষ কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার ফলে মিয়ানমার কয়েক লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে নিজের দেশে প্রত্যাবাসন করান। কিন্তু যে কূটনৈতিক তৎপরতায় তিনি এক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন, পরবর্তী সরকারগুলো সেই কূটনৈতিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যর্থ হয়। ফলে আওয়ামী লীগ শাসনকালে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে মিয়ানমার বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশ না তাদের বাধা দেয়, না তাদের কোনরূপ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। ফলে নাফ নদীর বানের লাহান মানুষ আসতে থাকে। এখানে আওয়ামী সরকারের কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রাম্য আবেগ দিয়ে বললেন, আমরা যদি ষোল কোটি লোককে খাওয়াতে পারি, তাহলে আরো দশ লাখ লোককেও খাওয়াতে পারবো। কূটনীতির কবর সেখানেই রচিত হয়ে যায়। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা একথা শুনে দ্বিগুণ উৎসাহে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করতে থাকে। আমরা দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। শেষ পর্যন্ত বার লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের পদভারে ক্যাম্পে আশ্রয় শিবিরে তছনছ হয়ে যায় সেখানকার পরিবেশ। ঐ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের চাপে নিজেরাই উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়ে যায়। ফলে সংকট বহুমুখী হয়। সরকার উদ্বাস্তু সামলাতে হিমসিম খেতে থাকে। মিয়ানমার লোক দেখানোর জন্য মাঝে মাঝে কথা দেয়। শিগগিরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। কিন্তু প্রত্যাবাসন শুরু হয় না। প্রত্যাবাসন হবে বলেও আশা করা যায় না।

এই অবস্থায় বাংলাদেশ ভারী অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে। পরাশক্তিগুলো যার যার এজেন্ডা নিয়ে আছে। প্রায় সকলের কাছে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের  চেয়ে মিয়ানমারের বন্ধুত্ব অনেক জরুরি। উখিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ তছনছ হয়ে গেছে। এতো রোহিঙ্গা এখানে রাখা সম্ভব নয়। তাই মাত্র ২ লাখ রোহিঙ্গা এই এলাকা থেকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার আয়োজন করে সরকার। তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অনেক চাপ। এসব আন্তর্জাতিক ওয়ালারা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসনে যত না আগ্রহী, তত আগ্রহী তাদের বাংলাদেশে থিতু করতে। ভাসানচরে থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অতিরিক্ত পয়সা কামানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানে কামলা দেয়া যায় না। অথচ কক্সবাজারে উখিয়া, টেকনাফে কামলা দেয়া যায়। লেবারের কাজ করা যায়। ইট ভেঙ্গে দু’পয়সা কামানো যায়। সুতরাং ভাসানচর নয়, কুতুপালং ভালো। তাই জাতিসংঘ প্রতিনিধির সামনে ভাসানচরের ঊনিশহাজার রোহিঙ্গা বিক্ষোভ করেছেন, মূল ভূমিতে যাবেন। স্বাধীনভাবে চড়ে ফিরে খাবেন। ক্যাম্পের জীবন তাদের চাই না। এখানেও সরকারের কাছাখোলা নীতির বদলে দরকার কূটনীতিক পদক্ষেপ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ